সময় এসেছে অনেক কিছু ভাবার by সুনন্দন রায় চৌধুরী

চার রাজ্যে নির্বাচন হয়ে গেল। এপ্রিল-মে মাসের ভোট বাজারের উত্তাপ এখন প্রশমিত। চারের মধ্যে তিন রাজ্য_পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু ও কেরালা সরকারের পালাবদল হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের পালাবদল। টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সিপিআই(এম) দলটি গদিছাড়া হয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের আলোচনায় পরে আসব; আগে চলে যাই আরব সাগরের উপকূলে, কেরালায়।


বাঙালি অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরা বাদ দিলে কেরালাই একমাত্র রাজ্য, যেখানে বাম দলগুলোর পর্যাপ্ত সমর্থন আছে। ১৯৫৬ সালে ভারতে প্রথম কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয়েছিল কেরালায়। তখন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ইএমএস নাম্বুদ্রিপদে। আজও কেরালায় কমিউনিস্ট দলগুলো শক্তিশালী। প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনে জোর লড়াই হয় কমিউনিস্টদের সঙ্গে কংগ্রেসের। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাত্র কয়েকটি আসনের ব্যবধানে সিপিএম নেতৃত্বাধীন ফ্রন্ট সরকারকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস। কেরালায় প্রায় প্রতি পাঁচ বছরে ক্ষমতার হাতবদল হয়, এবারও তা-ই হয়েছে।
পালাবদল হয়েছে দক্ষিণ ভারতের আরেক রাজ্য তামিলনাড়ুতেও। মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির ডিএমকে সরকার ক্ষমতাসীন ছিল। মানুষের চোখে তারা ভ্রষ্টাচারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দিলি্ল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের শরিক হিসেবে থেকে এবং তার সুযোগ নিয়ে ডিএমকের নেতা-মন্ত্রীরা এক-দুই কোটি নয়, শত শত কোটি টাকা তছরুপ করছিল। তামিলনাড়ুর মানুষ ভোটে তাদের হারিয়ে দিয়েছে, নিয়ে এসেছে জয়ললিতার এআইডিএমকে সরকারকে।
দক্ষিণের পালাবদলের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পালাবদল ঘটেছে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে। ৩৪ বছর জগদ্দল পাথরের মতো বসে থাকা সিপিএম সরকারের পতন হয়েছে। এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন এনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। সিপিএমকে গদিচ্যুত করতে মমতার সঙ্গে জোটসঙ্গী ছিল কংগ্রেস। সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস এবং মমতার তৃণমূল একসঙ্গেই নির্বাচনে লড়েছে। সিপিএম অত্যাচারী শাসক হয়ে উঠেছিল এবং সর্বস্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই এই ফল প্রত্যাশিত ছিল। কেরালায়ও সিপিএমের মধ্যে দুর্নীতি ঢুকে গিয়েছিল। সেখানকার সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিরাট অঙ্কের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনটি রাজ্যে, যে তিন রাজ্যে পালাবদল হয়েছে, সেই তিন রাজ্যেই মানুষ সরকারি দলের ক্রিয়াকলাপে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছে। মানুষের এই রায়ে একদিকে যেমন এসব রাজ্যে পরিবর্তন এসেছে, তেমনি অন্যদিকে এই পালাবদলে শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে দিলি্লতে ক্ষমতাসীন সোনিয়া গান্ধী-মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকারের। সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেস ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে ভারতীয় জনতা পার্টিকে পরাজিত করে। সেবার জোটসঙ্গীদের পাশাপাশি তাদের প্রয়োজন হয়েছিল বাম দলগুলোর সমর্থন। সিপিএম তথা বাম দলগুলো সরকারে যোগ না দিয়ে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ছয়-সাত মাস আগে বামরা কংগ্রেস সরকারকে দেওয়া তাদের সমর্থন তুলে নেয়। সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেস ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর বামদের সমর্থন ছাড়াই সরকার গঠন করে। কিন্তু গত দুই বছরে কংগ্রেস সরকার অনেকটাই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিভিন্ন