বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক-রাষ্ট্র by ম. ইনামুল হক

বিশ্ব আদিবাসী দিবস' উপলক্ষে জাতীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জাতিগুলোর এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশে দেশের অনেক স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতারা অংশগ্রহণ করে তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। উলেল্গখ্য, বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিভাবক হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জাতিগুলোর মধ্যে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি জোরদার হয়ে ওঠে।
কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সব জাতিকেই 'বাঙালি' জাতি বলে ঘোষণা করে দেয়। এটা সবারই জানা কথা যে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন একইভাবে সবাইকে 'বাঙালি' বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন চাকমা জাতির নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তার জাতিসত্তার স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। পার্বত্য জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা গত ১০ আগস্ট ঢাকার এক সভায় সেই আগের অবস্থার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে উলেল্গখ করেছেন।
'মানুষের জন্য' এবং 'ক্যাপেং' নামের দুটি ফাউন্ডেশন একটি যৌথ গবেষণা পুস্তিকায় বলে, বাংলাদেশে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও প্রায় ৫৪টির অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করছে। ১৯৯১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এদের সংখ্যা ১২ লাখ ৫ হাজার ৯৭৮, যা সঠিক জনগণনায় ২৫ লাখের বেশি বা মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ হবে বলে অনেকে বলেন। তবে বাংলাদেশের অনেক সংখ্যালঘু জাতিরই ইতিহাস এক হাজার বছর আগে বাংলাদেশের ভূমিতে নেই। এমনকি আজ থেকে দু'হাজার বছর আগে বাংলার ভূখণ্ডে প্রকৃত কোন জাতির বাস ছিল তাও স্পষ্ট করে বলা যায় না। বাংলার ভূখণ্ডে বিগত ৩০০০ থেকে ২০০০ বছর পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে আর্য জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটে। তখন বাংলার দক্ষিণবঙ্গ ছিল সমুদ্রের নিচে, সাগর গিয়ে ঠেকত পশ্চিমে রাঢ়ভূমিতে, উত্তরে মেঘালয়ের পাদদেশে। তখন পশ্চিমবঙ্গ ও বরেন্দ্রভূমিতে কোল-ভীল-সাঁওতালরা, উত্তরবঙ্গে তিব্বতি-কিরাত-ভোটরা এবং পূর্ববঙ্গে চীন-তাই-বর্মীরা ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের পরিচয়ে বাস করত। বাংলার মধ্যাঞ্চল যতই সাগর থেকে জেগে উঠে উর্বর ভূমি হতে থাকে ততই পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিমের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আর্য জনগোষ্ঠীও এখানে এসে চাষবাস করে 'বাঙাল' নামের মিশ্র জাতির সৃষ্টি করে। তাদের ভাষাই পরে 'বাংলা' ভাষা নামে পরিচিত হয়।
বাংলার ইতিহাসে প্রথম বাঙালি রাজা হিসেবে চিহ্নিত হন শশাঙ্ক, যিনি ১৪১৮ বছর আগে মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। এর আগের রাজারাও বাংলার ছিলেন বটে, তবে তাদের রাজত্ব বাংলার বাইরে সমগ্র উত্তর ভারতব্যাপী বিস্তৃত ছিল এবং তাদের রাজধানী ছিল বাংলার বাইরে পাটলিপুত্রে (বর্তমান পাটনা)। এদেরই গুপ্তদের আমলে (খ্রিস্টীয় ৪ শতাব্দী থেকে ৬ শতাব্দী) বাংলার সমাজ নানা ধর্ম ও জাতির মানুষের অন্তর্বিবাহের ফলে ওলটপালট হয়ে যায়। এরপর শশাঙ্ক, তারপর একশ' বছরের মাৎস্যন্যায় ও তারপর বৌদ্ধ পাল রাজাদের আমলে বাংলার সমাজে কোনো জাতিই মিশ্রিত হতে আর বাকি থাকেনি। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে সেন রাজারা সমাজে যে উচ্চ-নীচ জাত-পাত সৃষ্টি করেন, তা ছিল রাজার প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে। ইসলামের আগমনে বৌদ্ধ চাষিরা ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত হয়। তুর্কি, আরবি, আফগান ও মোগল শাসনামলে ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি কমে যায় ও বাংলার সমাজ নানা কুসংস্কারে ছেয়ে যায়। ব্রিটিশ আমলে বাঙালিরা যখন হিন্দু ও মুসলমান জাতি হিসেবে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে রত, তখন 'বাংলা' ভাষাই কেবল তাদের এক জাতি হিসেবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
বঙ্গীয় সমতল ও এর সনি্নহিত ভূখণ্ডে ভাষাই এখন জাতীয়তার পরিচয়, যা নৃতাত্তি্বক সংজ্ঞায় সিদ্ধ হয় না। বাংলার রাজা-রাজড়াদের ইতিহাস কারোর ১৪শ' বছর বা কারোর চারশ' বছর হলেও আমাদের পূর্বপুরুষরা যে এই দেশেরই অধিবাসী ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের ভাষাভিত্তিক সব জাতির মানুষই এই মাটির সন্তান বা আদিবাসী। জাতিসংঘ সনদে আদিবাসী বলতে বোঝায় যারা কোনো দেশে অভিবাসীদের চাপে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে বা নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে বসেছে। বাংলাদেশে অভিবাসীদের চাপে নয়, নিজ দেশেরই বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর চাপে ক্ষুদ্রতর জনগোষ্ঠীগুলো হুমকির মধ্যে পড়েছে। বর্তমানে এরা সবাই বাঙালির মতোই নিজ ভাষার পরিচয়ে পৃথক জাতি হিসেবে পরিচিতির দাবিদার। বাংলাদেশ আসলে বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের দেশ। পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার ৪০ বছর অতিক্রান্ত হলেও বাংলাদেশে দুর্বল জনগোষ্ঠীর ভূমি ও সম্পদের ওপর সবল জনগোষ্ঠীর আগ্রাসন অব্যাহত আছে। তাই পাহাড় কি সমতল সব স্থানের, বৃহৎ কি ক্ষুদ্র সব জনগোষ্ঠীর সম্পদ, সংস্কৃতি, ভাষা এবং ঐতিহ্য রক্ষার জন্য রাষ্ট্রকে রক্ষকের দায়িত্ব নিতে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য করা দরকার।
বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় সংবিধানে দেশের সব নাগরিককে 'বাঙালি' জাতি আখ্যা দিয়ে সঠিক কাজ করেনি। এভাবে তারা তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে ও তাদের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর আস্থা দুর্বল করে দিয়েছে। আমি মনে করি, সংখ্যা যতই ক্ষুদ্র হোক, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে কোনো জনগোষ্ঠীই অবহেলার নয়। আদিবাসী কি অভিবাসী, বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বাধীনতার সুফল ভোগ করার জন্য মালয়েশিয়ার মতো সব জাতি ও ধর্মের মানুষের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে (সংযুক্ত তফসিলের মাধ্যমে) এই সমস্যার যথাযথ সমাধান করা যেত। কিন্তু এখন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষরা ক্ষুব্ধ হয়ে আদিবাসী দাবি নিয়ে যতই প্রতিবাদ করছে ততই কারা প্রকৃত আদিবাসী তা নিয়ে জনমনে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। এ ধরনের বিতর্ক একটি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্যে মোটেই অভিপ্রেত নয়। আমি তাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে আবার একটি সংশোধনী এনে সব জাতি, ধর্ম ও ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করছি।

প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক : সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা
minamul@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.