নির্যাতিত নারীর ডাক্তারি পরীক্ষা-সুশাসন by নূরুননবী শান্ত

দিনাজপুরের বোঁচাগঞ্জ উপজেলার ফজিলা খাতুনের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মা ও রোগাক্রান্ত বাবা ভিক্ষার অন্নের ওপর নির্ভরশীল। তাদের প্রতিবেশী গরু ব্যবসায়ী খলিলের ছেলে সাইদুরের বয়স ২২। সাইদুর সচ্ছল পরিবারের হলেও লেখাপড়ায় অষ্টম শ্রেণী পেরোতে পারেনি। অন্যদিকে হতদরিদ্র পরিবারের ১৩ বছরের শিশু ফজিলা খাতুনের কোনোদিন স্কুলেই যাওয়া হয়নি। গত ২৭ জুলাই সন্ধ্যায় ফজিলা টেলিভিশন দেখার জন্য এক প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়েছিল।
সেখান থেকেই সাইদুর ফজিলাকে নানা লোভ দেখিয়ে ফসলের মাঠের দিকে ডেকে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করে। ফজিলার চিৎকার শুনে ওর ফুপাতো ভাই জলিল ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে এবং চিনতে পারে সাইদুরকেও। সঙ্গে সঙ্গেই ফজিলাকে নিয়ে জলিল থানায় যায় অভিযোগ করতে। থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর কথা বলেন; কিন্তু উপজেলা হাসপাতালে নয়, ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে দিনাজপুর জেলা সদরে। সেদিন রাত হয়ে যাওয়ায় তাদের পক্ষে দিনাজপুর যাওয়া সম্ভব হয়নি। পরদিন তারা যখন দিনাজপুর গিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে সক্ষম হয়, ততক্ষণে ধর্ষণের আলামত মুছে গেছে। অবশ্য নির্যাতনের শিকার ফজিলা ও তার পরিবারের লোকজন ডাক্তারি পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট সম্পর্কে বোঁচাগঞ্জ থানার মাধ্যমে জানতে পারে ঘটনার ২ সপ্তাহ পর। এরপর আইনের মাধ্যমে এ সহিংসতার প্রতিকার পাওয়ার আর কোনো পথ খোলা থাকে না। একই সঙ্গে গরিব এ পরিবারটি একটি সচ্ছল পরিবারের অষ্টম শ্রেণী পাস যুবকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে যাওয়ার ধৃষ্টতা দেখানোয় সামাজিকভাবে তিরস্কৃত হয়!
পঞ্চগড় জেলার হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের টেলিপাড় গ্রামের দিনমজুর মা-বাবার ৮ বছরের মেয়ে সুমি ২০১১ সালেও স্কুলে যাওয়াার সুযোগ পায়নি। অভাব আর অন্ধকারের পর্দার বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে কোনো কিছু বোঝার আগেই এ মেয়েটিকেও ধর্ষণের শিকার হতে হয় গত ১০ জুন দুপুরে। খবিরুল ইসলাম নামের প্রতিবেশী সচ্ছল কৃষকের বিকৃত পাশবিকতার শিকার হয় শিশুটি। ওর ভয়ার্ত চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে এসে ধরে ফেলে খবিরুলকে। স্থানীয় যুব সংগঠন 'পরস্পর'-এর সদস্যরা পঞ্চগড় সদর থানায় এ ব্যাপারে একটি অভিযোগ দায়ের করে সেদিন বিকেলেই। থানা থেকে শিশুটির ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর জন্য পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু শেষ বিকেলে হাসপাতালে কোনো ডাক্তার ছিলেন না। পরদিন দুপুরে জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার যখন শিশুটিকে পরীক্ষা করেন ততক্ষণে ঘটনা ঘটার ২২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। যা হোক, 'পরস্পর', পুলিশ এবং স্থানীয় একটি এনজিওর দায়িত্বপূর্ণ যোগাযোগ সত্ত্বেও ২ সপ্তাহ পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট থানায় পাঠায়। রিপোর্ট পজেটিভ হলেও সেখানে পরীক্ষাকারী ডাক্তারের স্বাক্ষর, সিল কিছুই ছিল না। ফলে পুলিশ আবার সেটিকে হাসপাতালে ফেরত পাঠায় এবং ডাক্তার সিল-স্বাক্ষরসহ যখন আবার থানায় সেটি পাঠায় তখন তাতে অনেক কাটাকুটি ও অস্পষ্টতা তৈরি হয়। এ রিপোর্টটি আদালতে শিশুটির পক্ষে কতখানি কার্যকর ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার ভূমিহীন কৃষক মা-বাবার সন্তান পরেছা (১৫) সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। গত ২৪ জুন দিনমজুর আবদুল করিম (৩২) রাত ৯টায় বাড়িতে ঢুকে মেয়েটিকে একা পেয়ে ধর্ষণ করে। মা-বাবা পরের দিন রানীশংকৈল থানায় যান মামলা করতে। মামলা রুজু করতে তাদের সারাদিন লেগে যায়। থানার পরামর্শে ২৬ জুন মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা হয় পরেছাদের গ্রাম ভুরনিয়া কেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরের ঠাকুরগাঁও জেলা হাসপাতালে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের কারণে পরীক্ষাকারী ডাক্তার কোনো আলামত না পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই নেগেটিভ রিপোর্ট প্রদান করেন।
নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলে অপরাধ প্রমাণ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূূর্ণ ও কার্যকর প্রমাণ হিসেবে ডাক্তারি পরীক্ষার সনদপত্রকে বিবেচনা করা হয়। শনাক্তকৃত আলামত অভিযুক্তের কি-না তা প্রমাণ করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে। বাস্তবে নারী ও শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনসহ অন্যান্য শারীরিক নির্যাতন প্রতিকারে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষার ব্যবস্থা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সহায়ক নয়। আইন বা রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত না হওয়ার জন্যই নির্যাতিতরা ন্যায়বিচারপ্রাপ্তি থেকে একদিকে যেমন বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে অপরাধীরা উৎসাহিত বোধ করে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ২০০২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জারিকৃত পরিপত্রে (স্বাপকম/জিআই-১৯/৯৭/৯৩) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধন-২০০৩) এর ৩২ নং ধারা এবং এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০০ (সংশোধন (২০০৩)-এর ৪৩ (২) উপধারা ও এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২-এর ২৯নং ধারায় এ জাতীয় অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও ডাক্তারি পরীক্ষা সংক্রান্ত বিধান কার্যকর করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছে, 'পুলিশের রেফারেন্স ছাড়াও ধর্ষণ এবং অন্যান্য সহিংসতার শিকার কোনো নারী ও শিশু যে কোনো সরকারি স্থাপনায় কিংবা সরকার কর্তৃক এতদুদ্দেশ্যে স্বীকৃত কোনো বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্তব্যরত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তাৎক্ষণিকভাবে কর্তব্যরত চিকিৎসক (নূ্যনতম মেডিকেল অফিসার) তাকে যথানিয়মে পরীক্ষা করবেন এবং মেডিকেল সার্টিফিকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও নিকটস্থ থানায় প্রেরণ করাসহ, যাকে পরীক্ষা করবেন তাকেও ১ কপি প্রদান করবেন। চিকিৎসক ও তার ক্লিনিক্যাল সহকারীরা নির্যাতনের নারী বা শিশুকে যথাসাধ্য সেবা দেবেন।' কিন্তু উপরে উলি্লখিত সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো থেকে সহজেই অনুমেয়, এ নির্দেশনা মোটেই অনুসৃত হচ্ছে না। প্রথমত, নির্যাতনের শিকার কেউ হাসপাতালে গেলে থানার রেফারেন্স ছাড়া কর্তব্যরত ডাক্তার মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা করতে রাজি হন না। দ্বিতীয়ত, যাকে পরীক্ষা করছেন 'তাকেও' মেডিকেল সার্টিফিকেটের কপি কোনো অবস্থাতেই সরবরাহ করা হয় না। এর কোনো কারণই সুস্পষ্ট নয়। তৃতীয়ত, জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ছাড়া উপজেলা বা আর কোথাও মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা করা হয় না।
এ প্রসঙ্গে ২৪ আগস্ট রংপুরে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে রংপুরের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) বলেন, 'নির্যাতনের শিকার বা তার পরিবারে কারও হাতে মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রদান করা সম্ভব নয়।' তিনি প্রশ্ন করেন, 'ডাক্তারের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে?' অর্থাৎ নির্যাতনের শিকার ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট জেনে গেলে, তিনি ধরে নিচ্ছেন, সংশিল্গষ্ট ডাক্তার নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যাবেন। তাহলে কে বা কারা এ ক্ষেত্রে ডাক্তারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি, সেটাও স্পষ্ট হওয়া দরকার।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী প্রফেসর মোজাহেরুল হক জানান, মেডিকোলিগ্যাল দায়িত্ব পালন করতে পারেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগীয় কর্মকর্তা, জেলা হাসপাতালের আরএমও এবং মেডিকেল অফিসার ও নির্দিষ্ট কর্মকর্তা। তিনি বলেন, মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা করার যোগ্যতাসম্পন্ন ডাক্তার উপজেলা পর্যায়ে তো আছেই, এমনি অনেক ইউনিয়ন পর্যায়েও আছে। উপজেলা পর্যায়ে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষার উপকরণও আছে। সুতরাং এ জাতীয় পরীক্ষা উপজেলা হাসপাতাল থেকে করে সার্টিফিকেট দিতে আইন বাধা তো নেই-ই, বরং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে। কিন্তু নির্দেশনা কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ নেই। তবে দেশের সরকারি চিকিৎসালয়গুলোতে, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন, অন্যান্য ছুটির দিন এবং কর্মদিবসগুলোতে দুপুর ২টার পর কোনো কর্তব্যরত কালেভদ্রে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সুযোগ আছে, মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা তো দূরের কথা। গ্রাম পর্যায়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে দূরত্ব, যানবাহন, অর্থ সংকট ইত্যাদি কারণে এবং বহুদূর থেকে জেলা সদরে এসে হাসপাতালে ডাক্তার অনুপস্থিত থাকার কারণে ডাক্তারি পরীক্ষা সময়মতো কিংবা একেবারেই সম্ভব হয় না এবং স্বভাবতই নির্যাতিত ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, অপরাধ উৎসাহিত হয়। আমরা আশা করতে চাই, আইন, নীতিমালা, নির্দেশনা, অবকাঠামো ইত্যাদির সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনসহ সব ধরনের নির্যাতন বন্ধে ডাক্তার, পুলিশ সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন।

নূরুননবী শান্ত : গল্পকার ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.