আলী দোস্ত বৃত্তান্ত by ওয়াসি আহমেদ

আলী দোস্তের কথা কেউ বিশেষ মনে রাখেনি। কান্দাহার, হিন্দুকুশ দখলের পর কামরানের চোখ বুজিয়ে দিতে তার ডাক পড়েছিল। এরপর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।  কান্দাহার কবজায় আসার পর হুমায়ুনের মনে বড় স্বস্তি কামরানকে পাকড়ানো গেছে। ঘরের শত্রু বিভীষণ। ভাই হয়েও কী যন্ত্রণাই না দিয়েছে এত দিন! সারাক্ষণ তক্কে তক্কে ছিল, কখন মওকা বুঝে হুমায়ুনকে ঘায়েল করবে। কপাল ভালো হুমায়ুনের যে কামরান তাকে তেমন বেকায়দায় পায়নি। না হলে নিজ হাতে টুকরো টুকরো করে চিল-শকুনকে খাওয়াত। পাকড়ানো যখন গেছে, বড় শাস্তিই যে কামরানের পাওনা এ নিয়ে সন্দেহের কারণ ছিল না। আর মৃত্যুই যে সে শাস্তি, এ নিয়ে কারও মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। হুমায়ুনেরও না—অন্তত বাইরে থেকে দেখে তা-ই মনে হয়েছে। এ আপদকে বাঁচিয়ে রাখলে, এমনকি কয়েদ করে রাখলেও বিপদ আসবে না, এ ভরসা কে দেবে! সভাসদেরা এককাট্টা—শাস্তি মানে মৃত্যুদণ্ড। অন্যদিকে ফৌজিরা আগ বেড়ে পরিকল্পনায় মগ্ন, মৃত্যুটা কীভাবে উদ্যাপন করবে। কেবল বোন গুলবদন বেগম চুপ। শাস্তি যে একটা হওয়া উচিত, এ বিষয়ে তার মনোভাব তৈরি হয়ে থাকলেও সেটা মৃত্যু কি না এ নিয়ে হয়তো দোলাচলে ছিলেন। এ অবস্থায় খোদ হুমায়ুন শাস্তির যে বিধান দিলেন তাতে ফৌজিরা তো বটেই, সভাসদেরাও মুষড়ে পড়ল। বিধানটা এ রকম: মৃত্যুই কামরানের প্রাপ্য; তবে তাকে খুনই যদি করে ফেলা হয়, তার পাপের সাজাটা কে ভোগ করবে? তার চেয়ে তার চোখ দুটো যদি সেলাই করে চিরদিনের মতো বুজিয়ে দেওয়া যায়, সেটা হবে তার যথার্থ সাজা—দৃষ্টিশক্তিহীন কামরানের তখন কী করার থাকবে, মনে তার যত কুচিন্তাই গিজগিজ করুক।
যুক্তি ছিল হুমায়ুনের বিধানে। এক কোপে কতল করে ফেললে কামরান তার সাজার আজাব থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে, মরার কষ্টও টের পাবে না। বড় কথা, সোজা বেহেশতে চলে যাবে। রমজান মাস চলছে, কামরান আবার রোজাদার। শেষপর্যন্ত দু-একজন বাদে অন্যরা মনমরা হয়ে ব্যবস্থাটা মেনে নিল, তবে ভাইকে বাঁচিয়ে রাখতে হুমায়ুনের ফন্দি হিসেবে শাস্তির বিধানটা কলঙ্কিত হয়ে থাকল। মেনে নিলেও ফৌজিরা একটা শর্ত দিল। শুধু সেলাইতে চোখের পাতা বন্ধ করা চলবে না, যত পাকা হাতেই সেলাই করা হোক, ফাঁকফোকর থেকে যাবে না কে বলবে! এমন সময় ডাক পড়ল আলী দোস্তের। প্রচণ্ড গরম ছিল সেদিন। চারপাশে পাহাড়ের মাথাগুলোয় আগুন ঝলকাচ্ছিল। রোদের তাপ পাথুরে পাহাড়ের গা ছেড়ে যত নিচে নামছিল, গরমটা ততই তেড়েফুঁড়ে তাতিয়ে উঠছিল। রমজানের সেদিন যেন কত তারিখ? আলী দোস্তের ডাক পড়ার কারণ এ ধরনের কাজ তার জন্যই বিশেষভাবে নির্দিষ্ট। ফৌজিদের একজন হয়েও যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মুখোমুখি