জনশক্তি রপ্তানিতে ভাটা-পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ দরকার

জনশক্তি রপ্তানি খাতটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তথা দেশের অর্থনীতিকে পুষ্ট করার অন্যতম প্রধান একটি মাধ্যম। কিন্তু উদ্বেগ এবং প্রশ্নবোধক হলেও সত্য, নানা রকম সম্ভাবনা থাকার পরও জনশক্তি রপ্তানি ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ২ জুলাই কালের কণ্ঠে 'আড়াই বছরে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে ১০ লাখ' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই তথ্যচিত্র পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি হয় ১৭ লাখের ওপরে। কিন্তু গত আড়াই বছরে জনশক্তি রপ্তানির সংখ্যাচিত্র দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখে। অর্থনৈতিক মন্দা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এ ক্ষেত্রে অনেকটা বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তা সত্য। কিন্তু এও সত্য, দেশের অভ্যন্তরীণ নেতিবাচক রাজনীতির কুফল এবং যথাযথ কূটনৈতিক তৎপরতার অভাবসহ বিদেশের মিশনগুলোতে কর্মরত দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতাও বহুলাংশে এ ক্ষেত্রে দায়ী।
জনশক্তি রপ্তানি ক্রমেই কমে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাবের কথা ভেবে উদ্বেগ জাগে। বিশ্বমন্দার বছর বলে পরিচিত ২০০৯ সালের প্রথম দুই মাসে চাকরি নিয়ে বিদেশ গেছেন প্রায় এক লাখ কর্মী। এর পর থেকে তা ক্রমহ্রাস পেতে থাকে। বিশ্বমন্দায় জনশক্তি রপ্তানি আশঙ্কাজনকভাবে কমে না গেলেও যখন মন্দা কাটতে শুরু করে কিংবা পর্যায়ক্রমে কেটে যায় তখন কেন রপ্তানি নিম্নমুখী হলো তা খতিয়ে দেখে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কেন এমনটি পরিলক্ষিত হলো তা জরুরি প্রশ্ন। জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে সর্বাগ্রে দরকার কূটনৈতিক তৎপরতা, একই সঙ্গে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে জনশক্তি রপ্তানির প্রক্রিয়া বজায় রাখা। কিন্তু এ দুয়ের উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট গাফিলতি এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়েছে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চালিকাশক্তি এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত জনশক্তি রপ্তানির পথটি বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নির্ভেজাল কিংবা মসৃণ করা যায়নি।
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ এবং মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে আমাদের পুরনো শ্রমবাজার। চীন, জাপান, ইতালিসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি শিল্পোন্নত দেশও বড় বড় বিনিয়োগের কাজ ইতিমধ্যে শুরু করেছে এবং তাদের প্রচুর বিদেশি শ্রমিক দরকার বলে আভাস পাওয়া গেছে। তাদের বাজারে প্রবেশে আমাদের অবিরাম চেষ্টা চালানো প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে কালক্ষেপণ না করে। একই সঙ্গে আরো নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধান প্রক্রিয়া জোরদার করা দরকার। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার প্রয়াসও এখনই জোরদারভাবে শুরু করা খুব জরুরি। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারলে বিদেশে যেমন আমাদের শ্রমবাজার খোঁজা সহজ হবে তেমনি রেমিট্যান্স আদায়ের পথটিও প্রশস্ত করা যাবে।
নির্দিষ্ট শ্রমবাজারের ওপর নির্ভরশীলতা আকস্মিক বিপদ ডেকে আনতে পারে এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সামনেই রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকদের যথেষ্ট কদর আছে এর স্বীকৃতি প্রায় বিশ্বজনীন। কিন্তু তার পরও এ ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি কেন হবে না_এটিও জরুরি প্রশ্ন। জনশক্তি রপ্তানিতে ভাটা পড়ার কারণে শুধু রেমিট্যান্সই কমে যাচ্ছে না, এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোও সংকটে পড়ছে, কর্মহীন মানুষের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এসবের কোনোটিই শুভপ্রদ নয়। বিপুলসংখ্যক কর্মহীনের এ দেশের প্রেক্ষাপটে জনশক্তি রপ্তানির পথ প্রশস্ত করতে না পারলে এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব আরো প্রকট হয়ে উঠবে। আমরা আশা করি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো এ ব্যাপারে দূরদর্শী উদ্যোগ নিতে সক্ষম হবে।

No comments

Powered by Blogger.