স্থানে জমি কেলেঙ্কারি এবং সর্বোপরি টেলিকম কেলেঙ্কারি_এসবে কংগ্রেস সরকার যখন জর্জরিত, তখন ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে চার রাজ্যের ভোটের ফল কংগ্রেসের জন্য একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস। কেরালায় কংগ্রেস বামদের হারিয়ে সরকার গঠন করল, পশ্চিমবঙ্গে জোটসঙ্গী তৃণমূলের নেতৃত্বে বামদের হারাল কংগ্রেস, আর তামিলনাড়ুতে দিলি্লর কংগ্রেস সরকারের যে জোটসঙ্গী আর্থিক কেলেঙ্কারিতে নিমজ্জিত ছিল, তারা হেরে গেল। আসামে যেখানে পটপরিবর্তন হলো না, সেখানে তরুণ গগইর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় থেকে গেল। বলা যায়, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন কংগ্রেসের পক্ষে সোনায় সোহাগা। একদিক থেকে দেখলে দিলি্লর কংগ্রেস সরকার নতুন জীবন ফিরে পেল। সর্বভারতীয় মানচিত্রে বামদের শক্তি ভীষণভাবে কমে গেল, গলার কাঁটা ডিএমকে তামিলনাড়ুতে হেরে গেল, আসামে কংগ্রেসের সরকার তৃতীয়বারের মতো রয়ে গেল। যখন আর্থিক কেলেঙ্কারির সমালোচনায় জর্জরিত মনমোহনের সরকার, ঠিক তখন জনগণের এই রায় কংগ্রেসের কাছে সুবাসিত দখিনা হাওয়া। অথচ যদি জনগণের কথা ভাবা যায়, তাহলে তাদের অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে। উত্তরোত্তর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে, প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর এখন অগি্নমূল্য, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সামর্থ্যের বাইরে। যেসব জনমুখী যোজনা সরকার ঘোষণা করেছে, তার সুফলও তেমনভাবে মানুষের কাছে পেঁৗছেনি। ভোটের ফল বেরোনো মাত্রই আবার পেট্রলের দাম বেড়েছে ৭ শতাংশ। প্রশ্ন উঠবে, দিলি্লর কংগ্রেসশাসিত কেন্দ্রীয় সরকার মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য প্রায় কিছুই করে না, অথচ বিধানসভা নির্বাচনের ফলে কংগ্রেসের পালে হাওয়া লাগল। এ কেমন ধাঁধা? আসলে ভারতের রাজনীতিতে প্রতিটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটে সেই রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের কাজের বিচার হয়। ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকারের কাজের ওপর আস্থা বা অনাস্থা প্রয়োগ করে ভোটদাতারা। এবার ভোটদাতারা কংগ্রেসের বিরোধীদের ওপর অনাস্থা জানিয়েছে। এতে কংগ্রেসের আখেরে লাভ।
সর্বভারতীয় চিত্রটাকে ইংরেজিতে বলা চলে_'ঊহফ ড়ভ অহঃর-পড়সঢ়ৎবংংরড়হ.' 'কংগ্রেসবিরোধিতার রাজনীতির অবসান'। শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে আর চিঁড়া ভিজবে না।
অন্যদিকে, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে একটা শিক্ষণীয় বিষয় আছে। তা হলো, প্রতিটি রাজ্যে, সেই রাজ্যের মাটিতে শক্তভাবে প্রোথিত কংগ্রেসি নেতাদের উত্থান। যেমন, আসামে তরুণ গগই এবং_আমি বলব_পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও তিনি নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেসের কাণ্ডারি হয়েই ক্ষমতায় আসীন, তবু আমি বলব, তিনি বৃহত্তর কংগ্রেস পরিবারের সদস্যা। তাঁর রাজনৈতিক জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা কংগ্রেস দলের গর্ভেই। তিনি কংগ্রেসে উপযুক্ত মর্যাদা না পেয়েই নতুন দল গড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে যদি কংগ্রেস শিক্ষা নেয়, তাহলে আজ কংগ্রেসের পালে যে হাওয়া, তা আগামী দিনে আরো জোরদার হতে পারে। ভারত রাষ্ট্রের যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, তার সারমর্ম যদি কংগ্রেস তথা অন্য বড় দলগুলোর রাজনীতিতে ছাপ ফেলে, তাহলে সংসদীয় রাজনীতিতে দলগুলোর সাফল্য বাড়বে, মানুষের কাছে হয়তো জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের সুফলও বেশি পেঁৗছবে। অকংগ্রেসি দলগুলোর কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা_শুধু গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে কংগ্রেসবিরোধিতার দিন শেষ হয়ে গেছে; নতুন কল্যাণকর রাজনীতির নীতি এবং কর্মসূচি সম্পর্কে ভাবার সময় এসেছে।

লেখক : পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.