হওয়া তার কাজ না। তাকে ডাকা হয় যুদ্ধের বিরতিতে বা যুদ্ধ শেষে। তার সামনে তখন হাজির করা হয় পরাজিত বা বন্দী শত্রুসৈন্যদের। যুদ্ধ যারা করে, শত্রুর ঘাড় তাক করে তলোয়ার চালায়, বল্লম ছুড়ে বুক-পিঠ এফোঁড়-ওফোঁড় করে, তাদের বড় দুর্বলতা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে এসে বন্দী দুশমনদের ওপর কিছুতেই চড়াও হতে পারে না। যুদ্ধ শেষ, তাদের ক্ষমতাও শেষ। যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া তাদের শক্তি, সাহস, হিংস্রতা যেন একজোট হতে পারে না।
এ কারণেই দরকার আলী দোস্তের মতো লোকদের। খুব সুস্থিরভাবে কনুই থেকে আলগোছে হাতের নিচের অংশ ছেঁটে ফেলা, অণ্ডকোষ থেঁতলে দেওয়া বা ছুরির তীক্ষ্ণ ডগা ঘুরিয়ে কোটরমুক্ত সদ্যঅন্ধ চোখ নিপুণ নিশানায় অপেক্ষারত কুকুরের মুখে ফেলা—কাজগুলো সে করে নিরবচ্ছিন্ন একাগ্রতায়। তার শরীর-স্বাস্থ্যে বাহাদুরি নেই—মাঝারি গড়ন, ভোঁতা নাক-ঠোঁট, চোখজোড়া ঔৎসুক্যহীন। বিশেষ শারীরিক বৈশিষ্ট্য বলতে দুহাতেই একটা করে বাড়তি আঙুল। বুড়ো আঙুলের গা ঘেঁষে গজানো অতিরিক্ত আঙুল দুটো বেঁটেখাটো, গাঁটহীন—বাছুরের শিংয়ের মতো টাটানো আর কঞ্চির ধারালো ডগার মতো খোঁচাপ্রবণ।
বন্দিশালা থেকে কামরানকে যখন চোখ বেঁধে একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে নিয়ে আসা হলো, সে তখন ভেবে থাকবে কতল করতেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু চোখ খোলার পর তলোয়ারহীন আলী দোস্তকে সামনাসামনি দেখে সে বুঝে উঠতে পারল না কী হতে যাচ্ছে। পরপরই যখন সরু-লম্বা কাঠের পাটাতনে তাকে চিৎ করে ফেলা হলো, সে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় খানিকটা জোরাজুরি করল।
বুঝতে পারছিল কোনো লাভ হবে না। কারণ যারা তাকে পাটাতনে ফেলে চেপে ধরল তারা সংখ্যায় চারজন। ফেলামাত্র দুজন দুদিকে ছড়ানো দুহাতের ওপর হাঁটু গেড়ে বসল, অপর দুজন একই কায়দায় ঊরু-হাঁটু কবজা করল। শেষে ধীরেসুস্থে আলী দোস্ত বুকের ওপর সওয়ার হলো। কাঁধে ঝোলানো ছোট চামড়ার থলে থেকে একে একে সে তার সরঞ্জাম বের করল। ইঞ্চি পাঁচেকের চিকন দুটো লোহার শলা, ফিনফিনে কালচে-সবুজ সুতা, রুপালি ঝিলিক তোলা ছোট-বড় গোটাকতক সুই, ছোট কাচের শিশিতে টলটলে হলদেটে তরল। এ ছাড়া ছুরি, কাঁচি, বাটাল, ত্যানার পুঁটলি।
কামরানের ছাতি চওড়া, পা ছড়িয়ে বসার পরও খালি জায়গা যেটুকু মিলল তাতে সরঞ্জামগুলো পর পর সাজিয়ে রাখতে অসুবিধা হলো না। কামরানের মাথা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে উঁচু করা হতে শুয়ে পড়ার পর প্রথমবারের মতো সে আলী দোস্তের মুখ দেখতে পেল। আলী দোস্তও দেখল। ততক্ষণে কামরান বুঝে গেছে কী হতে যাচ্ছে। সে দেখল বুকে সওয়ার লোকটার প্রতি হাতে একটা করে বাড়তি আঙুল।
