গহন গহীন-জাপানের দুর্যোগ ও পরিবর্তিত পারমাণবিক দৃশ্যপট by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

কালের পরিক্রমায় বছর শেষে দুঃসহ স্মৃতিবাহী মার্চের সেই দিনটি ফিরে এলো। গেল বছরের (২০১১) মার্চ মাসের ১১ তারিখ দ্বিতীয় শুক্রবার অতিক্রান্ত-দুপুরে কাজপাগল জাপানের মানুষেরা যখন যার যার কর্মস্থলে, ভয়ংকর ঝাঁকি দিয়ে কেঁপে উঠল রাজধানী মহানগরী টোকিওসহ দ্বীপরাষ্ট্র জাপানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল এক জনপদ।


ভূকম্পনের তীব্রতায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়ির কাঁটা নির্দেশিত সময় তখন দুপুর ২টা ৪৬ মিনিট। এমন সময় যখন কাজে ব্যস্ত থাকে গোটা জাপান (এমনি বন্ধ ঘড়ি দেখেছি হিরোশিমা ও নাগাসাকি পিস মেমোরিয়ালে)। ভূকম্পনে অভ্যস্ত জাপানবাসী মহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারলেন চিরাচরিত কম্পনের চেয়ে ভয়াবহ এই ভূমিকম্প! রিখটার স্কেলে ৯ ডিগ্রির এই ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা পরবর্তী সময়ে যখন ক্রমাগত প্রকাশিত হতে লাগল, বিশ্ব জেনে গেল, বিশ শতকের পর সবচেয়ে ভয়ংকর ভূমিকম্পটির চেয়েও ভয়াবহ দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে তছনছ করে দিয়ে গেল। এশিয়ার সমৃদ্ধতম দেশ জাপান, যার পোশাকি নাম নিহন বা নিপ্পন, প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত বিশাল চারটি দ্বীপ- হনসু, হোক্কাইডো, কিয়োশু আর শিকোকুসহ ছোট-বড় মিলিয়ে আরো ছয় হাজার আট শ বায়ান্ন দ্বীপপুঞ্জের সমন্বয়ে গড়া এক বিস্ময় উদ্রেককারী দেশ। ভূগোলে ছোটবেলায় জেনেছি সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মি দেখা যায় জাপানের দিগন্তে বা উদীয়মান সূর্যের দেশ জাপান দ্য ল্যান্ড অব দ্য রাইজিং সান। দেশটির আয়তন ৩৭৭.৯৪৪ বর্গ কিলোমিটার, ১,৪৫,৯২৫ বর্গমাইল, যার কিছু অংশ বছরের পুরোটা সময় থাকে বরফে ঢাকা।
ভূকম্পন-প্রবণ অঞ্চলে অবস্থানের কারণে বলা যায় জাপানিদের বসবাস প্রাকৃতিক এই দুর্যোগটির সঙ্গে। অনেকটা গা-সহা যেন। প্রায়ই মৃদু ঝাঁকিতে কেঁপে ওঠে দেশটি এবং দালানকোঠাগুলোও সেই সঙ্গে হাল্কা দোল খায়। বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি এই বাড়িগুলোর ভিত্তিস্থল থেকে ভূমিকম্পের সময় একরকম যান্ত্রিক আওয়াজ শোনা যায়, যার কারণ বিশেষ ধরনের বলবিয়ারিংয়ের সংযোজন- ভিত্তিমূলের নিচে।
ভূমিকম্প সম্পর্কে জাপানিদের এই সচেতনতা ঘটে কোবে ভূমিকম্পের পর। গ্রেট হানসিন বা কোবে ভূমিকম্পের আঘাতে শিল্প ও বন্দর নগরী কোবে ও পার্শ্ববর্তী হিয়াগো প্রিফেকচারের (জেলা) বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ১৯৯৫ সালের ১৭ জানুয়ারি (মঙ্গলবার)।
এই ভূকম্পন আঘাত হানে ভোর ৫টা ৪৬ মিনিটে। ২০ সেকেন্ড স্থায়ী রিখটার স্কেলে ৬.৮ মাত্রার এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ হারান ছয় হাজার ৪৩৪ জন, যার মধ্যে কোবে নগরীতেই মৃতের সংখ্যা চার হাজার ৬০০। তখন পর্যন্ত জাপানিরা ভূমিকম্পের ব্যাপারে তেমন সচেতন ছিলেন না। দুর্যোগ বা তোহ্কুপ্রবণ জাপান ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলাতে করণীয় সব কিছু পালন করে পরবর্তী সময়ে দালানকোঠা, বিশাল স্থাপনা, কলকারখানা, বাসস্থান তৈরি করার কাজটি করে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে। গগনচুম্বি অট্টালিকাও আজ ভূমিকম্পের কাঁপন সহ্য করে বিস্ময়কর নিপুণতার সঙ্গে। জাপানের ভূমিকম্পের তালিকায় সবচেয়ে ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পটি আঘাত হানে ১৯২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর। কান্তো তোহ্কু নামে পরিচিত সেই ভূমিকম্পের আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় জাপানের প্রাচীন রাজধানী, জ্ঞানচর্চার নগরী হিসেবে পরিচিত কিয়োটো নগরীসহ মূল দ্বীপ হনসুর বিশাল এলাকা। সর্বসাম্প্রতিক ভূমিকম্পের আগে এটিই ছিল জাপানের সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প।
