সময়ের প্রতিধ্বনি-বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং রাজনীতির লো-ভোল্টেজ by মোস্তফা কামাল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য দিয়েই শুরু করছি। তিনি বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, 'মাঝেমধ্যে লোডশেডিং হওয়া ভালো। তা না হলে অতীতে যে লোডশেডিং ছিল তা মানুষ বুঝবে কী করে।'প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য আমরা মেনে নিতে পারতাম, যদি মাঝেমধ্যে লোডশেডিং হতো।


উন্নত দেশেও বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে লোডশেডিং হয়। এটা দোষের নয়। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই যে দেশে বিদ্যুৎ থাকে না, সে দেশের প্রধানমন্ত্রী কী করে বলেন মাঝেমধ্যে লোডশেডিং হওয়া ভালো! সরকারি হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দেশে চাহিদার তুলনায় প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয়। ৩১ মার্চ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে চার হাজার ৯৭৯ মেগাওয়াট। চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ৮৯৯ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল ৯২০ মেগাওয়াট। বেসরকারি হিসাবে অবশ্য ঘাটতির পরিমাণ দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বলে দাবি করা হচ্ছে। নিশ্চয়ই এই দাবির মধ্যে যুক্তি রয়েছে বলে মনে করি। কারণ এখন আমরা প্রতিদিনই বিদ্যুৎ সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছি।
এবার গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকেই সারা দেশে বিদ্যুৎ সংকট মারাত্মকভাবে দেখা দেয়। গ্রীষ্মের শুরুতে দুই হাজার ২০০ মেগাওয়াট ঘাটতি নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। আর এই সংকট মোকাবিলায় মানুষের ওপর লোডশেডিং নামক যন্ত্রণা চাপিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, সেচব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে শহরের বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া হয়েছে গ্রামে। বিদ্যুৎ দিয়ে তো আর পেট চলবে না! দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে ধান উৎপাদন বাড়াতে হবে। সে জন্য নগরবাসীকে আপাতত লোডশেডিং উপহার দেওয়া হলো। সেচ মৌসুম শেষ হলেই নগরবাসীকে স্বস্তি ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
সরকারের এই বক্তব্যও যে সঠিক নয়, তার চিত্র দেখা গেল পত্রিকার রিপোর্টে। কালের কণ্ঠসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে রিপোর্ট বেরিয়েছে, বিদ্যুতের অভাবে চাষাবাদও লাটে ওঠার দশা হয়েছে। কৃষকরা বলছেন, অতি প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ অতিমাত্রায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় বিদ্যুতের অপেক্ষায়। দেশের কোথাও কোথাও দিন-রাত মিলিয়ে বিদ্যুতের দেখা মিলছে হাতেগোনা কয়েক ঘণ্টা (কালের কণ্ঠ, ২ এপ্রিল ২০১২)।
বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশের ৯ লাখ পরীক্ষার্থীও পড়েছে মহাসংকটে। গত ১ এপ্রিল থেকে সারা দেশে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলের ওপর তাদের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কাজেই তাদের শিক্ষা জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় এখন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারছে না। বিদ্যুৎ থাকবে না বলে তো আর পরীক্ষা বন্ধ রাখা যাবে না! তাই তারা কুপি, হেরিকেন, মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করছে।
বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বাসাবাড়িতে কিংবা সেচ কাজই যে ব্যাহত হচ্ছে তা নয়, কল-কারখানায় উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শহরকেন্দ্রিক বাজারগুলোতে সময় বেঁধে দিয়ে বিদ্যুৎ দেওয়ার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আবাসন শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে।
এর আগে বেশ কয়েক মাস বাসাবাড়ি ও শিল্প কারখানায় বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়াই বন্ধ ছিল। এ কারণে নতুন শিল্পকারখানা তেমন গড়ে ওঠেনি। আবাসন শিল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার দেশীয় বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধের অন্যতম কারণ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারা। বিদেশি বিনিয়োগ না হলে দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল থাকে না- এটা সবাই উপলব্ধি করেন। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে দেশের উন্নয়নের কথা ভাবেন না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে দেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তারা কিছু উদ্যোগও নিয়েছিল। কিন্তু পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দল অবশ্য এ কথা মানতে রাজি নয়। তারা বলছে, তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে। আসলে এক হাজার ১০০ থেকে সর্বোচ্চ দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে বর্তমান সরকারের আমলে।
বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করতে সরকার বাসাবাড়ি ও শিল্প কারখানায় নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রেখেছিল। এখন কিছু কিছু সংযোগ দেওয়া হলেও বিদ্যুৎ দিতে পারছে না। অথচ গত ১৩ মাসে সরকার চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এ ধরনের দায়িত্বহীন সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য বুমেরাং হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। আর সেই অজুহাতে বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এসব কারণে সরকারের ওপর মানুষ ভীষণ বিরক্ত এবং বিক্ষুব্ধও। মানুষের সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, খোদ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। অনেক জেলা-উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বাড়িছাড়া হয়েছেন। বিক্ষুব্ধ মানুষ তাঁদের ধাওয়া করছেন। এক বছর আগেও যেসব নেতা-কর্মী গ্রামাঞ্চলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তাঁরাই এখন তাড়া খেয়ে এলাকা ছাড়ছেন। এর পরও কি প্রধানমন্ত্রী বলবেন, মিডিয়া সত্য-মিথ্যা, যা খুশি তা লিখছে?