আলী দোস্ত সময় নষ্ট করল না। প্রথমেই ত্যানার পুঁটলি মুখে গুঁজে দিল। লোহার শলা চেপে ধরে অভ্যাসবশত দুচোখে দুটো মোক্ষম খোঁচা দিতে যাবে, তখনি কী মনে হতে সে শলার ব্যবহার বাদ দিয়ে দুহাতের বাড়তি আঙুল দুটোর টাটানো ডগা কামরানের দুচোখে বিঁধিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো কাজটা লোহার শলার চেয়ে কার্যকর ও ঝঞ্ঝাটমুক্ত। আগে কখনো ব্যবহার করেনি বলে বাড়তি ও আপাতদৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় প্রত্যঙ্গ দুটির কার্যকারিতা তাকে চমকে দিল।
সেলাই করে চোখের পাতা বুজিয়ে দেওয়ার কাজটা সে মনোযোগ দিয়ে সারল। তবে তার আগে ছোট শিশিতে হিন্দুকুশের বিখ্যাত সুগন্ধি তাবারি লেবুর রসটুকু সমানভাগে অন্ধকার দুই কোটরে ঢালতে ভুলল না।
সেদিন সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে আলী দোস্তকে দেখা গেল আস্তাবলের পেছনে একটা ছোট ছাউনিতে চুপচাপ বসে থাকতে। মানুষটা সে চুপচাপ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথাবার্তা বলে না, হইহুল্লোড় পছন্দ করে না। একা বসে থাকতে দেখে হাম্মাদ নামের এক ভিস্তিওয়ালা তাকে সালাম দিল। আলী দোস্ত চোখ তুলে একনজর লোকটাকে দেখে হাতইশারায় কাছে ডাকল। ভিস্তিওয়ালা হয়তো এতটা আশা করেনি। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে একটা মরা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতে আলী দোস্ত তাকে অবাক করে জিজ্ঞেস করল, সারা দিন পানি বওয়ার কাজ তার কেমন লাগে?
এ প্রশ্নে হাম্মাদ কী জবাব দেবে বুঝতে পারছিল না। সে অযথাই ঘাড় কাত করে একটা কিছু বোঝাতে চাইল। যার মানে হতে পারে কাজের আবার ভালো-মন্দ! জবাবটা ভেঙে বলতে আলী দোস্ত তাকে আর কোনো প্রশ্ন করেনি। আসলে ভিস্তিওয়ালা তাকে সালামটা যে দিয়েছিল তার মূলে আলী দোস্তের সেদিনের কাজকে সম্মান জানানো। হাম্মাদ শুনেছে কামরানের চোখ বুজানোর কাজটা আলী দোস্ত করেছে। আর করেছে এত পাকা হাতে নিঃশব্দে, বাইরে থেকে কেউ সামান্য আওয়াজও পায়নি। পরে জানাজানি হয়েছে, নানা মুখে তখন নানা কথা। সেসবের কতটা সত্যি, কতটা বানানো কে বলবে! তাই বলে হাম্মাদের সাহস নেই খোদ আলী দোস্তের কাছে প্রসঙ্গটা তোলে। তবে আলী দোস্ত তাকে তার কাজ ভালো লাগে কি না জানতে চাওয়ায় তার মনে একটা উসখুস জেগেছিল পাল্টা জানতে চাওয়ার আলী দোস্তের কি নিজের কাজ ভালো লাগে?
সুযোগটা সে হারিয়েছে কথা না বলে এক দৃষ্টিতে লোকটার প্রতি হাতের ছয় নম্বর আঙুলে তাকিয়ে থেকে। সত্যি-মিথ্যা জানে না, সে শুনেছিল যন্ত্রপাতি ছাড়া স্রেফ আঙুল দুটো ঠুঁসিয়েই সেদিন কামরানের চোখের আলো নিভিয়েছে আলী দোস্ত। ভিস্তিওয়ালা আর সময় পায়নি, দূর পাহাড়ের ফাঁকে সূর্য তখন ডুবুডুবু, ইফতারের তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেদিন দশ না এগারো রমজান?
