সাক্ষাৎকার-সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখব by জয়নুল আবেদীন

সাক্ষাৎকার গ্রহণ :ওয়াকিল আহমেদ হিরন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সভাপতি ও সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জয়নুল আবেদীন এবং মোমতাজউদ্দিন আহমদ মেহেদী। প্রথমজন বিএনপির এবং দ্বিতীয়জন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। উভয়েই আইনজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণে দীর্ঘদিন কাজ করে চলেছেন।


সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তারা বার ও বেঞ্চের সম্পর্ক এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন

সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনের আগে আমি ওয়াদা করেছিলাম, রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করবেন মাঠে-ময়দানে। সেটা হবে আদালতের বাইরে। সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে কোনো রাজনীতি নয়। এটা দূর করার জন্য বারের সাবেক সভাপতি-সম্পাদকসহ যারা নেতৃবৃন্দ আছেন, তাদের সঙ্গে কমিটির মতবিনিময়ের ব্যবস্থা করব। নিশ্চয়ই সেখান থেকে ভালো কিছু বের হয়ে আসবে। আমি মনে করি, রাজনৈতিক বক্তব্য রাজনীতির অঙ্গনে থাকাই উত্তম। এসব আদালতে টেনে আনা ঠিক নয়

সমকাল : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এ মর্যাদার প্রতিষ্ঠানের জন্য আপনার পরিকল্পনা জানতে চাই।
জয়নুল আবেদীন : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। আগামী ৮ এপ্রিল দায়িত্ব বুঝে নেব। দায়িত্ব গ্রহণের পর কমিটির সব সদস্যকে নিয়ে বসব। বারকে নিয়ে সম্পাদক এবং অন্যদের কী চিন্তা-ভাবনা আছে এগুলো সমন্বয় করে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।
সমকাল : আইনজীবীদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন নিরসনে কোনো উদ্যোগ আছে কি?
জয়নুল আবেদীন : সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনের আগে আমি ওয়াদা করেছিলাম, রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করবেন মাঠে-ময়দানে। সেটা হবে আদালতের বাইরে। সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে কোনো রাজনীতি নয়। এটা দূর করার জন্য বারের সাবেক সভাপতি-সম্পাদকসহ যারা নেতৃবৃন্দ আছেন, তাদের সঙ্গে কমিটির মতবিনিময়ের ব্যবস্থা করব। নিশ্চয়ই সেখান থেকে ভালো কিছু বের হয়ে আসবে। আমি মনে করি, রাজনৈতিক বক্তব্য রাজনীতির অঙ্গনে থাকাই উত্তম। এসব আদালতে টেনে আনা ঠিক নয়।
সমকাল : বার ও বেঞ্চের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে আপনার ভূমিকা কী হবে?
জয়নুল আবেদীন :বিচারপ্রার্থীরা সবসময় বার ও বেঞ্চের মধ্যে সম্পর্ক ভালো কামনা করেন। বার ও বেঞ্চের মধ্যে সম্পর্ক মধুর না হলে বিচারপ্রার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ন্যায়বিচার প্রার্থনার এটাই সর্বোচ্চ ফোরাম। সব শ্রেণী-পেশার মানুষের বিচার চাওয়ার অধিকার আছে। বিশেষ করে এই আদালতটি সাংবিধানিকভাবে পরিচালিত। একটা দেশের সংবিধান হচ্ছে 'হার্ট অব দ্য কান্ট্রি'। সেই হার্ট যেন ভালোভাবে কাজ করতে পারে সে দায়িত্ব এ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের। সে কারণেই বার ও বেঞ্চের মধ্যে সম্পর্কটা ভালো হওয়া দরকার। তার মতে, কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমানে এ সম্পর্কে কিছুটা চিড় ধরেছে। আশা করছি, আগামীতে এটা থাকবে না। আমি ১৯৯৭ সালে যখন আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ছিলাম তখনও বার ও বেঞ্চের মধ্যে একটা চিড় লক্ষ্য করেছি। তৎকালীন সভাপতি ও আমি এ বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। প্রধান বিচারপতি আন্তরিক ছিলেন বার ও বেঞ্চের সুসম্পর্ক রক্ষার জন্য। তখন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে বার ও বেঞ্চের সুসম্পর্ক রক্ষার জন্য প্রধান বিচারপতির সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছিলাম এবং তাতে সুফল পেয়েছি। বিচারপতি ও আইনজীবীদের প্রতিনিধিদের মতবিনিময়ের মাধ্যমে এই সম্পর্কের উন্নয়ন করতে পেরেছিলাম।
সমকাল :বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগীদের মধ্যে কয়েকজনের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচার চলছে। এ বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
