ইউরোপের চিঠি-জলবায়ু সম্মেলনের আগে কিছু জ্বলন্ত সমস্যা by পিটার কাস্টার্স

বিষয়টা অপ্রচলিত তেলের মতোই সমস্যাজনক এবং ইতিমধ্যে তা পশ্চিমে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কিন্তু গ্লোবাল সাউথভুক্ত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে জলবায়ুবিষয়ক বিতর্কে এ প্রসঙ্গটি এখনো ততটা ওঠেনি। নভেম্বরের ৬ তারিখে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী হোয়াইট হাউস ঘিরে প্রতিবাদের রঙিনবলয় গড়ে তোলে।
তারা প্রতিবাদ করছিল কিস্টোন এক্সএল পাইপলাইন এবং অপ্রচলিত পিচ বালুর তেল আহরণের বিরুদ্ধে। এই জোরদার প্রতিবাদের চার দিনের মধ্যে ওবামা ওই পাইপলাইন পরিকল্পনা পুনঃপর্যালোচনা করতে বলেন এবং এর নির্মাণের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দেন। দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পরিবেশবাদী আন্দোলনের চাপ স্বীকার করে নিলেন। কিন্তু নিবিড় পর্যবেক্ষকেরা দ্রুতই চিহ্নিত করতে ভোলেনি, বিজয়টা হয়তো সাময়িক এবং রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখা জরুরি। এবং তা কেবল পিচ বালুর তেলের বিরুদ্ধেই নয়, পাথুরে গ্যাসের (শেল গ্যাস: মূলত অপ্রচলিত গ্যাস, যা পাথরের মধ্যে আটকে থাকে) আহরণের বিরুদ্ধেও। যুক্তরাষ্ট্রের পাথুরে গ্যাস খননের ইতিহাস পুরোনো। কিন্তু কয়েক দশকে এ ধরনের গ্যাস আহরণ গগনচুম্বী হয়েছে এবং ওবামার আশীর্বাদে ব্যাপকসংখ্যক খনন প্রকল্পের পরিকল্পনাও রয়েছে। তা হলেও এ ধরনের কর্মকাণ্ড—যাকে বলে ‘ফ্র্যাকিং’, তা মানবস্বাস্থ্য ও প্রকৃতির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে বিশেষত জলবায়ু পরির্বতনের বিবেচনায়, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় এখানে সতর্কতার কিছু নেই। সবাই জানে, প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানো থেকে নিঃসৃত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অন্যান্য ফসিল জ্বালানি যথা কয়লা ও তেলের থেকে কম। সম্ভবত তা তিন ভাগের এক ভাগ। তাহলেও ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পিচ বালুর তেলের পাশাপাশি পাথুরে গ্যাস নিয়েও বিতর্ক সমান জোরদার হয়। সমালোচকেরা দেখান, এটা ফ্রাকিংয়ের মাধ্যমে মাটির নিচে উচ্চচাপের বাষ্প দিয়ে পিচ বালুর তেল আহরণ করার মতোই। এই গ্যাস আহরণের জন্য কাদাটে রাসায়নিকগুলো নিষ্কাশনে মাটির অনেক গভীরে থাকা গ্যাস আবদ্ধকারী পাথরে উচ্চচাপ প্রয়োগ করা হয়। সত্যিই এটা করার জন্য বিপুল পরিমাণ পানির দরকার। একই সঙ্গে দরকার হয় নানা ধরনের রাসায়নিক, যার মধ্যে রয়েছে সীসা ও বিষাক্ত উপাদান। এ ছাড়া ওইসব কাদাটে রাসায়নিকের বড় একটি অংশ মাটির ওপর তুলে বর্জ্যপুকুরে মজুদ করা হয়—এর বড় অংশ আবার ভূপৃষ্ঠের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যায়। কোনো কোনো প্রতিবেদন অনুযায়ী কাদাটে রাসায়নিকের প্রায় অর্ধেকটাই মাটিতে মিশে যায়। যারা এই ফ্র্যাকিংয়ে জড়িত, তারা এমনকি জানাতে বাধ্য নয় যে কী কী রাসায়নিক তারা ব্যবহার করে। তারা দেয় ‘ব্যবসায়িক গোপনীয়তা’র খোঁড়া যুক্তি। তাই এর পূর্ণ পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ করা কঠিন। কিন্তু ওয়াকিবহাল বিজ্ঞানীরা শেল গ্যাস কূপের আশপাশের এলাকার পানীয়জল দূষিত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির কথা বলে বারবার সতর্ক করে দিয়েছেন।