আলী দোস্তের বিষয়ে শেষ খবর যার মুখে শোনা গিয়েছিল সে সেই ভিস্তিওয়ালা। এরপর তার খোঁজ কেউ পায়নি।

বিশাল সেনাবাহিনী থেকে কে কোথায় ছিটকে পড়ল, এটা কোনো হিসাবের আওতায় পড়ে না। যুদ্ধের ময়দানে মারা পড়া ছাড়াও অনেকে নিখোঁজ রয়ে যায়, একসময় তাদের মৃত বলে ধরে নেওয়াই দস্তুর। কিন্তু আলী দোস্ত হাওয়া হয়ে যাবে কেন? কিছুদিনের মধ্যে গোটা হিন্দুস্তানে আবার বাদশাহি রাজত্ব কায়েম হতে যাচ্ছে। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বতে পালিয়ে বেড়ানোর দিন খতম। এ সময়টা অপেক্ষা করার, ভেগে পড়ার নয়।
কৌতূহলী হয়ে যারা এ নিয়ে ভাবল তারা শেষপর্যন্ত হাম্মাদ ভিস্তিওয়ালার শরণাপন্ন হলো। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে ভিস্তিওয়ালার জীবনে সে এক বিরল সুযোগ। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সে যা বলল তাতে তারা চমকে উঠল।
হাম্মাদ বলল, সেদিন মাগরিবের আগে আলী দোস্তের সাথে তার অনেক কথাবার্তা হয়েছে। সে অতি সামান্য মানুষ, আলী দোস্ত খাতির করে তাকে এমন অনেক কিছুই বলেছে, যা তার শোনার কথা না। হাম্মাদ জানাল, আলী দোস্ত তাকে বলেছে বন্দীদের ওপর দিনের পর দিন নির্যাতন চালিয়ে নিজের ওপর তার ঘেন্না ধরে গেছে। কাজটা মোটেও সে পছন্দ করে না। অবশ্য এ কথা বলার আগে সে হাম্মাদের কাছে জানতে চেয়েছে সে তার কাজ পছন্দ করে কি না। জবাবে হাম্মাদ জানিয়েছে, পানি বওয়ার কাজ তার খুব ভালো লাগে। পানির অপর নাম জীবন। তার ভাগ্য, মানুষকে পানি জোগানোর মতো কাজ আল্লাহপাক তার জন্য বরাদ্দ করেছেন।
হাম্মাদ জানাল, আলী দোস্ত বলেছে অনেক কথাই, তবে সব কথার মূলকথা সে তার কাজকে ঘেন্না করে। কাজের কারণে নিজেকে ঘেন্না করে সবচেয়ে বেশি—এতটাই যে মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা হয় দুহাতের বাড়তি আঙুল দুটো নিজের দুচোখে বিঁধিয়ে দেয়। ঘটনার দিন সে যে তার খর্জুরের কাঁটার মতো আঙুল বিঁধিয়ে কামরানের চোখ বুজিয়েছে, এ কথাও বলেছে। বলতে গিয়ে আফসোসও নাকি করেছে, যদি চোখ দুটো কামরানের না হয়ে তার নিজের হতো। বলা যায় না, হয়তো নিজের চোখজোড়াকে ঘায়েল করতে দূরে নিরিবিলি কোনো জায়গায় চলে গেছে। নিজের চোখে দুনিয়া দেখার খায়েশ তার নেই। বলে ভিস্তিওয়ালা নিজের একটা সংশয়ও প্রকাশ করেছে, নিজের হাতে নিজের চোখ, কাজটা কঠিন হবে; তবে লোকটা আলী দোস্ত বলে কথা, কঠিনকে সহজ করে ফেলতেও পারে।
আলী দোস্তকে নিয়ে কথাবার্তার ওখানেই শেষ, হাম্মাদ যেমন কেসসাই ফাঁদুক। দেখা গেল তার কথায় প্রাথমিক একটা ধাক্কা খাওয়া ছাড়া কারও তেমন প্রতিক্রিয়া হয়নি। সময়টাও তখন এমন, এসব কাঁদুনিতে বেশিক্ষণ কান দেওয়ার ফুরসত কারও নেই। ছাউনি গুটিয়ে মোগল বাহিনী সামনে বাড়তে প্রস্তুতি নিচ্ছে। গরমে আকাশ জ্বলছে, কাছে-দূরে ধূসর পাহাড়চূড়ায় কুণ্ডলী পাকানো পোড়া মেঘের মতো রোদ, হাওয়া-বাতাস নেই, তার পরও সাজ সাজ রব। সামনেই দিল্লি-আগ্রার পতন।