লো-ভোল্টেজের রাজনীতি : হঠাৎ করেই রাজনীতিতে যেন লো-ভোল্টেজ শুরু হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ঢাকায় একটি মহাসমাবেশ করে যেন তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। তারা ভাবছে, সরকারের পতন ঘটাতে এখন আর আন্দোলন লাগবে না। এমনিতেই সরকার পড়ে যাবে। কাজেই আগামীতে অনায়াসে ক্ষমতায় যাবে বিএনপি। অথচ বিগত তিন বছর বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কোনো দায়িত্বই পালন করেনি। দেশ ও মানুষের স্বার্থে কোনো অবস্থান নেয়নি। তিন বছরই সংসদ ছিল অকার্যকর। তারা সরকারকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য মাঠ গরম করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।
বর্তমান সরকারের তিন বছরের প্রথমদিকে বিএনপি পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। তারপর তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করেছে। কিন্তু নিজেরা এই ব্যবস্থা নিয়ে সংসদ বা সংসদের বাইরে কোনো প্রস্তাব দেয়নি। জনগণের সমস্যাগুলো নিয়েও বিএনপির জোরালো কোনো অবস্থান ছিল না। এখন যে বিদ্যুৎ সংকট চলছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত; এসব বিষয়েও বিএনপি তেমন কোনো কথা বলছে না। এসব ইস্যুতে কি ক্ষমতাসীন এবং প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়েছে! তা না হলে বিএনপির এই নীরবতার কারণ কী! নাকি তারা ভাবছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও আর বহাল হবে না, তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার আশাও দুরাশায় পরিণত হবে! সেই হতাশা থেকেই কি কিছুটা ঝিমিয়ে পড়া!
তবে এমন সমঝোতাও হতে পারে, আওয়ামী লীগকে এখন বিএনপি ঘাটাবে না। বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও আওয়ামী লীগ একই কাজ করবে। অর্থাৎ দুই বড় দল মিলেমিশে দেশটাকে লুটেপুটে খাবে। আর তাতে জনগণের যদি বারোটা বাজে, কার কী আসে-যায়!
এদিকে তৃতীয় বৃহত্তর রাজনৈতিক দল এবং মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, আগামীতে নির্বাচন হবে কি না সন্দেহ। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে গরম গরম কথা বলেছেন। দেশে গণতন্ত্র নেই, সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগ ব্যর্থ, তিনি জোটে থাকবেন না, এককভাবে নির্বাচন করবেন ইত্যাদি ধরনের কথা এখনো মানুষ ভুলে যায়নি।
মানুষ এও ভুলে যায়নি যে এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হিসেবে সৌদি আরব, ভারতসহ কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। মহাজোট সরকারের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। হঠাৎ করেই তিনি আবার সরকারের কঠোর সমালোচক বনে গেলেন! তাঁর মুখে বেশি বেশি গণতন্ত্রের কথা শোনা যাচ্ছিল! এই কদিনের মধ্যে কী এমন ঘটল যে তিনি রাজনীতি নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেন! এককভাবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে যিনি আগেভাগেই মাঠে নামলেন, তাঁর মুখে হতাশার সুর! তা হলে কী রাজনীতি নিয়ে অন্য কোনো খেলা শুরু হয়েছে!

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.