পারিবারিক সহিংসতা অপরাধ -প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

প্রথম আলোর কার্যালয়ে গতকাল আয়োজিত ‘পারিবারিক
সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০: প্রয়োগ
ও কার্যকারিতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ দেশে প্রচলিত অন্যান্য আইনের তুলনায় আধুনিক ও আলাদা। কিন্তু আইনটির উপকারভোগী ও বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ অনেক সময় পুরোনো ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার জন্য অনেক সময় এর সুষ্ঠু প্রয়োগ হয় না। প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে গতকাল বৃহস্পতিবার এ মন্তব্য করেন আলোচকেরা। বৈঠকটিতে সহযোগিতা করেছে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল।
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০-এ প্রথমবারের মতো পারিবারিক সহিংসতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আইনে সহিংসতার শিকার নারী ক্ষতিপূরণ পান। এ আইনের বলে বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত নারী যে বাড়িতে বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতে থাকতে পারেন। কেবল আদালতের নিষেধ অমান্য করলে অপরাধী কঠোর শাস্তি পেয়ে থাকে। এ ছাড়া অপরাধীকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সমাজকল্যাণমূলক কাজে যুক্ত থাকার নির্দেশও দিতে পারেন আদালত। আইনটি প্রণয়নের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা বলছেন যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা সংসার করতে চান। সহিংসতার শিকার নারী এ আইনের সুবিধা পেলে সংসারেই নিরাপদে ও সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারেন। নয়তো শান্তিপূর্ণভাবে আলাদা হয়ে যেতে পারেন।
গতকাল গোলটেবিল বৈঠকে কয়েকজন আলোচক বলেন, বিচারকদের কেউ কেউ বিচার বলতে এখনো শাস্তি ও খালাস বোঝেন। পুলিশ অভিযোগের কথা শুনলেই গ্রেপ্তার বোঝে। আইনজীবীরা আর সব মামলার মতো এটিকেও ঝুলিয়ে রেখে টাকা উপার্জন করতে চান। বাদী-বিবাদী মামলা বলতেই বোঝেন জেল-জরিমানা। যে বিচারক চুরি-ডাকাতি-খুনের বিচার করেন, তিনিই পারিবারিক সহিংসতার অভিযোগ শোনেন। মামলা ঝুলে থাকে।
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক (জেলা জজ) মালিক আব্দুল্লাহ আল-আমিন বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনা মূল্যে হতদরিদ্রদের আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়। যাঁরা এই সাহায্য নেন, তাঁদের মামলার নথির ওপরে লিগ্যাল এইড কর্মকর্তারা একটি স্টিকার দিয়ে দেন। এটি দেখলে বিচারকেরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন। পারিবারিক সহিংসতা আইনে যে মামলা হবে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, অভিযোগ জানানোর সুযোগ যত বাড়বে, নারীরাও তত বেশি আইনটির সুফল পাবেন। পারিবারিক সহিংসতার অভিযোগ যাতে নারীরা স্বচ্ছন্দে জানাতে পারেন এবং পৃথক আদালতে দ্রুত অভিযোগের সুরাহা হয়, সে উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন শাহনাজ হুদা বলেন, গ্রাম্য আদালত নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু এই আদালতে নারীরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। জেলা জজ পর্যায়ের বিচারককে দিয়ে আলাদা আদালতে মামলা চললে সহজে নিষ্পত্তি হতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, সরকার আইন করেছে। এখন বড় এনজিওগুলো দায়িত্ব নিলে মানুষ আইনটি সম্পর্কে জানতে পারে। তিনি মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে একসঙ্গে বসে আইনের দুর্বলতা খুঁজে বের করে সুপারিশ করার অনুরোধ জানান।
বিএনডব্লিউএলএর আইন সহায়তা বিভাগের পরিচালক তৌহিদা খন্দকার তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, প্রটেক্টিং হিউম্যান রাইটস (পিএইচআর) প্রোগ্রামের আওতায় দেশের আটটি জেলার আটটি উপজেলার ১০২টি ইউনিয়নে কাজ চলছে। যেসব জায়গায় কাজ চলছে, সেসব জায়গায় নারীদের মামলা করার হার বেড়েছে। যেমন বগুড়ার তিনটি উপজেলায় ৫০টি মামলা হয়েছে। অন্যদিকে যে নয়টি উপজেলায় কাজ চলছে না, সেখানে মামলা হয়েছে ১০টি।
জেলা আইনগত সহায়তা প্রদানকারী কর্মকর্তা সাব্বির মাহমুদ চৌধুরী আইনজীবীদের আরও সচেতন হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা, এনজিও প্রতিনিধি, আইনজীবী ও পুলিশের যে দলটি কাজ করবে, তাদের মধ্যে সমন্বয় থাকা দরকার।
আমরাই পারি, পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের জাতীয় সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীকে সহযোগিতা করতে যেসব প্রতিষ্ঠান সেবা দিয়ে থাকে, তারা একযোগে কাজ করে। সাধারণত আদালতেরই একটি অংশে ওই ইউনিটটির অফিস থাকে।
সিলেটের বালাগঞ্জের উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা গৌরাঙ্গ চন্দ্র মণ্ডল বলেন, প্রায়ই অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশকে ‘অনুরোধ’ করে আদালতের মালামাল ক্রোকের নির্দেশ দেরিতে পাঠান। এতে করে অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্পদ সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পান। এ ছাড়া মালামাল কীভাবে নারী নেবেন, তার খরচ কে দেবে—এসব বিষয়ে আইনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ নেই।
কেয়ার বাংলাদেশের নারী ও কন্যাশিশুর ক্ষমতায়ন বিভাগের পরিচালক হোমায়রা আজিজ বলেন, সহিংসতার শিকার নারীকে আদালত যে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন তা যথেষ্ট কি না সেটি একটি প্রশ্ন। কেয়ার বাংলাদেশ সহিংসতার ক্ষতি নিরূপণের কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ পদ্ধতিগুলো কাজে আসতে পারে।
সিলেটে পিএইচআর প্রোগ্রামের প্যানেল আইনজীবী সৈয়দা শিরীন আকতার বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই মামলায় অভিযোগের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিতে হয়েছে। দেনমোহর বা খোরপোষের জন্য আদালতে গেলে নারীরা অনেক সময় দীর্ঘসূত্রতার শিকার হন। কিন্তু সালিস করে শুধু বালাগঞ্জ উপজেলা থেকে তাঁরা ১ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা খোরপোষ আদায় করা সম্ভব হয়েছে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের পিএইচআর প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক ফারহানা আফরোজ জানান, পিএইচআর প্রোগ্রাম একটি পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মসূচি। বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতার হার কমিয়ে আনতে এই কর্মসূচি চলছে।

No comments

Powered by Blogger.