আসলে নিজেকে নিয়ে রহস্য করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আলী দোস্তের ছিল না। নিজের ওপর তার সেদিন রাগ হয়েছিল এ কথা ঠিক। রাগ হয়েছিল মানুষের কথা ভেবে, মানুষ এত দুর্বল। মাত্র দুই আঙুলের খোঁচায় চোখের জ্যোতি মরে যায়, তাও এমন দুই আঙুল যাদের হিসাবেই আনার কথা না। এমন তো হতে পারত কামরান যদি কোনো কায়দায় জয়ী হয়ে যেত, আলী দোস্ত গিয়ে কামরানের পল্টনে নাম লেখাত। আর তখন হয়তো হুমায়ুনের চোখ বুজিয়ে দিতে তারই ডাক পড়ত। সে তখন একই কায়দায় হুমায়ুনের বুকে সওয়ার হতো।
ভেবে ভেবে সে আনমনা হয়ে পড়েছিল। আস্তাবলে ঢুকে তার নিজের ঘোড়ার পিঠে জিন না চাপিয়েই চড়ে বসেছিল। ঘোড়াটা বার কয়েক ঘাড় নেড়ে মনিবকে হয়তো জিন পরানোর কথা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছে, সঙ্গে লাগামও। ঘোড়ার মনোভাব বুঝে আলী দোস্ত দুই পায়ের গোড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পেছনে জোড়-লাথি ঠুকেছিল। চমকে লাফিয়ে উঠলেও দ্বিতীয় দফা লাথির অপেক্ষা না করে ঘোড়াটা আস্তাবল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে জিনহীন, লাগামহীন ঘোড়ায় সওয়ার আলী দোস্ত এপাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপাহাড়ের চড়াই ভেঙে চলছিল। মানুষ কত দুর্বল! মাথা থেকে কথাটা তাড়াতে পারছিল না। সে নিজেও কি দুর্বল? ভাবতে গিয়ে হঠাৎ সে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। সে যা করে, অন্যরা তা পারে না বলেই তাকে দিয়ে করানো হয়। পারবে কেউ জ্যান্ত মানুষের থুতনিতে ধীরে-শান্তিতে ছুরির আলতো পোঁচে গোটা মুখ থেকে কলার খোসার মতো চামড়া খসিয়ে নিতে? লড়াইয়ের ময়দানে দুশমনের চোখে না তাকিয়ে বুকে বর্শা ঠোকা বা তলোয়ারের হ্যাঁচকা টানে মাথা নামিয়ে ফেলা কে না পারে! কিন্তু কাটা মুণ্ডুটা ধীরেসুস্থে ফাটিয়ে টাটকা তুলতুলে মগজটুকু কজন পারবে রুমালে বেঁধে বা হাতে করেই গরম-গরম ছাউনিতে ফিরতে! পারে না বলেই তারা দুর্বল। আর সে—আলী দোস্ত? দুর্বল নয় বলে সে হয়তো মানুষও না। তার দুই হাতে একটা করে বাড়তি আঙুল, মানুষের যা নেই।
কথাটা ছোটবেলায় তার মায়ের মুখে শুনেছে। মাত্র বছর দুয়েক বয়সে মাই চুষতে গিয়ে মায়ের একটা বুক যেদিন ছ-নম্বরি আঙুলের আঁচড়ে রীতিমতো ঘায়েল করে ছেড়েছিল, মেয়েলোকটা তাকে কোল থেকে ছুড়ে ফেলে চিৎকারে লোক জড়ো করে ফেলেছিল। মুখে নাকি তখনি ঘোষণা করেছিল তার পেট-খসা এটা মানুষ না। সে সময় মায়ের এ ঘোষণা তার কানে পৌঁছার কথা নয়। ঘটনাটা কিছুটা বড় হয়ে সে শুনেছে, অথবা এও বলা যায় এ ঘটনা শুনে শুনেই সে বড় হয়েছে।
