পাখির চোখে-তুলোয় কুলোয় নির্ভয় বাঙালি by জাহানারা নওশীন

প্রায়ই বলতে শুনি, 'এই গরিব দেশে মানুষের দুর্গতির অন্ত নাই...' ইত্যাদি। বাক্যের শেষাংশটুকু সর্বাংশে সত্য। কিন্তু 'এই গরিব দেশে' বলে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মধ্যে দারিদ্র্যে তার উচ্চতর স্থান নির্ণয়ের কোনো মানে হয় না। বাংলাদেশ মোটেও গরিব দেশ নয়। আমার কথার সত্যতার প্রমাণ খুঁজতে কাউকে বেশিদূর যেতে হবে না।


আমরা এই শিক্ষিত মানুষরা যেখানে বাস করি, তার রাস্তার দুই পাশের ঐশ্বর্যময় বিতানগুলোর দিকে তাকালে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। ফলের দোকান ও তার সম্ভারের প্রাচুর্যও আপনাকে প্রমাণ দিয়ে সমৃদ্ধ করবে। পাশের দেশ কলকাতায় (সে দেশে তো সব ধরনের ফলই জন্মায়, কোনো কোনো স্থানকে ফলেরই স্থান বলে উল্লেখ করা যায়) কোনো রাস্তার পাশে থরে-বিথরে সাজানো এমন ফলের সম্ভার দেখতে পাওয়া যাবে না। লেক, মার্কেটে কিছু ফলের দোকান আছে; কিন্তু আমাদের শহরগুলোর মতো সেসব জায়গায় এমন সাজানো-গোছানো ঝকঝকে মণকে মণ টসটসে টাটকা আঙুরের থোকা ঝোলে না। মার্কেটের ভেতরের দিকে বা বড় বাজারে ফলের মার্কেট নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তা আমাদের দেশের মতো এমন 'দেখনসই' নয় মোটেই। ক্রেতার বহরও আমাদের এখানে উপচে পড়া। সেখানে পাড়ার চার চাকার পাটাতনগাড়িতে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে কিছু ফলের দেখা মিলবে, যা পড়শিরা টুক করে কিনে নিতে পারে। কমলার সময় কমলা, আপেল, আঙুর, জাম_সবই মিলবে সময়ে, পাড়ার কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই চার চাকায়। আমাদের মতো গাড়ি চেপে ফলের দোকানে ভিড় জমে না। যাহোক, আমার বক্তব্যের প্রমাণ শুধু তো ফলের দোকানই নয়। সুতরাং সেই প্রসঙ্গে যাই। যেকোনো শহরে, বিশেষভাবে ঢাকার পথে ব্যক্তিগত যানবাহনের দিকে তাকালেই আমার কথার সত্যতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলবে।
