সদরে অন্দরে-রমজানকে অসংযমী করার প্রয়াস by মোস্তফা হোসেইন

রমজান এগিয়ে আসছে। বাড়ছে উৎকণ্ঠা। এবারও কি বাজারে গিয়ে রোজাদারকে অসহিষ্ণু অবস্থায় পড়তে হবে? আলামত ভালো মনে হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না কারো প্রতি। সরকারের নিয়ন্ত্রণ যেন শূন্যের কোঠায় নেমে যাচ্ছে। বাজার বলছে, আমি স্বেচ্ছাচারী_যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চলব।
লাগাম টেনে ধরবে কোন সে জন? ব্যবসায়ীরা বসে নেই। টুকরি-কোদাল নিয়ে প্রস্তুত ফড়িয়ারাও। এটা যেন অতি সাধারণ ঘটনা। প্রশাসন থেকে দোহাই দেওয়া হচ্ছে, সিন্ডিকেট সব দোষের মূল। অথচ সেই সিন্ডিকেট বালির বস্তা, নাকি কোনো মানুষ, তা কেউ বলতে পারছে না। যে প্রশাসন সিন্ডিকেটকে দায়ী করে, তারা সিন্ডিকেট দেখতে পায় না। সমালোচকরা বলেন, তারা দেখতে চায় না, তাই দেখতে পায় না।
সুধীজন বলেন, খোলাবাজারের খোলা হাওয়ার দাপটে প্রাণ ওষ্ঠাগত। সরকারের উচিত নিজের দিকেই নজর দেওয়া। যদি মানুষের কথা চিন্তা করে, সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে, তাহলে সব কিছু উন্মুক্ত করে না দেওয়াই হবে জনকল্যাণমুখী সিদ্ধান্ত। খোলাবাজারের দোহাই দিয়ে মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে লাভ কী?
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারে? অতি সাধারণ কথা। একটা শিশুও বলতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে অতিরিক্ত সরবরাহ করে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। যদি একটি পক্ষ হিসেবে সরকারও বাজারে উপস্থিত থাকে, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায়, মানুষের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে বাধ্য হবে অতি মুনাফাখোররা। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবিকে চাঙ্গা করতে পারলেই কিছু মুনাফালোভীর হাত থেকে সাধারণ মানুষ অনেকটাই রেহাই পাবে। বাজারে সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি বাংলাদেশে নজিরবিহীন নয়। আমরা যদি স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, সরকার কিভাবে সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণ করতে তৎপর হয়েছিল। ১৯৭১-এর অব্যবহিত পরের কথা। দেশ তখন ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। চাল-ডাল, নুন-তেল, সাবান ও চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসেরই প্রচণ্ড আকাল ছিল। এমন অবস্থায় সরকার পিও-৬৮-এর মাধ্যমে এ দেশে টিসিবি প্রতিষ্ঠা করে। টিসিবি ১৯৭২ সালের ১২ জুন প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর থেকে তার কর্মব্যাপ্তি তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছিল। যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে তখন অনেক জিনিসই দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছিল। টাকা দিয়েও জিনিস না পাওয়াটা ছিল নিত্য ঘটনা। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া শিল্পকারখানা সরকারকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হয়েছিল। সেসব কারখানার কাঁচামাল আমদানিও সরকারকে করতে হতো। এমন পরিস্থিতিতে টিসিবি নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। মনে আছে, দুধ ও চিনিজাতীয় অনেক দ্রব্যই তখন টিসিবির মাধ্যমে আমদানি হয়ে সরাসরি ডিলারদের হাতে চলে যেত। ডিলাররা সেগুলো তৃণমূলে পেঁৗছে দিত।
মনে থাকার কথা, কসকরের কথা। কী শক্তিশালী বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে তৈরি হয়েছিল কসকর। প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যায্যমূল্যের দোকান চালিয়েছিল তারা। পরবর্তীকালে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে এই কসকর ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রথম অবস্থায় ইউনিয়ন পর্যায়ের দোকানগুলো উঠিয়ে দেওয়া হয়, তারপর জেলা শহর পর্যায়ের দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে হবে, সেই সময়কার কসকর দ্রব্য সরবরাহের ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিল। আজ যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনামুক্ত কসকরের কথা কল্পনায় আসে।
