প্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চনা আইন ও বিধি কী বলে by মো. ফিরোজ মিয়া

পদোন্নতির অন্তর্নিহিত অর্থ হল চাকরিতে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিকে উচ্চতর পদে ও উচ্চতর বেতন স্কেলে নিয়মিতভাবে পদায়ন। পদোন্নতির দ্বারা পদবি ও গ্রেড বা উভয়ের উন্নতি ঘটে এবং পদোন্নতির ফলে একজন কর্মচারী সর্বদাই উচ্চতর পদে, গ্রেডে বা মর্যাদায় আসীন হয়। পদোন্নতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক মনোবল বজায় রাখার স্বার্থে উচ্চতর পদে সম্ভাব্য অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিকে পদায়ন। পদোন্নতির দ্বারা জনস্বার্থ রক্ষা করতে হয়, কোনো ব্যক্তি বা কোনো শ্রেণী বা কোনো দলের স্বার্থ নয়। যোগ্য প্রার্থীর যুক্তিসঙ্গত সুযোগ পাওয়া, পদ শূন্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেধাক্রম অনুসারে উচ্চতর পদে পদোন্নতি লাভ করা এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে অধিকতর মেধাসম্পন্ন প্রার্থী বাছাইয়ের দ্বারা জনস্বার্থ রক্ষা হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রশাসনে পদোন্নতিতে জনস্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কিনা এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এছাড়া পদোন্নতিতে বঞ্চনার বিষয়টি বর্তমানে অধিক আলোচিত। পদোন্নতিতে বঞ্চনা আগেও ছিল, এখনও আছে, তবে দিনকে দিন এর মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে তা সীমা লংঘন করে গেছে। আগে প্রশাসনে সৎ, দক্ষ ও নিরপেক্ষ কোনো কর্মকর্তা কোনোরূপ বঞ্চনার শিকার হলে অন্য কর্মকর্তারা ওই বঞ্চনার অবসানের উদ্যোগ নিতেন। কিন্তু এখন অন্যকে বঞ্চিত করে নিজের সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য কর্মকর্তারা প্রতিযোগিতা করেন। নিজের চেয়ে দক্ষ, সৎ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তা পদোন্নতির বঞ্চনার শিকার হলে পদোন্নতিপ্রাপ্ত বিবেকবান ভালো কর্মকর্তারা আগে নিজের পদোন্নতির জন্য লজ্জা পেতেন, কিন্তু এখন কেউ লজ্জাবোধ করেন না, নিজের পদোন্নতির জন্য গর্ববোধ করেন। তাহলে প্রশাসন কী লজ্জাহীনতার সংস্কৃতির দিকে এগোচ্ছে, এর কি কোনো প্রতিকার নেই, এসব প্রশ্ন জনমনে দেখা দিয়েছে। এছাড়া পদোন্নতি না পাওয়াই কি পদোন্নতিবঞ্চনা? পদোন্নতি না পাওয়া সবাই কি পদোন্নতিতে বঞ্চনার শিকার? প্রশাসনের সর্বস্তরে পদোন্নতিবঞ্চনার বিষয়টি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয়ায় আদৌ পদোন্নতিতে বঞ্চনার ঘটনা ঘটছে কিনা এবং পদোন্নতি বঞ্চনা কী এবং এর আইনগত দিকটাই কী এ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। পদোন্নতিবঞ্চনার সঙ্গে সঙ্গে কোনো কর্মচারী পদোন্নতি অধিকার হিসেবে দাবি করতে পারে কিনা এ বিষয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সাধারণভাবে মেধার ভিত্তিতে উচ্চতর পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো কর্মচারী জ্যেষ্ঠতার কারণে কনিষ্ঠের পদোন্নতির তারিখ থেকে অধিকার হিসেবে পদোন্নতি দাবি করতে পারেন না। এক্ষেত্রে চাকরি সন্তোষজনক হওয়াই যথেষ্ট নয়। কোনো কর্মচারী অধিষ্ঠিত পদে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলেও উচ্চতর পদের জন্য যোগ্য নাও হতে পারেন। তবে বাছাই প্রক্রিয়া দূষিত বা পক্ষপাতিত্বমূলক হলে কনিষ্ঠের পদোন্নতির তারিখ থেকে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার পদোন্নতির অধিকার জন্মে। এছাড়া বলা যায়, পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জনকারীর জ্যেষ্ঠতা বাধা না হলে পদোন্নতি করুণা নয়, অধিকার। দলীয় বিবেচনায় বা বিরাগবশে বা দলীয় আনুগত্য কর্মচারীদের পদোন্নতি প্রদানের স্বার্থে নিরপেক্ষ ও যোগ্য কর্মচারীকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কোনোক্রমেই কাম্য নয়।
সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত আইন দ্বারা অথবা উক্ত অনুচ্ছেদের শর্তাংশে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত বিধি দ্বারা পরিচালিত হয়। উক্তরূপ আইন বা বিধির অবর্তমানে পদোন্নতির জন্য প্রশাসনিক নির্দেশনা জারি করা যায়। কিন্তু আইন বা বিধি বিদ্যমান থাকার ক্ষেত্রে আইন বা বিধিপরিপন্থী বা উক্ত আইন বা বিধিকে অতিক্রম করে বা সংশোধন করে কোনো প্রশাসনিক নির্দেশনা জারি করা যায় না। আইন বা বিধি থাকা সত্ত্বেও সরকার পদোন্নতির মানদণ্ড নির্ধারণ করতে পারেন। তবে এ মানদণ্ড আইন ও বিধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হয়। অর্থাৎ একই পর্যায়ের এক কর্মচারীর জন্য একরূপ মানদণ্ড এবং অপর কর্মচারীর জন্য অন্যরূপ মানদণ্ড নির্ধারণ করা যায় না। এ মানদণ্ড নির্ধারণে যে নীতি অনুসরণ করা হয়। তা হল, জ্যেষ্ঠতার নীতি অথবা জ্যেষ্ঠতা তথা মেধার নীতি অথবা মেধা তথা জ্যেষ্ঠতার নীতি অথবা মেধার নীতি। সাধারণভাবে উচ্চতর পদগুলোতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা তথা জ্যেষ্ঠতার নীতি অথবা মেধার নীতি অনুসরণ করা হয়।
বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতি সরকারের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা, ২০০২ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উক্ত বিধিমালা অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সুপারিশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন গ্রহণ করে সরকারের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। বিধিমালা অনুযায়ী পদোন্নতির ভিত্তি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। অর্থাৎ প্রশাসনের উচ্চতর ওই পদগুলোতে পদোন্নতির মানদণ্ড হচ্ছে মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। এছাড়া বিধিমালা অনুযায়ী যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব কিংবা সচিব পদে পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সমগ্র চাকরি জীবনে পালনকৃত দায়িত্বের গুরুত্ব ও প্রকৃতি এবং তার ব্যক্তিগত সুনামসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করা হয় এবং যুগ্মসচিব পদের ক্ষেত্রে তা যথাসম্ভব তার সমগ্র জীবনের সার্ভিস রেকর্ড এবং সব বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিচার্য হয়।
তবে পদোন্নতির অন্যান্য যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলায় কোনো অভিযোগ বিবরণী জারি করা হলে বা তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় অভিযোগ গঠন করা হলে কিংবা তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলায় সরকারি মঞ্জুরি প্রদান করা হলে ওই কর্মকর্তা কোনোভাবেই উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব বা সচিব পদে পদোন্নতির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।
পদোন্নতি বিধিমালা অনুযায়ী পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জনকারী কর্মকর্তারাই কেবল উচ্চতর পদে পদোন্নতি পেতে পারেন। উক্ত বিধিমালা অনুযায়ী উপসচিব পদে পদোন্নতির প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হল সিনিয়র স্কেলে ৫ বছরের চাকরিসহ সংশ্লিষ্ট ক্যাডারে অন্যূন ১০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা, বুনিয়াদি ও বিভাগীয় প্রশিক্ষণ সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা, আইন ও বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং মোট মূল্যায়ন নম্বর ১০০ (একশত)-এর মধ্যে কমপক্ষে ৮৩ নম্বর অর্জন। এ যোগ্যতা অর্জনকারী কোনো কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠতাক্রম অনুযায়ী পদোন্নতি প্রাপ্য হলে তাকে উপসচিব পদে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করার কোনো আইনগত বা বিধিগত সুযোগ থাকে না।
যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হল উপসচিব পদে ৫ বছরের চাকরিসহ সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের সদস্য হিসেবে অন্যূন ১৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা অথবা অন্যূন ৩ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ক্যাডার পদে অন্যূন ২০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা, এসিএডি প্রশিক্ষণ কোর্সে মনোনয়ন দেয়া হলে তা সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা এবং কমপক্ষে ৮৫ মূল্যায়ন নম্বর অর্জন। এছাড়া বিধিমালা অনুযায়ী যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সমগ্র চাকরি জীবনে পালনকৃত দায়িত্বের গুরুত্ব ও প্রকৃতি এবং তার ব্যক্তিগত সুনামসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করা হয় এবং তা যথাসম্ভব তার সমগ্র জীবনের সার্ভিস রেকর্ড এবং সব বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হয়। জ্যেষ্ঠতাক্রম অনুসারে প্রাপ্য হলে সার্ভিস রেকর্ড ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে উল্লেখিত নেই এমন কোনো কারণে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করার কোনো আইনগত বা বিধিগত সুযোগ থাকে না।
অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হল যুগ্মসচিব পদে ৩ বছরের চাকরিসহ অন্যূন ২০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা অথবা অন্যূন ২ বছরের অভিজ্ঞতাসহ অন্যূন ২২ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা, সরকার নির্ধারিত স্টাফ কোর্সে মনোনয়ন দেয়া হলে তা সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা এবং কমপক্ষে ৮৫ মূল্যায়ন নম্বর অর্জন। অপরদিকে সচিব পদে পদোন্নতির প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হল অতিরিক্ত সচিব পদে অন্যূন ২ বছরের চাকরিসহ অন্যূন ২২ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা (তবে ২ বছর পূর্তির আগে অবসরগ্রহণের সম্ভাবনা থাকলে সেক্ষেত্রে ২ বছরের চাকরির শর্ত শিথিলযোগ্য), সচিবালয়ের কোনো পদে ৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা (তবে অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্মসচিব পদে ২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার ক্ষেত্রে তা শিথিলযোগ্য), সরকার নির্ধারিত সিনিয়র স্টাফ কোর্সে মনোনয়ন দেয়া হলে তা সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা এবং কমপক্ষে ৮৫ মূল্যায়ন নম্বর অর্জন। এছাড়া বিধিমালা অনুযায়ী অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সমগ্র চাকরি জীবনে পালনকৃত দায়িত্বের গুরুত্ব ও প্রকৃতি এবং তার ব্যক্তিগত সুনামসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এ বিবেচনাও লিপিবদ্ধকৃত রেকর্ডের ভিত্তিতে ব্যতীত ইচ্ছা বা মর্জিমাফিক বা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে করার কোনো আইন বা বিধিগত সুযোগ নেই।
পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তা অপেক্ষা কম দক্ষ বা যার সততা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়, এমন কনিষ্ঠ কর্মকর্তার পদোন্নতির দ্বারা জনস্বার্থ রক্ষা হয় না। উপরন্তু প্রশাসনে ক্ষোভ, হতাশা দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে প্রশাসন ভেঙে পড়ে। যার কারণে অতীতের খারাপ দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করে জনস্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় প্রশাসনে পদোন্নতি প্রদান করা হবে, এটাই সবার কাম্য।
মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইন সংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক

No comments

Powered by Blogger.