দ্বিতীয় ঝুঁকিটা যুক্তরাষ্ট্রে খবরের শিরোনাম হয়েছে। সেটা হলো মিথেন গ্যাস নিঃসরণ সংক্রান্ত। কার্বন ডাই-অক্সাইডের পর মিথেনই হলো পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দ্বিতীয় গ্যাস। এটা আবহাওয়ামণ্ডলে অনেক কম সময় বিরাজ করলেও, ততটুকু সময়ের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের থেকে শত গুণ বেশি পরিমাণ সূর্যের তাপ শোষণ করে। এদিকে, ২০০৯ সালে নাসার গদার ইনস্টিটিউট বলছে, বায়ুমণ্ডলে বিরাজমান এয়ারসলের সঙ্গে মিশে মিথেনের ক্ষতিকারিতা প্রসারিত হয়। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল এ বছরেরই এপ্রিলে ফ্র্যাকিংয়ে ‘পলাতক’ মিথেন গ্যাসের ওপর গবেষণা চালায়। তাদের অনুসন্ধান দেখায় যে পাথুরে গ্যাসের কূপখনন, তা ভূপৃষ্ঠে উত্তোলন ও বাজারজাতকরণের জন্য যথেষ্ঠ পরিমাণ মিথেন বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে গেছে। এ বিষয়ে সরকারের নিজস্ব সংস্থা এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (এপিএ)-এর ২০১০ সালের শেষ দিকের প্রতিবেদন প্রচলিত গ্যাস ও অপ্রচলিত গ্যাসকূপ থেকে নিঃসরিত মিথেনের তুলনামূলক পরিসংখ্যান হাজির করে। এখানেও, তথ্যপ্রমাণাদি সরাসরি পাথুরে গ্যাস আহরণের বিরুদ্ধেই যায়।
সমস্যাটি বহুগুণে বেড়ে যায় অন্য একটি কারণেও। পাথুরে গ্যাসের জন্য খনি খনন এখনো মোটামুটি অনিয়ন্ত্রিত। তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে তথ্য প্রকাশের দায়মুক্তি যেহেতু তারা ভোগ করে, সেহেতু তারা তাদের কাজকর্মে বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার বিষয়েও দায়মুক্ত। এমনকি তাদের হিসাবে কী পরিমাণ মিথেন গ্যাস ছড়িয়ে যাচ্ছে, সেটাও তারা জানাচ্ছে না। আরও আছে, ২০০৫ সালে যেসব কোম্পানি পাথুরে গ্যাসের জন্য খনন চালাচ্ছিল, তাদের যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপদ পানি আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। বুশ প্রশাসনের সময়, এই খাতে নজরদারির দায়িত্ব থেকে পরিবেশ রক্ষা সংস্থা ইপিএ-কে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০০৯ সাল থেকে ডেমোক্র্যাটদলীয় কয়েকজন কংগ্রেসম্যান শেল গ্যাস খননকাজকে আবার ওই আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। নিও-লিবারেলিজমের এই যুগে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতা যুক্তরাষ্ট্রের তো বটেই, অন্যান্য আর্থিক খাতের গড়পড়তা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই, বিশ্বের জনগণের চেয়ে করপোরেশনগুলোর মুনাফা এবং কোম্পানিগুলোর খুবই অল্পসংখ্যক নির্বাহীদের স্বার্থকেই বেশি কদর করা হয়েছে।
বিশ্ব যে রকম সময়ে পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, সে রকম সময়ে অপ্রচলিত তেল ও গ্যাস আহরণের বিষয়টি জ্বলন্ত প্রশ্ন হিসেবে সামনে চলে এসেছে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বৈশ্বিক প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের আরেক দেশ কানাডাও পাথুরে গ্যাস আহরণের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করার পরিকল্পনা করছে। সেখানেও তাই জনবিতর্ক শুরু হয়েছে। কানাডা যদি শেল গ্যাস আহরণ বাড়ায়, তাহলে তাদের পক্ষে কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হবে না। তা না কমে বরং আরও বাড়বে। জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন কোম্পানিগুলোর কাছে প্রশ্নটা তাই এই: ইতিমধ্যেই যেখানে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রির মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে, সেখানে আপনারা মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতিকে আর কতটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চান? পরিষ্কারভাবে, ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার আন্তর্জাতিক ক্রিয়াকর্ম মোটেই আর যথেষ্ট নয়। অপ্রতিরোধ্য জলবায়ু পরিবর্তন যদি এড়াতে চাই, তাহলে আমাদের একই সঙ্গে যেমন ধ্বংসাত্মক জ্বালানি উত্তোলন কর্মকাণ্ড কঠোর হাতে বন্ধ করতে হবে, তেমনি জ্বালানির ব্যবহার কমানোয় বৈশ্বিক নীতিও প্রণয়ন করতে হবে। কেন তাহলে আমরা সব ধরনের পিচ বালু তেল এবং পাথুরে গ্যাস আহরণ নিষিদ্ধ করার আন্দোলন জোরদার করছি না? কেন বৈশ্বিকভাবে জ্বালানি ব্যবহারের সুষম বণ্টনের দাবি তুলছি না?

ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.