সমন্বিত শিক্ষা আইন জরুরি-শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন by কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

শিক্ষানীতি ২০১০ বর্তমান সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই শিক্ষানীতি ব্যাপক জনমতের ভিত্তিতে তৈরি করায় এর গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক। দলমত নির্বিশেষে। বাংলাদেশে এটি বিরল। গণমুখী ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষানীতির দাবি কয়েক দশক ধরেই ছিল। ছাত্র সংগঠনগুলো এ দাবিতে সক্রিয় থেকেছে।


স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশন এ আলোকেই প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। বর্তমান শিক্ষানীতিকে বলা চলে খুদা কমিশনের প্রতিবেদনেরই কার্যকর ও যুগোপযোগী ধারাবাহিকতা। এ কারণে এর বাস্তবায়নে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। এ নীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা। কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। সব পর্যায়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা। শিক্ষার সঙ্গে দেশজ আবহ ও বাস্তবতার সম্মিলন ঘটানো, একদিকে মানবিক গুণাবলির বিকাশ, অন্যদিকে দক্ষতা সৃষ্টি। শরীর চর্চা ও খেলাধুলার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও মননের গঠন। মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করা এবং উচ্চশিক্ষায় গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। এ ছাড়া আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সমনাগরিক ভিত্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষার সব ধারায় কয়েকটি বিষয়ে একই পাঠ্যবই। প্রাথমিক পর্যায়ে বিষয়গুলো হচ্ছে_ বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বাংলাদেশ স্টাডিজ, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ। মাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বাংলাদেশ স্টাডিজ।
তথ্যপ্রযুক্তির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। কারিকুলাম তৈরিতে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনার তাগিদ রয়েছে। ঝরে পড়া রোধে এবং বিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। একটি বাস্তবায়ন কমিটি এবং বিভিন্ন বিষয়ে ২৪টি উপকমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি ও উপকমিটির কাজ এগিয়ে চলেছে, তবে আরও দ্রুততর করার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। ইতিমধ্যে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাও চালু হয়েছে। দেশের সর্বত্র প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বই বিতরণ সুষ্ঠুভাবে করা হচ্ছে। কম্পিউটার বিতরণও এগিয়ে চলেছে। কোনো কোনো স্থানে ছেলেমেয়েদের ধরে রাখার জন্য দুপুরের খাবার ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে অথবা হচ্ছে।
শিক্ষানীতিতে বলা আছে, যে বিষয়গুলো সব ধারায় পাঠ্য, সেসব ক্ষেত্রে দেশজ আবহের সঙ্গে মিল রেখে পুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। এই কাজটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পন্ন করার দাবি রাখে। অবশ্য একটি বই লেখা হয়ে গেলেই কাজ শেষ তা নয়, ভবিষ্যতে পরিমার্জন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা যেতে পারে।
শিক্ষানীতির ভূমিকায়ই বলা হয়েছে, এ নীতিটিই শেষ কথা নয়, প্রয়োজনে সংশোধন বা সমৃদ্ধ করা হবে। আরও কতগুলো কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন। এর মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে সমন্বিত শিক্ষা আইন। এর প্রাথমিক খসড়া ইতিমধ্যে হয়েছে। তবে দ্রুত চূড়ান্ত করে সংসদে পাস করার ব্যবস্থা করা জরুরি। শিক্ষা আইন ছাড়া শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকবে। শিক্ষাকে শিশুদের অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুর অধিকার, শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে স্থায়ী শিক্ষা কমিশন সুপারিশ করতে পারে। প্রস্তাবিত স্থায়ী শিক্ষা কমিশন অনতিবিলম্বে গঠন করা দরকার।
অভিভাবক, শিক্ষা ব্যবস্থাপক, শিক্ষানীতি ও শিক্ষকের ভূমিকা রয়েছে। তবে শিক্ষকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এ জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগে বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন ও উন্নয়ন কমিশন গঠনে আর দেরি করা যাবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যাচাই ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানের ক্রমনির্ধারণে প্রস্তাবিত অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠনও জরুরি। শিক্ষার মান ও প্রক্রিয়া তদারকির জন্য প্রধান শিক্ষা পরিদর্শক কার্যালয় স্থাপনের যে প্রস্তাব শিক্ষানীতিতে রয়েছে তা স্থাপন করতে হবে।
আরেকটি কাজ জরুরি, শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতনভাতা নির্ধারণে যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের প্রস্তাব রয়েছে, সে বিষয়টিরও সুরাহা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
উপরোক্ত বিষয়ে বিভিন্ন কমিটিতে চিন্তা-ভাবনা চলছে। আমি আশা করব, এসব প্রক্রিয়া যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।
বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থায়ন, শিক্ষা প্রশাসন ও জনসচেতনতার কথা মনে রাখতে হবে। বর্তমানে জাতীয় আয়ের প্রায় ২.৩ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে যেখানে জাতীয় আয়ের মাত্র ১১ শতাংশ রাজস্ব আয়, সেখানে ৬ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় সম্ভব নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অন্যথায় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। আমার বিবেচনায় আগামী ৩-৪ বছরে ক্রমান্বয়ে এই বরাদ্দ ৪ শতাংশে উন্নীতি করার প্রচেষ্টা নিতে হবে। বাজেটে শিক্ষানীতি ২০১০-কে স্বীকৃতি দিয়ে তার বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। উল্লেখ্য, জাপানে ১৯০৬-১৯১১ সাল পর্যন্ত বাজেটের ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষায় ব্যয় হয়েছে। বাংলাদেশে আগামী বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা যেতে পারে।
শিক্ষা প্রশাসন প্রায় গতানুগতিকই থেকে গেছে। এক্ষেত্রে সংস্কার ও সমন্বয় একটি জরুরি বিষয়। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ও দেশে যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বক্তব্যে এবং কর্মকাণ্ডে এর প্রতিফলন দৃশ্যমান। পাশাপাশি শিক্ষা প্রশাসনকে গতিশীল করা এবং যে যে ক্ষেত্রে দুর্নীতি রয়েছে তা নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে কাঙ্ক্ষিত গতি আসবে না।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে জনসচেতনতা। স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষানীতি এবং সে আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষাদান প্রক্রিয়া ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি ও জনসম্পৃক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি। অবশ্য সব কাজ যে সরকার করবে, তা নয়। যেহেতু শিক্ষা আর্থ-সামাজিক, মানবিক অগ্রগতির মূল ভিত্তি, তাই দেশের সব নাগরিককে যার যার অবস্থান থেকে মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রসারে অবদান রাখতে হবে।

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ : কো-চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি, ২০১০
 

No comments

Powered by Blogger.