টঙ্গীতে ৬ মাসে খুন, ছিনতাই ডাকাতিসহ ৩৯৭ মামলা by এম. এ হায়দার সরকার

শিল্পনগরী টঙ্গীর আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। খুন, ছিনতাই, অপহরণ, ডাকাতি, চুরির মতো ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। এতে এলাকার মানুষ উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ভুগছে। নগরবাসীর মাঝে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক। এতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। একের পর এক খুনের ঘটনায় পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার। সামাল দিতে পারছে না খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ও অপহরণের মতো ঘটনা। গত ৬ মাসে টঙ্গীতে ১৩টি খুন, অসংখ্য ছিনতাই, একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটে। গত কয়েক দিনে ডাকাতিও খুনের ঘটনা পুলিশ প্রশাসনসহ নগরবাসীকে ভাবিয়ে তুলছে। টঙ্গীর আইনশৃঙ্খলা চরম অবনতি হয়েছে বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থারও দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা এবং তাদের তথ্য অনুযায়ী. পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মাদক ব্যবসা ও বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকায় দিন দিন অবনতি হচ্ছে টঙ্গীর আইনশৃঙ্খলা। সরকারের উচ্চমহল ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এলাকার আইনশৃঙ্খলার আরও মারাত্মক অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে গত ৬ মাসে টঙ্গী মডেল থানায় ১৩টি হত্যাসহ ৩৯৭টি মামলা হয়েছে। চলতি বছরের গত ২৫শে জানুয়ারি মরকুন পূর্ব পাড়ায় হিমেশ নামে এক স্কুলছাত্রের মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে এক সন্ত্রাসী। দত্তপাড়া এলাকার হাসান লেনে মাদক ব্যবসায়ীরা হাসান নামের এক ফার্নিচার কারখানার ম্যানেজারকে ৩০শে জানুয়ারি রাতে কুপিয়ে হত্যা করে। টঙ্গী থানা পুলিশ টঙ্গী বাজার এলাকার তুরাগ নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাত যুবকের (৩০) লাশ উদ্ধার করে। পুলিশের ধারণা, তাকে দুর্বৃত্তরা ২ মাস আগে হত্যা করে লাশ গুমের উদ্দেশে তুরাগ নদীতে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি পুলিশ বাদী হয়ে টঙ্গী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।
স্থানীয় খাপাড়া এলাকায় জাহাঙ্গীর নামের আরেক ব্যবসায়ীকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় ১৯শে মার্চ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশকে সহযোগিতা করার অপরাধে এরশাদনগর এলাকার সোর্স রাসেলকে ৬ই মে সন্ত্রাসীরা খবর দিয়ে নিয়ে ৭নং ব্লক বেড়িবাঁধ এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় রাসেলের মা সুরাইয়া বাদী হয়ে টঙ্গী মডেল থানায় ২১ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। রহস্যজনক কারণে কামরুল ওরফে কামু নামের স্থানীয় এক বিএনপির নেতাকে এ ঘটনায় জড়িয়ে পুলিশ হয়রানি করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগেও কামুকে মাদক মামলা দিয়ে হয়রানির চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনা জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করলে মাদক মামলা থেকে কামু অব্যাহতি পায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এসআই মোস্তাফিজ সোর্স রাসেল হত্যা মামলায় কামরুলকে জড়িয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করে জানান।