ব্যক্তিগত গাড়ির বহরে রাস্তা বোঝাই। প্রায় সব গাড়িই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও বিশাল। রাজধানীর রাস্তা নাকি এত সব গাড়ির চাপ সহ্য করার মতো শক্তি রাখে না। না, গাড়ির ওজনের জন্য নয়, তার আকারের জন্য_মানে, স্থান সংকুলান হয় না। একজন বা দুজনের যে সংসার, তারও গাড়ি ঢাউস_বলা যায়, তুলনা করলে বাড়ির চেয়ে গাড়ি ডাঙ্গর। ছোট গাড়ি নাকি হালকা, ঠুনকো; তা ছাড়া ছোট গাড়ি জাপান বা বিদেশ থেকে আর আমদানি করা হচ্ছে না। পাশের দেশের 'ন্যানো' কারো চোখে লাগে না_ধুর, ওসব কৃপণদের জন্য, ওরা কৃপণ, আমাদের মতো ওদের খরুচে হাতই নেই। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে যে গাড়ি ছোটানোর সস্তা রসদ গ্যাস কিন্তু অপ্রতুল হতে হতে শূন্যের কোঠায় পেঁৗছতে চাইছে। তবু বড় বড় গাড়ি আমদানির বিরাম নেই। ছোটবেলায় সেই যে পড়েছিলাম, 'বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি', যা কোনো দিন চোখে দেখতে পাব বলে মনে করিনি, তা বাংলাদেশ হলো বলে দেখতে পেলাম। এ প্রসঙ্গে নিজের কানে শোনা, চোখে দেখা ঘটনার কথা বলি_ভালো লাগবে, মজা পাবে পাঠককুল। সেগুনবাগিচার বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে এমন দুর্লভ ঘটনা দেখে চক্ষু-কর্ণ সার্থক করার সুযোগ পেলাম। সে বাড়ির ডোরবেল বেজে উঠলে গৃহস্বামী গিয়ে দরজা খুললেন, তারপর স্ত্রীকে ডাকলেন। শুনতে পাচ্ছি_'আশ্চর্য! এমন প্রস্তাব দিচ্ছে কী বলে?' কর্তা-গিনি্নর বিস্মিত কণ্ঠ শুনতে পেলাম। অন্য কণ্ঠ ধ্বনিত হলো, 'ব্যাপারটা বুঝছেন না কেন, আমার গাড়িটা আমার গ্যারেজটার চেয়ে বড়, তাই গ্যারেজে ঢুকছে না, আপনার গ্যারেজটা বড়, তাই আপনার গ্যারেজটা আমাকে দিয়ে দিন।' লাজুক কণ্ঠে আমাদের গৃহস্বামী বলছেন, 'তা কী করে হবে? আমি বেশি দাম দিয়ে গ্যারেজ নিয়েছি_আপনি এমন প্রস্তাব নিয়ে এলেন কী করে?' কর্তা-গিনি্নর ভদ্র ভদ্র গলায় বোধ করি প্রস্তাবকের সাহস বেড়ে গেল, দাবি জানানোর মতো দৃঢ় কণ্ঠ শোনা গেল_'দিতে হবে, দেবেন না মানে? না দিলে চলবে কেন? অবশেষে গৃহকর্তাকে রূঢ় হতেই হলো, 'আপনি গাড়ি কেনার আগে আপনার গ্যারেজের মাপ না নিয়ে বেহিসাবির মতো গাড়ি কেনেন কেন? এত বড় গাড়ি কেন কিনবেন, যে গাড়ি আপনার গ্যারেজে ধরবে না?' এরপর আর কিছু শোনার দরকার আছে? 'জোর যার মুল্লুক তার' বলে যে কথাটা আছে, তারও প্রয়োগ এ দেশে যথেচ্ছ। তবে এই গৃহস্বামী এবং তাঁর স্ত্রীও এ দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, তাই হয়তো গ্যারেজটা বেদখল হবে না। তা না হলে নিশ্চয় জানি, সাধারণ কেউ হলে গ্যারেজ নিজের দখলে রাখতে পারতেন না। খালবিল, এমনকি সরকারি জায়গাও দখল হয়ে যাচ্ছে, কে কী করতে পারছে?
