পাকিস্তানে ইসলামের নামে তালেবান ক্রিমিনালদের শিশু হত্যাকাণ্ড by বদরুদ্দীন উমর

দুনিয়াজুড়ে বিশৃংখলা ও অশান্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, দুনিয়া এখন হিংসায় উন্মত্ত। কিন্তু আসলে দুনিয়ার জনগণ হিংসায় উন্মত্ত নয়। যারা দেশে দেশে জনগণের ওপর নিজেদের শোষণ-নির্যাতন বৃদ্ধি করে চলেছে, তারাই চারদিকে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে হিংসার আগুন সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে জনগণের জীবন বিপন্ন ও তাদের শান্তি নষ্ট করছে।
বিগত ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পেশোয়ারে জঙ্গিরা ইসলামের নামে একটি স্কুলে সশস্ত্র হামলা করে ১৩০ জন শিশু এবং আরও দশ-বারোজনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আহত হয়েছে অনেকে। এ হত্যাকাণ্ড শুরুর সময় ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ ক্লাস করছিল। কেউ কেউ পরীক্ষায় বসেছিল। স্কুলটি সামরিক বাহিনী পরিচালনা করে এবং তাতে সামরিক বাহিনীর লোকদের সন্তান ছাড়া বেসামরিক ব্যক্তিদের ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া করে। ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট আদমজী স্কুলের মতো।
উল্লেখ করা দরকার, পেশোয়ারের এ স্কুলে যার নির্দেশে এ হামলা পরিচালনা করা হয়েছে সেই মোল্লা ফজলুল্লাহ সোয়াতে মালালা ইউসুফজাইকে স্কুল বাসের মধ্যে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল এবং তারা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় গুলি করেছিল। এখন সে উপরোক্ত স্কুলটিতে হামলা চালিয়ে এ কাজের সাফাই হিসেবে বলেছে যে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কর্তৃক তাদের লোকদের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই তারা এটা করেছে! অন্য কথা বাদ দিয়েও যারা তাদের লোককে হত্যা করেছে তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য তাদের মাসুম বাচ্চাদের হত্যার যৌক্তিকতা কোনো সুস্থ ও মানবিক চেতনাসম্পন্ন মানুষই স্বীকার করতে পারেন না। কারণ এটা সর্বাংশে একটা অপরাধমূলক কাজ। সাধারণ ক্রিমিনালদের থেকে গুণগতভাবে এর কোনো পার্থক্য নেই, তবে সাধারণ অপরাধ থেকে এ অপরাধ সামাজিক দিক দিয়ে হাজার গুণ বেশি বিপজ্জনক।
পাকিস্তান তালেবান বাহিনীর নেতা এই মোল্লা সামরিক বাহিনীর লোকদের শাস্তি দেয়ার জন্য এ হত্যাকাণ্ড করার কথা বলেছে। কিন্তু এর আরেকটি বড় কারণ তারা সাধারণভাবে নারী শিক্ষাবিরোধী। মালালা যেহেতু তার এলাকায় নারী শিক্ষার এক প্রবক্তা ছিল এবং এদিক দিয়ে তার একটা পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা গড়ে উঠেছিল, এ কারণে কৌশল হিসেবে নারী শিক্ষা বন্ধের জন্য মোল্লা ফজলুল্লাহ মালালাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। মালালা নিহত না হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় পাকিস্তানে ও পরে ইংল্যান্ডে চিকিৎসার পর সুস্থ হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য, পরে মালালাকে সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের প্রচারের কাজে ব্যবহার করেছে, এমনকি তাকে নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত পাইয়ে দিয়েছে! কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তালেবান মোল্লা বাহিনী নারী শিক্ষার প্রবক্তা হিসেবেই তার ওপর হামলা করেছিল।
ইসলামী সন্ত্রাসীদের তৎপরতা এখন মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপকভাবে চলছে। এর দ্বারা ইসলামী মূল্যবোধ বলে যা কিছু বোঝায় তার ক্রমাগত অবক্ষয় ঘটছে। কোরআন, হাদিস বা বিখ্যাত ইসলামী ধর্মগুরুদের শিক্ষার মধ্যে এমন কিছু নেই যা দিয়ে ইসলামী সন্ত্রাসীদের এ তৎপরতাকে ব্যাখ্যা বা যুক্তিযুক্ত করা যায়। শুধু মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে নয়, অস্ট্রেলিয়ায় এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশে, বিশেষত ব্রিটেনে তারা সাম্রাজ্যবাদীদের শাস্তি দেয়ার জন্য নিরীহ লোকজনকে আÍঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করছে। কিন্তু এর দ্বারা সাম্রাজ্যবাদীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। উপরন্তু এ দেশগুলোতে সরকার যুদ্ধ ও অস্ত্র নির্মাণ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে সামরিক শিল্প পুঁজির মুনাফা বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশে দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা সামরিক হামলা চালিয়ে ইসলামী সন্ত্রাসীদের ধ্বংস তো নয়ই, বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্তও করতে পারেনি। বরং শক্তিশালী করে তাদের সমর্থক এবং অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি করেছে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণে অজুহাত সৃষ্টি এবং অস্ত্র বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যেই তারা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ও ওয়াশিংটনে বিমান হামলা করেছিল। প্রচণ্ড ও ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে নিজেদের এ চক্রান্ত আড়াল করার উদ্দেশ্যে তারা আল কায়দায় নেতা বিন লাদেনকে এর জন্য দায়ী করেছিল। সেই হামলার পর মার্কিন কংগ্রেস, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ অথবা অন্য কোনো সরকারি সংস্থা কোনো তদন্ত কমিশন গঠন করেনি এবং বিন লাদেনই যে সেই অপরাধের জন্য দায়ী এর সামান্য প্রমাণও তারা হাজির করতে পারেনি, যেমন তারা