অপরদিকে গত ১৪ই মে মাছিমপুর এলাকায় মিলন বসাক নামের এক যুবককে হত্যা করা হয়। আরিচপুর আমজাদ আলী পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় রোডের একটি বাড়ি থেকে জেসমিন নামের এক স্কুলছাত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। গত ১৮ই মে এরশাদনগর এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে বুলবুল নামে এক ট্রাক ড্রাইভার খুন হন। এ ঘটনায় তার সহযোগী তাজেল গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় এরশাদনগর এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী গাডু জামাল, ফালান, গেদা রতন ও রহিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত ২২শে মে বেক্সিমকো রোডে আওয়ামী লীগ নেত্রীর ভাই এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী ইসমাইলের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত পুলিশকে সহযোগিতা করার অপরাধে সোর্স মমিনকে প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহত সোর্স মমিনের মা বাদী হয়ে টঙ্গী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে। এদিকে গত ১২ই জুন ঢাকার উত্তরার রিজেন্ট প্রাইভেট হাসপাতালের কর্মচারী রিংকু হোসেন ছিনতাইকারীর হাতে খুন হন। তার ভাড়া বাসা স্থানীয় গোপালপুর যাওয়ার পথে নতুনবাজার এলাকায় চিহ্নিত ছিনতাইকারীরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তার সর্বস্ব লুটে নেয়। পরে পথচারীরা তাকে উদ্ধার টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় জড়িত একজনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও মূল আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ব্যাপারে নিহতের পিতা বাদী হয়ে টঙ্গী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওইদিন একই সময় স্থানীয় স্টেশন রোড বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অপর ছিনতাইয়ের ঘটনায় আনোয়ার নামের এক ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। তাকে রাতেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।
গত ১৩ই জুন সকালে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের টঙ্গী কার্যালয়ের পেছনে আউচপাড়া এলাকার আমির হোসেন নূরানীর বহুতল ভবনের ৫ তলায় সৎমার হাতে সাদিয়া আলম জয়া নামের এক স্কুলছাত্রী খুন হয়েছে। সাদিয়া আলম জয়া টঙ্গী পাইলট উচ্চবিদ্যালয় এন্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ত। এদিকে গত ২২শে জুন স্থানীয় মিলগেট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মঙ্গল চাঁন নিহত হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছে আরও ৩ জন। আহতরা হলেন নিহত মঙ্গল চাঁনের ছোট ভাই ফালান, ইয়াসিন ও শাহান শাহ। এ ঘটনায় নিহতের মা সানোয়ারা বেগম বাদী হয়ে টঙ্গী মডেল থানায় এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মন্টু, বিপু ও নুরুজ্জামানসহ ৮ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
গত ২৩শে জুন টঙ্গী এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন মিয়া র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। ওই যুবক ডাকাতদলের সদস্য বলে জানিয়েছেন র‌্যাব সদস্যরা। মিলগেট ট্রাকস্ট্যান্ড এলাকায় চাঁদাবাজদের চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় এক ট্রাকচালকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেছে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় গুরুতর আহত ট্রাক চালক নুরনবীকে রাজধানীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নতুনবাজার আল-মদিনা রাইস স্টোরে গত ৭ই মার্চ ভোররাতে এক দুর্ধর্ষ ডাকাতি করে। ডাকাতরা এলাকার নাইট গার্ডদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ টাকাসহ প্রায় লাখ টাকার মালামাল নিয়ে যায়।
গত ৫ই মার্চ স্থানীয় মধুমিতা এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে গ্রামীণফোনের গাজীপুর জেলার পরিবেশক মোবারক ট্রেডার্সের বিক্রয় প্রতিনিধিকে গতিরোধ করে ৬ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুবৃর্ত্তরা। স্থানীয় জনতা কথিত সাদা পোশাকের দুই গোয়েন্দাকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ব্যবহৃত মাইক্রোবাস (ঢাকা- মেট্রো-চ-১৩-১৫০৬) তল্লাশি করে একটি ওয়াকিটকি সেট, একটি হাতকড়া, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সাংবাদিক লেখা বেশ কয়েকটি স্টিকার উদ্ধার করে টঙ্গী মডেল থানা পুলিশ।
গত ৮ই মার্চ গার্মেন্ট কারখানায় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সুমি নামের এক যুবতীকে অপহরণের করে দুর্বৃত্তরা। অপহরণকারীরা বিভিন্ন মোবাইল নাম্বার থেকে সুমির স্বজনদের কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এ ঘটনায় জড়িত অপহরণচক্রের সদস্য সুমি আক্তারকে আটক করেছে টঙ্গী থানা পুলিশ।