তবে বিষয়টি খুব সহজ নয়। খোলাবাজারের কথা বলে যেসব ফড়িয়া এবং অসৎ ব্যবসায়ী বাজার অস্থিতিশীল করতে চায়, তারা কিন্তু কোনো অবস্থায়ই সরকারকে বাজারে পণ্য নিয়ে আসতে দেবে না। কসকরও তাদেরই কারণে বন্ধ করেছিল সরকার। আজ টিসিবিও তাদেরই কারণে পঙ্গু হয়ে আছে। সেই পঙ্গু প্রতিষ্ঠানটিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারলে তাদের ষোলোকলা পূর্ণ হবে। তবে তাদের এই ইচ্ছা পূরণের জন্য তাদের সঙ্গে প্রশাসনেরও একটি শক্তিশালী অংশ জড়িত আছে। তা না হলে সরকারি সিদ্ধান্ত থাকার পরও আসন্ন রমজানের বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর জন্য টিসিবির মাধ্যমে দ্রব্য মজুদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো। রমজানের সময় যাতে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সহজলভ্য থাকে এবং মূল্য নিয়ে কোনো চক্র ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সে জন্য বর্তমান সরকারও টিসিবির মাধ্যমে ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা ও পেঁয়াজ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়। জানা গেছে, ইতিমধ্যে ৩৮ হাজার টন ভোজ্য তেল, ৩৮ হাজার টন চিনি, ৭৫০ টন ছোলা এবং ৭৫০ টন পেঁয়াজ কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এসব পণ্য সরবরাহ করার জন্য টিসিবি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। সংগত কারণেই আশা করা গিয়েছিল, এবার হয়তো রোজার মাসে আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলতে সাহস করবে না। অন্তত বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার ব্যাপারে তাঁরা যথেষ্ট আন্তরিক। বাণিজ্যমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এ বছর সরকারের প্রস্তুতি নাকি গত বছরের তুলনায় ভালো। বাণিজ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য যদি সঠিক হতো, তাহলে এত দিনে টিসিবির দ্রব্যগুলো তাদের গুদামে আসতে শুরু করত। রোজা আসতে যেখানে মাত্র এক মাস বাকি, সেখানে চুক্তিবদ্ধ বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান এখনো পণ্য আমদানির এলসি পর্যন্ত খোলেনি। এমতাবস্থায় বাণিজ্যমন্ত্রীর এই আশাবাদ আমাদের কি আশ্বস্ত করতে পারে?
নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব দ্রব্য যাতে বাজারে সুলভে পাওয়া যায় এবং সিন্ডিকেটের হাত থেকে এসব দ্রব্য রক্ষা করা যায়, সে জন্য সরকার ডিও প্রথা বাতিল করে ডিলারের মাধ্যমে তা বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে তিন মাস সময় দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সর্বশেষ ১ জুলাই থেকে ডিলার প্রথা সর্বত্র কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বতোভাবে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করেনি। তাদের গড়িমসি দেখে মনে হয়, বাজার গত বছরের মতো অস্থিতিশীল করার জন্য একটি চক্র উঠেপড়ে লেগেছে। গত বছরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের চুক্তি অনুযায়ী টিসিবিকে দ্রব্য সরবরাহ করেনি। ফলে বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, যার পরিণতিতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।
সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটিকে এমন সময় সরাসরি পণ্য আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যখন সে নিজে রমজানের বাজার সামাল দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এটা দুর্বোধ্য, টিসিবিকে পণ্য আমদানি করতে হলে কোন কারণে অন্যের ওপর ভরসা করতে হয়_যেমনি দুর্বোধ্য, কোন কারণে রমজান আসার প্রাক্কালে তাদের সেই সুযোগটি দেওয়া হলো। আগে দিলে কী ক্ষতি হতো? তারা যদি ছয় মাস আগে এই সুযোগ পেত, তাহলে হয়তো আজ কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্রীড়নকে পরিণত হতো না। সুতরাং টিসিবিকে শুধু বাইরের একটি চক্র নিষ্ক্রিয় করতে চাইছে, এমনটি বলার কারণ নেই। একে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখার জন্য সরকারের ভেতরও একটি চক্র কাজ করছে। এ থেকে মুক্তি না পেলে বাজারে সরকারের অংশগ্রহণ থাকবে না, বাজারও সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি পাবে না।

mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.