পারেনি ইরাক আক্রমণের অজুহাত হিসেবে সেখানে গণহত্যাকারী অস্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে। এ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও প্রগতিশীল মহলে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ২০০১ সালের সেই চক্রান্তের পর থেকে দুনিয়ায় ইসলামী জঙ্গি তৎপরতা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এ বিষয়টি উপেক্ষা করে ইসলামী সশস্ত্র তৎপরতা বর্তমানে যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দিকে তাকালে দেখা যাবে, আল কায়দা থেকে নিয়ে দেশে দেশে ইসলামী সন্ত্রাসীদের জন্ম ও উত্থানের শর্তই শুধু তারা তৈরি করেনি, তারা তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য-সহযোগিতাও করে এসেছে। এভাবে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে একদিকে তারা যেমন রাজনৈতিক ফায়দা উঠানোর চেষ্টা করেছে, তেমনি নিজেদের সামরিক শিল্প পুঁজির স্বার্থে অস্ত্র বাণিজ্য সম্প্রসারিত করেছে। নিজেদের সামরিক খাতে ক্রমাগত ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা খাড়া করেছে। ইসলামী সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে মার্কিন সরকারের ও তাদের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইয়ের সম্পর্কের অনেক দৃষ্টান্তই আছে, যার সর্বশেষ হল ইরাক ও সিরিয়া ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ নামে মারাত্মক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হঠাৎ উত্থান। ইরাকের শিয়া নেতারা অনেকে এবং খোদ ইরাকি সরকারের কোনো কোনো মুখপাত্র বলেছেন, এ শক্তির জন্মদাতা ও মদদদাতা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারাই এ শক্তিকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থে। এতদিন সিরিয়ায় তারা সরাসরি সামরিক হামলা চালাতে পারেনি, যেমন তারা করেছিল লিবিয়ায়। এখন ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে নিজেদের দখল ও শক্তি সংহত করায় ইসলামী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মধ্যপ্রাচ্যয়ী কয়েকটি মক্কেল রাষ্ট্রকে নিয়ে জোট গঠন করে সিরিয়ায় হামলা করছে। এ যুদ্ধের জন্য মার্কিন কংগ্রেস মাত্র কয়েকদিন আগে তাদের সামরিক বাজেটের আকার অদৃষ্টপূর্বভাবে বৃদ্ধি করেছে। এ সবই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। কাজেই আজকের দুনিয়ায় ইসলামী সন্ত্রাসীদের উত্থান ও তৎপরতার শর্ত প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন শোষণ, নির্যাতন, দখলদারিত্ব ইত্যাদির দ্বারা তৈরি হলেও তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এর মধ্যেই তারা নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দার ব্যবস্থা করেছে, দেশে দেশে সামরিক হামলা করেছে এবং অস্ত্র বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে।
পেশোয়ারের স্কুলের শিশুদের ওপর তালেবানদের সশস্ত্র হামলার প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলা দরকার, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবানরা অভিন্ন সংগঠন না হলেও তারা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। আফগানিস্তানে রুশ দখলদারির সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সেখানে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তালেবানদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সঙ্গে চক্রান্ত করে তারা পেশোয়ার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তালেবানদের শিক্ষার নামে তাদের সশস্ত্র শক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছিল। বিন লাদেন পরে তাদের বিরুদ্ধে গেলেও সন্ত্রাসী হিসেবে তার সৃষ্টিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাজ। জিয়াউল হকের সময় থেকেই পাকিস্তান আফগান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় পাকিস্তানে বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ হয়। তারই জের ধরে পরে স্বাধীন সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে পাকিস্তানি তালেবান। শুধু তাই নয়, এরা পরিণত হয় আফগান তালেবানদের থেকেও বিপজ্জনক শক্তিতে।
পরে নানা কারণে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তালেবানদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে, যে কারণগুলোর উল্লেখ এখানে প্রয়োজন নেই এবং এ স্বল্প পরিসরে তা সম্ভবও নয়। সরকার ও তালেবানদের মধ্যে সংঘর্ষের পরিস্থিতি দেখা দেয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তালেবানদের দমনের নীতি গ্রহণ করে।
পেশোয়ারের স্কুলে সশস্ত্র হামলা এবং সেখানে শতাধিক নিরপরাধ শিশু হত্যার ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর হওয়ার মতো শক্তি তালেবানদের নেই। পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে যে ধর্মচর্চা হচ্ছে তার মধ্যে তালেবানের মতো শক্তির বিকাশের কোনো শর্ত নেই। বিকাশ হচ্ছে না। ১৬ ডিসেম্বর তারা যেভাবে শিশু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সামরিক বাহিনীকে শাস্তি দান ও শায়েস্তা করার পথ গ্রহণ করেছে, তার থেকেই প্রমাণিত হয় তারা কতখানি জনবিচ্ছিন্ন। তাদের এই কাপুরুষোচিত অপরাধ দুনিয়ার সর্বত্র এবং বিশেষত পাকিস্তানে তাদের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তার থেকেই প্রমাণিত হয়, সশস্ত্র উপদ্রব হিসেবে কিছুদিন টিকে থাকলেও তাদের দ্বারা পাকিস্তানে ‘খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.