জাপানিরা তোহ্কু অঞ্চল বা ভূমিকম্প অঞ্চল হিসেবে দেশটির বিভিন্ন এলাকাকে চিহ্নিত করেন এবং সেই হিসেবে ভূমিকম্পের পৌনঃপুনিক হানার বিরুদ্ধে তাদের প্রস্তুতিকে করেন যতোটা সম্ভব কার্যকর। একটা ছোট্ট উদাহরণ: জাপানের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের চেয়ারের পেছন দিকে মাথা হেলান দেওয়ার জায়গায় রাখা আছে রাবার ফোম এবং প্যাডের তৈরি এক রকম হেড রেস্ট। 'মোসাই জুকিন' নামক এই রাবার প্যাডটিই ভূমিকম্পের সময় শিশু থেকে বয়স্ক শিক্ষার্থীরা মাথায় টুপির মতো করে তা পরে নেয়। এমনি প্রশিক্ষণ দেওয়া আছে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে। আর কী শৃঙ্খলাবদ্ধভাবেই না ছাত্রছাত্রীরা সারি বেঁধে উন্মুক্ত আকাশের নিচে মাঠে বসে পড়ে মাথা নিচু করে!
ভূমিকম্পের ব্যাপারে জাপানিরা সতর্ক, কিন্তু সুনামির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা তো গ্রহণ করা সম্ভব নয় এর প্রচণ্ডতা এবং অপ্রত্যাশিত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের তীব্রতার কারণে। সুনামির নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে পারেন জাপানিরা। যেমন পেরেছিলেন ২০১১ সালেও। কিন্তু এর ভয়াবহতার মুখে মানুষ যে কতো অসহায়, তা আবারও প্রমাণিত হলো। ২০১১ সালের মার্চ মাসের ভূমিকম্পে জাপানের ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত তোহ্কু অঞ্চল, যার মধ্যে রয়েছে হনসু দ্বীপের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছয়টি প্রিফেকচার- আকিতা, আওমোরি, ফুকুশিমা, ইয়োতে, মিয়াগি ও ইমাগাত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ফ্রিফেকচারটির নাম ফুকুশিমা যা বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল এর পারমাণবিক স্থাপনা- ফুকুশিমা দাইচি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের বৈকল্য এবং তেজস্ক্রিয়তার বিকিরণ।
ভূমিকম্পের কারণে সহায় সম্পদ, জানমালের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা কখনো যাবে না। যাঁরা জীবন দিয়ে ভূমিকম্প ও সুনামিকে প্রত্যক্ষ করেছেন, মার্চের সেই ভয়াল মধ্য দুপুরে, জাপানের জনগণ তাঁদের স্মরণ করেছেন বছর ঘুরে আসা সেই দিনটিতে, ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক ২টা ৪৬ মিনিট। এক মিনিট নীরবে কাটিয়েছেন প্রার্থনায় আনত মস্তকে। প্রায় ১৯ হাজার মৃত অথবা নিখোঁজ মানুষের কল্যাণ কামনায় সমবেত জাপানিরা বাকরুদ্ধ থেকেছেন। জাপানের শোকসভা কিম্বা স্মরণসভায় দেখেছি কোনো বাহুল্য ভাষণ থাকে না। মিতভাষী জাপানিরা হিরোশিমা-নাগাসাকি দিবসে যেমন সমবেত হন সংক্ষিপ্ত স্মরণ অনুষ্ঠানে, এবারও তেমনটাই করেছেন। সৈকতে সমবেত নর-নারী তাঁদের হারানো কিংবা নিহত প্রিয়জনের মঙ্গল কামনা করে নীরব প্রার্থনা শেষে ফুল ভাসিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রের পানিতে। নীরব স্মৃতি তর্পণকারী মানুষেরাই শুধু এবার বার্ষিকী পালনে উপস্থিত ছিলেন না, ছিলেন একদল প্রতিবাদী মানুষও। সংখ্যায় তাঁরাও কম নন। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়েছেন পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে। ভূমিকম্প-সুনামির ধ্বংসযজ্ঞকে অসহনীয়, বিপজ্জনক এবং প্রাণসংহারি করে তোলে যে স্থাপনাটি, তার নাম ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক পাওয়ার কমপ্লেক্স। দাইচি, জাপানি এই শব্দের অর্থ এক নম্বর। এক নম্বর হিসেবেই এটি তৈরি করেছিল টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি (টেপকো)। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জেনারেল ইলেকট্রিক, জাপানের তোশিবা, হিটাচি প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ কারিগরি জ্ঞানে নির্মিত ফুকুশিমা দাইচি প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে ১৯৭১ সালে।
