তাদের অবস্থান ইতিহাসের উল্টো দিকে-ফিলিস্তিন by এরিক এস মারগোলিস

ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জনের ব্যাপারে আগামী সপ্তাহে আমরা কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখতে পাব? পুরোপুরি না। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা জাতিসংঘের কাছে বর্তমানের ভোট প্রদানের অধিকার নেই এমন 'পর্যবেক্ষক স্বতন্ত্র সত্তা'র (অবজারভার অ্যানটিটি) পরিবর্তে 'পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র' হিসেবে স্বীকৃতি চাইবে। এই আমলাসুলভ সতর্কতামূলক পরিবর্তন দৃশ্যত তেমন গুরুত্বপূর্ণ ফল প্রসব করবে না। ভ্যাটিকানও একটি 'পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র'।


তারপরও থরহরিকম্প শুরু হয়েছে। বিশ্বের দেশগুলোর গরিষ্ঠ অংশ রাষ্ট্রবিহীন ফিলিস্তিনিদের বিরামহীন দুর্দশা দেখতে দেখতে চরমভাবে হতাশ এবং এখন তারা পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
তুরস্কের উত্তরোত্তর ক্রমবর্ধমানভাবে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী তায়েপ এরডোগান গত সপ্তাহে কায়রো সফর করেন এবং সে সময় তিনি বিশ্বকে ফিলিস্তিনি পতাকাকে ঊধর্ে্বর্ তুলে ধরা ও ওই পতাকা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতীকে পরিণত করার আহ্বান জানান।
জাতিসংঘে যাতে এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট না পড়ে সে জন্য বেপরোয়াভাবে পড়ি কি মরি করে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়ার পক্ষে কোনো প্রস্তাব পাস করানোর চেষ্টা হলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করবে বলে হুমকি দিয়ে রেখেছে। কারণ এটাই শেষ পর্যন্ত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট প্রদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার ওপর নির্ভরশীল ও মিত্র দেশগুলোর ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। হুমকি ও ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টারতদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে নতুন ইসরায়েলপন্থি কানাডা রয়েছে এবং এই তিনটি দেশ এখন ফিলিস্তিনি ইস্যুতে একঘরে হয়ে পড়েছে। ইসরায়েল এ নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে এবং ভোটাভুটি স্থগিত করার জন্য তার সব শক্তিশালী প্রভাবকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। ইসরায়েলে কট্টর দক্ষিণপন্থি সরকার ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অচিন্তনীয় পরিণতি হবে বলে হুমকি দিয়ে চলেছে।
এদিকে, গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কর্ সিটির কংগ্রেসনাল নির্বাচনের ফলাফল ইসরায়েল ও তার সমর্থকদের নতুন শক্তিশালী রসদ জুগিয়েছে। ইসরায়েলকে চলন্ত বাসের নিচে ছুড়ে মারার অভিযোগ ডেমোক্রেটিক প্রার্থী ও প্রেসিডেন্ট ওবামার বিরুদ্ধে ওঠার পর ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে দীর্ঘদিন ডেমোক্রেটদের দখলে থাকা আসনটিতে পরাজয়ের স্বাদ নিতে হয় তাদের।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ফিলিস্তিনবিরোধী কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক খায়েশ রয়েছে এবং এ জন্য ইসরায়েলি সমর্থকদের তিনি তেল মারার চেষ্টা করছেন। তার লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দালাল হিসেবে কথিত দুর্বল ফিলিস্তিন নেতৃত্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা ইসরায়েলকে হতাশ করবে না তেমন একটা আপস মেনে নেয়।
বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েলে দক্ষিণপন্থি সরকার তাদের মার্কিন লবির মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবেই ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ন্ত্রণ করে। মুসলিম বিশ্বে এহেন অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর ফলে উত্তাল মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য দুর্বল হচ্ছে।
তুরস্কের এরডোগান ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের বখে যাওয়া সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং অনেকেই তার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে হামলাকারী ৯/১১ হাইজ্যাকাররা প্রতিপন্ন করেছিল যে, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি নির্যাতনকে যুক্তরাষ্ট্র বিনা বাক্যব্যয়ে সমর্থন করে বলেই তার শাস্তিস্বরূপ তারা এটা ঘটায়। অন্যান্য হামলাও সম্ভবত এই একই কারণ দেখিয়ে করা হবে।
কৌতুকের বিষয় হলো, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতা মাহমুদ আব্বাসকে তার দাবি থেকে সরিয়ে আনার মার্কিন প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন মার্কিন সরকারের ইসরায়েলের অন্ধ সমর্থক ডেনিস রস। ইসরায়েলের দাবির প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের সমর্থন রয়েছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের দাবি থেকে সরে না এলে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সব সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং তাদের দাবির প্রতি জাতিসংঘের কোনো সংস্থা সমর্থন জানালে তাদের বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস হুমকি প্রদান করেছে।
ইসরায়েল এখন আর মিসরের হোসনি মোবারক বা তুরস্কের দক্ষিণপন্থি জেনারেলদের সমর্থন পাচ্ছে না এবং এ কারণে তারা নিজেদের একাকী মনে করছে। তবে এখনও তাদের প্রতি রয়েছে মার্কিন প্রশ্নাতীত সমর্থন।
বাইরের অনেকেই মনে করেন, দু'পক্ষের মধ্যকার বিরক্তিকর বিষয়গুলোর মীমাংসা করা গেলে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুটি রাষ্ট্রের ধারণা বাস্তবায়ন সম্ভব। সম্প্রতি এ বিষয়ের ওপর আমার একটি বই প্রকাশ পেয়েছে। আমি এ ধরনের আশাব্যঞ্জক ধারণার সঙ্গে মোটেই একমত নই।
ইসরায়েলের কট্টর দক্ষিণপন্থি লিকুদ পার্টি ও তার আধা-ফ্যাসিবাদী জোট মিত্ররা সমগ্র পশ্চিম তীর ও গোলান হাইট নিজেদের অধিকারে রেখে দিতে বদ্ধপরিকর। ইউরি এভনেরির মতে, লিকুদ পার্টি ইসরায়েলের সীমান্ত নির্দিষ্ট করতে চায় না। তারা সিরিয়া ও লেবাননে তার ভূখণ্ডগত সম্প্রসারণ চায়।
ইসরায়েলের কৌশল হলো বিরামহীনভাবে শান্তি আলোচনা চালানো এবং একই সঙ্গে পশ্চিম তীর ও গোলান এলাকায় দ্রুত ইহুদি বসতি স্থাপন চালিয়ে যাওয়া। একজন ফিলিস্তিনি সঙ্গতভাবেই এ অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে_ পিৎজাটি যখন ইসরায়েল খেয়ে ফেলেছে তখন ফিলিস্তিনিরা তার সঙ্গে এর ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামা এখন ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন। অন্যদিকে, ইসরায়েলিরা মনে করছে, আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থীই বিজয়ী হবেন। তাদের আশা, কংগ্রেস আরও রিপাবলিকান সমর্থিত হবে। এ অবস্থায় মার্কিন কংগ্রেস হবে ইসরায়েলি নেসেটের চাইতেও বেশি ইহুদিপন্থি।
ফিলিস্তিনের এতিম জাতিসংঘ মর্যাদা এসব মৌলিক প্রশ্ন অ্যাড্রেস করার ক্ষেত্রে কোনো কাজেই আসবে না। তবে এটা ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিসীমার মধ্যে প্রকটভাবে তুলে আনবে। আর এটা নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে ইতিহাস ও ন্যায়বিচারের উল্টোদিকেই স্থাপন করবে।

এরিক এস মারগোলিস :মার্কিন প্রবীণ সাংবাদিক খালিজ টাইমস থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.