কলকাতার চিঠি-গণতন্ত্রের ঘরে ‘স্বৈরতন্ত্রে’র ছায়া by অমর সাহা

ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ১০ মাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এভাবে বদলে যাবেন, তা কেউ ভাবেনি। বরাবরই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মমতাকে দেখেছে গণতন্ত্রের পূজারি হিসেবে, সাধারণ মানুষের বন্ধু হিসেবে, সবার দিদি হিসেবে। সেই মমতা আর এখন নেই সেই মমতায়।


বদলে গেছেন। যে মমতার উত্থান হয়েছে এই রাজ্যে বামবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে; মানুষের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ধর্মঘট, সভা-সমিতি করে; হরতাল, অবস্থান ধর্মঘট করে; সেই মমতা আজ ভুলে গেছেন অতীতের সব আন্দোলনের কথা। হয়ে উঠেছেন ধর্মঘটবিরোধী এক নেত্রী হিসেবে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, ধর্মঘট মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও সেই অধিকার আজ কেড়ে নিয়েছেন মমতা। এই তো গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের ১১টি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনের ডাকে দেশব্যাপী পালিত হওয়া সাধারণ শিল্প ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের এক দিনের বেতন কাটা শুরু করেছেন। এই তালিকায় রয়েছেন ২০ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে এখানকার ধর্মঘটী কর্মচারীদের কমিয়ে দিয়েছেন চাকরির এক দিনের বয়সও। এ নিয়ে সরকারি কর্মচারীরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছেন।
এদিকে, সর্বশেষ যে ঘটনা ঘটিয়ে মমতা আবার গোটা রাজ্যে বিতর্কের মুখে পড়েছেন, তা হলো তাঁরই জনশিক্ষা ও গ্রন্থাগারমন্ত্রী আ. করিম চৌধুরীর দপ্তরের একটি নির্দেশিকা। গত সোমবার ওই নির্দেশিকা জারি করে বলা হয়, এখন থেকে সরকারের তালিকাভুক্ত আটটি দৈনিক সংবাদপত্রই পশ্চিমবঙ্গের সরকারি এবং সরকারি আনুকূল্যে পরিচালিত গ্রন্থাগারে রাখা যাবে। এই আটটি পত্রিকার তালিকায় রয়েছে পাঁচটি বাংলা, দুটি উর্দু ও একটি হিন্দি দৈনিক। তবে এই তালিকায় নেই ইংরেজি কোনো পত্রিকা। শুধু কি তাই! কলকাতার সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, ইংরেজি দৈনিক টেলিগ্রাফ, টাইমস অব ইন্ডিয়াও নেই! আছে সরকার-সমর্থিত আটটি পত্রিকা, যার প্রচারসংখ্যা নিতান্তই কম। এর মধ্যে আবার রয়েছে দুটি বাংলা পত্রিকা, যা সামপ্রতিক কালে প্রকাশিত।
সরকারি তালিকাভুক্ত এই আটটি বাংলা পত্রিকার মধ্যে রয়েছে সংবাদ প্রতিদিন, সকালবেলা, একদিন, ৩৬৫ দিন ও বাংলা স্টেটসম্যান। উর্দু পত্রিকার মধ্যে রয়েছে আকবর-ই-মশরিক ও আজাদ হিন্দ আর হিন্দি দৈনিকের মধ্যে রয়েছে সন্মার্গ। আবার এই পত্রিকার মধ্যে সংবাদ প্রতিদিন-এর সম্পাদক ও সহযোগী সম্পাদক দুজনেই তৃণমূলের টিকিটে এবার ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য (এমপি) হয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, একইভাবে সন্মার্গ ও আকবর-ই-মশরিক-এর দুই সাংবাদিককেও সমপ্রতি রাজ্যসভার সদস্য বা এমপি করা হয়েছে তৃণমূলের টিকিটে। একইভাবে সংবাদ প্রতিদিন-এর সহযোগী সম্পাদক আবার এই আটটি কাগজের মধ্যে তিনটি কাগজেরই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, এখন আনন্দবাজার পত্রিকা বাংলা দৈনিক হিসেবে ভারতে শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে। কলকাতায় দ্বিতীয় বহুল প্রচারিত পত্রিকা হচ্ছে বর্তমান। এই দুটি পত্রিকাই গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতার পাশে দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পাঠাগারে এখনো বহু ইংরেজি পত্রিকার পাঠক থাকলেও ইংরেজি পত্রিকাকে বাদ দেওয়া হয়েছে নতুন তালিকা থেকে। যদিও এই ঘোষণার দুই দিন পর আরও পাঁচটি পত্রিকাকে তালিকাভুক্ত করে সরকার। কিন্তু তাতেও ঠাঁই দেওয়া হয় না আনন্দবাজার পত্রিকা, টেলিগ্রাফ ও