বিশ্বের অন্যতম সেরা শিল্পোন্নত দেশটির এনার্জির চাহিদা মেটানোর জন্য স্থাপিত ফুকুশিমা দাইচি নিউক্লিয়ার কমপ্লেক্সটি ফুকুশিমা ফ্রিফেকচারের ওকুমা ও ফুতাবা- এই দুই শহরের ৮৬০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে। ছয়টি বয়েলিং ওয়াটার রিঅ্যাক্টর নিয়ে এটি প্রথম চালু করা হয়। ফুকুশিমা পৃথিবীর ১৫টি বৃহৎ পারমাণবিক কেন্দ্রের একটি। যতোটা সম্ভব দুর্যোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এর নির্মাণ কাজে। কিন্তু এমনই ভয়াবহ ছিল মার্চের সেই দুর্যোগ, ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্রের প্রতিটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ইউনিট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পারমাণবিক কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়ে যতোটা সম্ভব ড্যামেজ কন্ট্রোলের ব্যবস্থা করা হলো। পারমাণবিক চুলি্ল বন্ধ করে তা শীতল করার কাজে নিয়োজিত হলেন একদল বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক, যাঁরা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পারমাণবিক কেন্দ্র বন্ধ কিংবা মাটিচাপা দেওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে এমনি আত্মঘাতী একদল মানুষকে যারা ইতিহাসে 'কামিকাজে' আত্মাহুতিদানকারী বৈমানিক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। আর এবার দেখা গেল একদল আত্মত্যাগী অগি্ননির্বাপক স্বেচ্ছাসেবক- যাদের কথা স্মরণসভায় বিশেষ করে উল্লেখ করলেন সম্রাট আকিহিতো। টোকিও নগরীতে আয়োজিত স্মরণসভায় এক হাজার দই শ লোকের উপস্থিতিতে সম্মানিত অতিথি হিসেবে সম্রাট আকিহিতোর উপস্থিতি এবং সংক্ষিপ্ত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন সাধারণ কোনো ঘটনা ছিল না। মাত্র তিন সপ্তাহ আগে হার্ট বাইপাস অপারেশনের পর টোকিওর চিয়োদা রাজকীয় এলাকায় অবস্থিত টোকিও রাজপ্রাসাদে ডাক্তারের উপদেশে পূর্ণ বিশ্রামে থাকা সম্রাট ক্লান্তকণ্ঠে যখন মৃতদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন, তখন উপস্থিত অতিথিদের অনেকের চোখই ছিল অশ্রুসজল।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর বিশ্বের বহু উন্নত দেশ নির্ভরশীল। ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক কেন্দ্রের বিপর্যয়ের পর টনক নড়ে সারা পৃথিবীর। ২০১১ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পৃথিবীর ৩০টি দেশে ৪৩৮টি পারমাণবিক চুলি্ল চালু আছে। ১৬৪টি রিঅ্যাক্টর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পারমাণবিক শক্তির চাহিদা মেটায়। জার্মানি সতর্কতা হিসেবে তাদের সাতটি পুরনো পারমাণবিক চুলি্ল সাময়িকভাবে বন্ধ করে রেখেছে। ফ্রান্সের বিদ্যুৎ চাহিদার ৮০ ভাগ আসে পারমাণবিক শক্তি থেকে। তাদের চুলি্লর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে এখন তারা অনেক সতর্ক।
উত্তর আমেরিকা আর এশিয়ার জ্বালানির যথাক্রমে শতকরা ৩০.৬ এবং ২৮.৯ অংশ আসে পারমাণবিক শক্তি থেকে। বিশ্ব এখন সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে পারমাণবিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল এবং বিশ্বের নিরাপত্তার হুমকিও এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। জাপানের দুর্যোগের আলোকে এ বিষয়ে বারান্তরে আরো লেখার ইচ্ছা রইল।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

No comments

Powered by Blogger.