জয়নুল আবেদীন : আমাদের দেশের চলমান আইনে বিচার হলে অভিযুক্তরা ন্যায়বিচার পেত। এখন দীর্ঘ ৪০ বছর পর সেই পুরনো আইনকে রংতালি দিয়ে সরকার কী বিচার করবে, আইনজীবী হিসেবে নয়_ সাধারণ মানুষের মনে একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। এই উদ্বেগ সরকার এখনও দূর করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে এই আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা এখনও আসেনি। আদালতের প্রতি আগে মানুষের আস্থা আনতে হবে, এরপর আদালতের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
সমকাল : আইনজীবীদের স্বার্থ রক্ষায় আপনার পরিকল্পনা কী?
জয়নুল আবেদীন : আইনজীবীদের প্রথম পরিচয় তারা জনগণের সেবক। সেবার ব্রত নিয়ে প্রত্যেকের এই পেশায় আসা উচিত। অর্থ উপার্জনের ব্রত নিয়ে সবার আসা উচিত নয়। যেমন, আমি ব্যক্তিগতভাবে এই পেশায় প্রথমে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করি এবং আইনজীবীদের সঙ্গে সুন্দর ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলি। সে কারণে আমি এর আগে বারের সহ-সম্পাদক ও সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। আইনজীবীরা তাদের মূল্যবান ভোট দিয়ে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট বারে অত্যাধুনিক অডিটোরিয়াম, আইনজীবীদের জন্য একটি ক্লাব, আইনজীবীদের সন্তানদের জন্য ক্লাব করার ইচ্ছা আছে।
সমকাল : দেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
জয়নুল আবেদীন : এখন যে বিচার ব্যবস্থা আছে তা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে আগে বিচার বিভাগকে প্রভাবমুক্ত করতে হবে। কিছু দিন ধরে দেখছি রাজনৈতিক চাপ বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করছে। চেষ্টা করব এতে পরিবর্তন আনতে। কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনতে পারব বলে আশাবাদী আমি।
সমকাল : আদালতের বিভিন্ন আদেশ ও রায় নিয়ে অনেক কথা হয়। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
জয়নুল আবেদীন : সংবিধানে তাদের আকাশচুম্বী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কোনো গাড়ি যদি আড়াইশ' কিলোমিটার গতিতে চলে তাহলে কি তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? ক্ষমতা যার যতটুকু থাকুক না কেন, সবাইকে সহনীয় পর্যায়ে থাকা উচিত।
সমকাল : উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ নিয়ে একাধিকবার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে_ আপনার মন্তব্য কী?
জয়নুল আবেদীন : বর্তমান আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যখন বারের সভাপতি ছিলেন, তখন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বারের একটা বৈঠক হয়েছিল। সেখানে বারের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কতগুলো সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল। সেগুলো আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, অতীতে সব সরকারের সময়ে বিচারক নিয়োগ নিয়ে কমবেশি বিতর্ক হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে_ সুষ্ঠু নিয়ম ও পদ্ধতিগতভাবে যেন উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ হয়। বিচারক নিয়োগ নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে আর কোনো বিতর্ক শুনতে চাই না।
সমকাল : নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হওয়ার পর বিচার বিভাগ কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছে?
জয়নুল আবেদীন : বিচারপতিদের ওপর কোনো রাজনৈতিক প্রভাব যেন না পড়ে সে ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট থাকব। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে যদি কোনো বিচারপতি বিচার কাজে প্রভাবিত হন তাহলে সাধারণ মানুষ বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। এ অবস্থা যেন কোনোভাবেই সৃষ্টি না হয় সে জন্য প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ করব এবং তাকে আমরা অনুরোধ করব তিনি যেন বিচার কাজ পরিচালনায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকেন। আমরা যদি এভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি তাহলে এই অঙ্গনকে আমরা রাজনীতিমুক্ত করতে সক্ষম হবো।
সমকাল : রাজনীতিতে আপনার কোনো চাওয়া-পাওয়া আছে কি?
জয়নুল আবেদীন : ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি শুরু করেছি। মওলানা হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তবে জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম দেখেছি অতুলনীয়। আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আইনজীবীদের মূল্যবান ভোটে বারের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। এ জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে লাখো শুকরিয়া।

No comments

Powered by Blogger.