বর্তমানকে। কারণ হিসেবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মমতাকে সমালোচনা করায় এসব ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকাকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে আড়াই হাজারের বেশি সরকারি এবং সরকার পরিচালিত গ্রন্থাগার। হঠাৎ করে এই নির্দেশিকা জারি হওয়ার পর বিপাকে পড়েছেন গ্রন্থাগারের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, বিগত ৩৪ বছরের বামফ্রন্টের আমলেও এ ধরনের কোনো লিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়নি পশ্চিমবঙ্গের সরকারের পক্ষ থেকে। অথচ এবারই ঘটল ব্যতিক্রম। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরাও মনে করছেন, এটা মুক্তচিন্তার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার নতুন এক অস্ত্র। অথচ কী আশ্চর্য! আটটি সংবাদপত্র রাখার সরকারি নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ‘পাঠকদের মধ্যে মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটানোর স্বার্থে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের মদদে প্রকাশিত কোনো সংবাদপত্র সরকারি অর্থে কেনা হবে না।’ যদিও এখন বিভিন্ন গ্রন্থাগারের পাঠকেরা দাবি তুলেছেন কলকাতার জনপ্রিয় কাগজ রাখার। শুরুও করেছেন পাঠক-পাঠিকারা সই সংগ্রহ অভিযান।
সরকারি নির্দেশিকা সোমবার জারির পর মঙ্গলবারই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বামপন্থী বিধায়কেরা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে অধিবেশন বর্জন করেন। শুধু কি তাই? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিনটি জেলা পরিষদ তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণে না থাকায় তা-ও ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিবাদে বুধবার বিধানসভায় হইচই হয়েছে। বিরোধী বামপন্থীরা অধিবেশন বর্জন করেছেন।
সংবাদপত্রের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন কলকাতার বুদ্ধিজীবী থেকে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকেরাও। প্রতিবাদ করেছেন তৃণমূলের শরিক জাতীয় কংগ্রেসের নেতারাও। প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন, এটা একনায়কতন্ত্র। এটা হতে পারে না। সব মানুষের সব কাগজ পড়ার অধিকার আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর এ এক বড় হস্তক্ষেপ। এটা মেনে নেওয়া যায় না। এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা উচিত। কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত একটা মূর্খতার প্রকাশ। এটা চলতে দেওয়া হলে এই রাজ্যে অমঙ্গল ঘটবে। প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন বলেছেন, এই নির্দেশিকা হাস্যকর, নিন্দনীয় ও বর্জনীয়। প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী কবীর সুমন বলেছেন, সমালোচনা করলেই আঘাত, এটা মানা যায় না। সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত ভুল। সব মতকে সম্মান করাটাই তো গণতন্ত্র। প্রবীণ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত বলেছেন, মানা যায় না। মানুষই শেষ কথা বলবে। মানুষের মুখ বন্ধ করা যায় না। বিশিষ্ট চিত্রকর শুভাপ্রসন্ন বলেছেন, এটা ঠিক হয়নি। সবারই সব ধরনের মত জানার অধিকার আছে। এদিকে কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, পাঠকের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। পিডিএস, এসইউসিআই সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে।
তবে এত কিছুর মধ্যেও জনশিক্ষা ও গ্রন্থাগারমন্ত্রী আ. করিম চৌধুরী বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে কথা বলে জানিয়ে দেন, সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার কোনো প্রশ্ন নেই। সরকারি নীতি মেনেই এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.