মামার বন্দিশালায় মা-ছেলের ৫ বছর by নাজমুল হক শামীম

‘আমি পড়তে চাই, মুক্তি চাই’- কয়েকটি শব্দের একটি চিরকুট বন্ধ ঘরের জানালা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয় ১১ বছরের বালক জীমুন। এক ব্যক্তি চিরকুটটি কুড়িয়ে স্থানীয় একটি পত্রিকায় পৌঁছে দেন। পত্রিকায় সংবাদ ছাপার পর গত বুধবার সন্ধ্যায় ফেনী শহরের রামপুরে ওই বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। ৫ বছর ধরে এক ঘরে বন্দি ভিকারুননিছা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা জাহানারা বেগম রোজি ও তার ছেলে মেহেদি ইসলাম জীমুনকে এ সময় নির্জন ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের চিকিৎসার জন্য ফেনী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দীর্ঘ ৫ বছরে এক মিনিটের জন্যও মা-ছেলে সূর্যের আলো দেখেননি। অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন তারা। রোজির ভগ্নিপতি নুরু ইসলাম জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে মাস্টার্স শেষ করে ভিকারুননিছা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করতেন জাহান আরা বেগম রোজি (৪৫)। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা আবুল কালাম আজাদ ভূঞার সঙ্গে ২০০০ সালে তার বিয়ে হয়। তিন বছর সংসার জীবনের পর ২০০৩ সালে দু’জনের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। রোজির সাবেক স্বামী বর্তমানে সিলেটের জয়িন্তাপুর উপজেলায় সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর রোজি ফেনী শহরের রামপুর এলাকার বাবার বাড়িতে বসবাস করে আসছিলেন। এরই মধ্যে রোজি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে ছোট ভাই শের শাহ’র সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে রোজির ভাই শের শাহ তাকে ওই ঘরে ভাগিনা জীমুনসহ তালাবন্ধ করে চলে যায়। এদিকে রোজিনার ২ ভাই, ৬ বোনের মধ্যে অপর ভাই শাহেন শাহ মানসিক ভারসাম্যহীন। এক বোন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। বড় ভাইয়ের ভয়ে অন্য চার বোনের কেউ রোজির খোঁজ নিতে আসেন না। তাদের তিনজন ঢাকায়, অপরজন ফেনী শহরেই বসবাস করেন। তিনি শহরের রামপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। শহরের বিশাল বাড়িতে দুটি পাকা ঘরের একটিতে দীর্ঘদিন ধরে তালা। অন্য ঘরের দুটি কক্ষ ভাড়া দেয়া হয়। ভাড়ার ৪ হাজার টাকা দিয়ে চলতো রোজির ও তার সন্তানের সব ভরণ-পোষণ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাড়াটিয়া জানান, তালাবদ্ধ ওই কক্ষের জানালা দিয়ে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দেয়া হতো। এতে মা-ছেলের অর্ধাহারে-অনাহারে কোন রকম দিন কাটতো। ভাড়াটিয়ারা না থাকলে ওদের মাঝেমধ্যে না খেয়েই থাকতে হতো। ভুতুড়ে ওই কক্ষের ভেতরে একটি লাইট থাকলেও পাখাটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল ছিল। কক্ষে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস না থাকায় উৎকট গন্ধ বের হতো। জীমুন জানায়, পড়াশোনার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সে নার্সারির পর আর পড়তে পারেনি। কথা বলতে চাইলেও মায়ের বাধায় বারবার থেমে যায় জীমুন। জীমুন আরও জানায়, আমার আম্মুর সঙ্গে ২০১০ থেকে ৫ বছর ধরে আমার মামা অন্যায়ভাবে আমাকে আটকে রেখেছে। আমি পড়তে চাই, খেলতে চাই। আমি মুক্তি চাই। খবর পেয়ে বুধবার বিকালে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের যৌথ তত্ত্বাবধানে অভিযান চালিয়ে ঘরের তালা ভেঙে ও তিনটি লোহার দরজা কেটে তাদের উদ্ধার করা হয়। ফেনী সদর হাসপাতালের চিকিৎসক অসীম কুমার সাহা জানান, ৫ বছর এক ঘরে বন্দি থাকায় রোজি মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়ায়  আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। জীমুন রিকেট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তাদের ফেনী সদর হাসপাতালের একটি কেবিনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ফেনী পুলিশ সুপার মো. রেজাউল হক জানান, তাদের সুস্থ করার পাশাপাশি এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওয়তায় আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে জীমুনের পিতার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাদের বর্তমান অবস্থার কথা জানানো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.