বাংলাদেশে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন by তানজির আহমেদ রাসেল

নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কে বৃটিশদের সতর্ক করেছে সেদেশের সরকার। বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করতে এসে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে সে বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করে এ সতর্কতা দেয়া হয়েছে। বৃটিশ সরকারের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের ‘ওভারসিজ বিজনেস রিস্ক : বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকারসহ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা দুর্বল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অনিয়ম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন। রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সম্পর্ক নাজুক। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংঘাতময় অবস্থায় রয়েছে। এদেশে রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে এ দুটি দল। এখানে ঘুষ, দুর্নীতি ব্যাপক। বেসরকারি খাতে কার্যকর উন্নয়নে বাধা হিসেবে দেখা হয় দুর্নীতিকে। এতে ব্যবসায় ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। এ ঝুঁকির বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা নীতি নিতে হবে। রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এমনকি ভয়াবহভাবে আইন লঙ্ঘনের বিষয় প্রকাশ্যে এসেছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ঘুষ এবং দুর্নীতির ব্যাপক চর্চা হয়। এ কারণে সরকারি বেসরকারি অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কাঙ্ক্ষিত ফল আসে না। রাজনীতিক, আমলা এবং আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সদস্যরা প্রায়ই তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি করেন। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি, মানবাধিকার, ঘুষ ও দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি, নিরাপত্তা সম্পর্কে তথ্য দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী এবং বিনিয়োগ করেছেন তাদের জন্য পরামর্শ দিয়ে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্র এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতির দেশ। দুইটি প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। দল দুইটির মধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক দুর্বল। দল দুইটির মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান বিরাজমান এবং তাদের রাজনৈতিক ধারা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকারসহ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা দুর্বল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে তার দল নিরঙ্কুশ ভোট নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে। অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করলে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। ওই সময়ের বিরোধী দল (বিএনপি) নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছিল। কিন্তু এর আগে ২০১১ সালের জুনে বিতর্কিতভাবে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথা বাতিল করা হয়। ফলে বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করায় বর্তমানে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকলেও ক্ষমতাসীন সরকারের অংশ। এমনকি তারা মন্ত্রিত্বের পদও পেয়েছে। সর্বশেষ এ বছরের এপ্রিলে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিএনপির ওই নির্বাচনের মাঝপথ থেকে ফিরে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী হয়েছে। এতে ২০০৫ সালে দারিদ্র্য যেখানে শতকরা ৪০ ভাগ ছিল তা ১০ ভাগ কমে ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩০ ভাগ। এ বছরের প্রথম ৩ মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রচুর ক্ষতি করেছে। এ বছর ৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং আগামী বছরে ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করছেন দেশটির নীতি-নির্ধারকরা। যেখানে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৫ থেকে ৬ শতাংশ। অর্থনীতির উন্নয়নে বাংলাদেশ দরিদ্রতার হার উল্লেখজনকভাবে কমাতে সক্ষম হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দরিদ্রতাকে বিদায় করতে চায় এবং মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে চায়। বৈদেশিক মুদ্রা দেশটির অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিচ্ছে। আইনের প্রয়োগ, ন্যায়বিচার এবং বিচারবর্হিভূত হত্যা সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন (আইসিসিপিআর), অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আইন (আইসিইএসসিআর), শিশু অধিকারসহ (সিআরসি) বাংলাদেশ মৌলিক আন্তর্জাতিক আইনগুলোর সংস্কার করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সঠিক আইনের প্রয়োগ এবং চর্চা দুর্বল। বাংলাদেশে ন্যায়বিচার পাওয়া খুবই কঠিন। বাংলাদেশে আইনের প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন দুর্বল। বিচারিক আদালতে অনেক বছর আগের প্রচুর মামলার জট পাকিয়ে আছে। বাংলাদেশের আইনে এখনও শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে স্থান করে নিয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ৮০ শতাংশই আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে। বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির ১২ শতাংশই এই খাতের। কিন্তু ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির কারণে এ খাতের উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসে নি। ওই ঘটনায় এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক প্রাণ হারান। পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিনিয়োগকারীদের চাপ এবং সহায়তায় বাংলাদেশ শ্রম পরিবেশ এবং কারখানার অবকাঠামো ঝুঁকিমুক্ত করতে কাজ করেছে। কেননা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্যকর শ্রম পরিবেশ প্রয়োজন। বাংলাদেশে ঘুষ এবং দুর্নীতির ব্যাপক চর্চা হয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘুষ এবং দুর্নীতির কারণে সরকারি-বেসরকারি অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেরই কাঙ্ক্ষিত ফল আসে না। রাজনীতিক, আমলা এবং আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সদস্যসরা প্রায়ই তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি করেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির তালিকায় ২০১৪ সালে বিশ্বের ১৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৫। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচনগুলোতে সংঘটিত অনিয়মের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় নির্বাচন কমিশনের একটি চলমান প্রকল্প থেকে অন্য দাতা দেশগুলোর সঙ্গে এ মাসে আর্থিক সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাজ্য। এ মাসের পর ওই প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যাবে বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে। যার মেয়াদ ছিল আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত।

No comments

Powered by Blogger.