আসল কথায় আসি। নগরীর রাস্তা ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে, কারণ গাড়ির মাইল-দেড় মাইল লম্বা লাইন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। এক ইঞ্চি এগোনোর উপায় নেই_জ্যাম লেগেছে রাস্তায়, গাড়ির জ্যাম। লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকার গাড়ি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোশেখ-জষ্টির রোদ পোহাচ্ছে। 'টয়োটা করোলা'র গাড়িই বেশি, প্রায়ই ছাই রঙের, তাদের চেহারার বাড়বাড়ন্ত রূপ দেখলে এবং সামনে-পেছনের ঝকঝকে লাল, হলুদ রকমারি রঙের আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। ইঞ্জিন তো 'অন' করা আছে, রসদ পুড়ছে তা পুড়ুকগে, গ্যাস না পাও, অকটেন নিয়ে নাও, ঠাণ্ডা হাওয়ার যন্ত্র চলতে থাকুক, না হলে ঘেমে নেয়ে উঠতে হবে_জুতা মোজা শরীরও ঘামে ভিজে দুর্গন্ধ ছড়াবে_তা কি হয় নাকি? ড্রাইভারও বিরক্ত হয়ে মোবাইল কানে 'হ্যালো দোস্ত' চালিয়ে যায়, মালিক মাথা হেলিয়ে আরাম নিয়ে নেন_মাঝেমধ্যে জ্যাম লাগলে ভালো_গাড়িতেই হেলান দিয়ে ক্লান্তি কাটানো যায়। কাজের মানুষদের বিরক্তির শেষ নেই। তাঁরা অনেকেই মাঝেমধ্যে ড্রাইভারের জিম্মায় গাড়ি দিয়ে হেঁটে গন্তব্যে পেঁৗছেন। কোনো কারণে যাঁদের গাড়িতে এসি নেই, তাঁদের অবস্থা? ঢাকার রাস্তায় গাড়িতে চড়ার বেজায় আনন্দে তাঁরা মাঝেমধ্যে_কেউ কেউ শুনেছি_শরীরে পানিশূন্য অবস্থায় হাসপাতালে স্থানান্তরিত হয়েছেন গন্তব্যের বদলে। এও জানলাম, প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলেও মন্ত্রী-এমপিদের বিলাসবহুল গাড়ি আনতে নিরুৎসাহ করেছিলেন। কিন্তু সে কথা কেউ আমলে এনেছেন? এসব খবর সেদিন কালের কণ্ঠে লেখা এক উপসম্পাদকীয়তে জানলাম। আরো বিশদভাবে জানতে পারলাম, তিন হাজার সিসির গাড়িতেও আমাদের মন্ত্রী-এমপিদের মন উঠছে না। চার হাজার সিসির দিকেই সবার নজর। হতবাক হতে হয়। লেখাটায় জেনে আরো কৃতার্থ বোধ করলাম যে এই গরিব দেশে যেখানে 'নুন আনতে পান্তা ফুরোয়', সেখানে শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিলাসবহুল গাড়ি এনেছেন ১৬৫ জন মন্ত্রী-এমপি। তাঁদের মধ্যে ৬৭ জন এনেছেন পাঁচ কোটি টাকার গাড়ি বা এরও অধিক দামের গাড়ি। এসবের পর লেখকের মন্তব্য বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য_'সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যে জাতীয় প্রায় সব বিষয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য থাকলেও নিজেদের এসব স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে মতের ক্ষেত্রে তাঁরা সহাবস্থান করেন।' চমৎকার! জেনে বিশেষ কৃতার্থ হতে হয়। এই না হলে রাজনীতিকের আদর্শ থাকে কী করে! বিলাসবহুল গাড়ি কেনার শর্ত ছিল, হস্তান্তর বা বিক্রি করা যাবে না। সেই শর্তও মানা হয়নি।
যে দেশের অসংখ্য মানুষ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে, যাদের মৌলিক অধিকার পাওয়া আকাশ ছোঁয়ার মতোই দুঃসাধ্য, তাদের দুর্দিনের, দারিদ্র্যের অভাব মেটানোর দায় নেই বুঝি মন্ত্রী-এমপিদের! অবাক মানতে হয়_আমরা কী করে এত বিলাসী হয়ে উঠলাম? এই বিলাসের ব্যাপারে অনুসন্ধান করলে আমাদের অতীত কী বলে? এ জিজ্ঞাসার উত্তরে সত্য যা বেরোবে তা বুঝি কহতব্য নয়, স্মরণতব্য তো নয়ই। তা বিবেক কি বেঁচে আছে, না ওই সব চেয়ারে বসে ভেসে গেছে লোভের, নোংরা স্বার্থের জোয়ারে? এত বড় বিলাসী হয়ে উঠতে আমাদের লজ্জা করে না_এটা একটা বিষয় বটে। তবে বাঙালির তুলো আর কুলো আছে না? তবেই আর কি!

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.