গত ২০ই মার্চ ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় দুগ্রুপে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া ও গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষে ৩ জন আহত হয়।
গত ৫ই জুন দুপুরে টঙ্গীর স্টেশনরোড এলাকায় পরিবহনে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুবলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, মহাসড়ক অবরোধ ও যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ সময় যুবলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় উভয় গ্রুপের কমপক্ষে ১৫-২০ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সাজুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় ও রাসেল শেখকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় পুলিশ যুবলীগ নেতা পাইপ ফারুককে আটক করে।
চেরাগ আলী এলাকায় গত ১৯শে জুন রাত ১১টায় একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী মুরগি ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে নগদ ২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ সময় ছিনতাইকারীদের চাপাতির কোপে দুই ব্যবসায়ী গুরুতর আহত হয়। গত ২রা জুলাই মিলগেট সোনালি টোব্যাকো রোডে একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা চাঁদা না দেয়ায় মাসুদ রানা ও রনিকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। গুরুতর আহত মাসুদকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। গত ১৬ই জুন ইজতেমা এলাকায় মন্নু রোডে কামারপাড়া সেতু সংলগ্ন এলাকায় গণডাকাতির কবলে পড়েন শিল্পপতি নাজমুল হক। তিনি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভোগড়া এলাকার গরিব অ্যান্ড গরিব সোয়েটার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ডাকাতরা গার্মেন্ট মালিক নাজমুলের গড়ির গতিরোধ করে হামলা চালায় এবং কাঁচ ভেঙে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ ২ লাখ টাকা, ১৬ রাউন্ড গুলিসহ একটি লাইসেন্স করা পিস্তল, দুটি মোবাইল সেট ও একটি টেপ লুটে নেয়। একই সময় তার পিছনে থাকা আরেকটি চাইনিজ কোম্পানির গাড়ি গতিরোধ করে নগদ ২ হাজার ৫শ ডলার, ২ লাখ টাকাসহ ৫ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। পুলিশ এক সপ্তাহের মধ্যে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারসহ মালামাল উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ চাঞ্চল্যকর ডাকাতির ঘটনা উদঘাটন করে মালামাল উদ্ধারসহ আসামিদের গ্রেপ্তার করায় টঙ্গী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আলী, এস আই মিজানুর রহমান ও এসআই আতাউর রহমান এলাকাবাসীর কাছে প্রশংসিত হয়েছেন।  অপরদিকে গত ১৭ই জুন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মুদাফা এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ছয় লাখ টাকা ছিনতাই হয়। ছিনতাইকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে বিকাশ কর্মী আনোয়ার ও সাইফুল গুরুতর আহত হয়।
এছাড়া গত দুই মাসে ২০টি হোন্ডা চুরিসহ প্রায়  ১শ’ চুরির ঘটনা ঘটে। একের পর এক ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ভাবিয়ে তুলছে প্রশাসনসহ নগরবাসীকে। এ ব্যাপারে টঙ্গী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘বিগত দিনের তুলনায় বর্তমানে টঙ্গীর আইনশৃঙ্খলা ভাল আছে।’ তিনি মানবজমিনকে আলও বলেন, ‘টঙ্গী একটি ঘনবসতি পূর্ণ বস্তি অধ্যুষিত এলাকা। এ এলাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধীরা এসে ছদ্মনামে বসবাস করে। তারা সুযোগ বুঝে বিভিন্ন অপকর্ম করে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ কারণে অপরাধ সংঘটিত হলেও অপরাধীদের সহজে ধরা যাচ্ছে না। তারপরও এর মধ্যে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের ধরতে সক্ষম হয়েছি। বাকি অপরাধীদের ধরার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.