বয়স বাড়তেই বুঝে গিয়েছিল, সে আশপাশের অন্যদের মতো নয়। ঘর ছেড়ে রুজির ধান্দায় বেরিয়ে তেমন জুত করতে পারেনি। তার মাঝারি শরীরে, ভোঁতা নাক-মুখে রাগ-রোষের ছাপ নেই, কথা বলে কম, যা-ও বলে আস্তে-ধীরে, তার পরও যারা তাকে কাজ দেবে, তারা তার চোখে তাকিয়ে কী এক দুশ্চিন্তায় পড়ে যেত। কাজ জোটানো নিয়ে সে বড় একটা ভাবত না। এত বড় হিন্দুস্তানে এক আলী দোস্তের রিজিক জুটবে না, কী করে হয়! শেষমেশ কপালের ফেরেই বুঝি ভিড়ে গিয়েছিল পল্টনে, পশতুন ফরিদ খান ওরফে শের খানের পল্টনে। কনৌজের লড়াইয়ে হুমায়ুনকে হারিয়ে সৈন্যসামন্তসহ হিন্দুস্তান থেকে হটিয়ে শের খানের তখন রমরমা, তত দিনে শের খান নামটাও পাল্টে গিয়ে শের শাহ। আলী দোস্তের প্রতিভা বিকাশের সেই শুরু। কয়েক বছর বাদে নানা আঘাটায় খাবি খেয়ে খেয়ে হুমায়ুন যখন ফের দিল্লির মসনদের দিকে আগুয়ান, সে এসে ভিড়েছে হুমায়ুনের পল্টনে। এদিকে কামরান অনেক খোঁচাখুঁচি করেছে হুমায়ুনকে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। তবে যদি কোনো কায়দায় কামরান কাবু করে ফেলতে পারত হুমায়ুনকে, সে আগ বেড়ে গিয়ে ভিড়ত কামরানের পল্টনে। কামরানের প্রতি তার দুর্বলতা অনেক দিনের। সেই কামরানের চোখের আলো মাত্র দুই অঙুলের খোঁচায় কয়েক ঘণ্টা আগে সে নিভিয়ে দিয়েছে।
চড়াই ভেঙে নিচে নামতে টের পেল তিরের ফলা হয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে শরীরে। সামনে অথই অন্ধকার। এমন সময় তার মনে হলো সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, এমনকি অন্ধকারও না। কিন্তু ঘোড়াটা নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছে, নাহলে চলছে কী করে! ঘাড় ঘুরিয়ে এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে সে নিশ্চিত হলো কিছুই নজরে পড়ছে না। বুজিয়ে দেওয়া চোখে কামরানও কি এ সময় কিছু দেখার কসরত করছে তার মতো? দেখতে গিয়ে কিছুই দেখছে না, অন্ধকারও না!
ভাবতে ভাবতে সে ঘোড়ার পেছনে আচমকা জোরে লাথি ঠুকল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ঘোড়াটা কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। সামনে বিপজ্জনক ঢালু বাঁক, দুপাশে অতল খাদ। মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল ঘোড়ার। কত না সাবধানে উঁচু-নিচু পথের ঝাঁকি সামলে এগোচ্ছিল। এবার কি তবে নিজের মতো চলবে, সওয়ারির কথা না ভেবে?
এতদূরই ঘোড়াটা ভেবেছিল। খুব যে দ্রুত বাঁকের মুখে পা দিয়েছিল তা না, ছোট লাফ দিয়ে ঘাড় বাঁকানোর সময় সামনের পা জোড়াকে তৎপর করতে হয়েছিল, আর তখনি খেয়াল হয়েছিল পিঠটা হালকা। বেগ সামলে বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, এত অল্পতেই পিঠ খালি! কান দুটো চোঙের মতো টান টান পেতে রেখেছিল খানিকক্ষণ, অন্তত আওয়াজটুকু যদি শুনতে পায়। অতল খাদ থেকে সামান্য একটা আওয়াজ এত ওপরে ওঠার আশা নেই, তবু।
এদিকে জিনহীন লাগামহীন আলী দোস্ত অতল অন্ধ খাদে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবল মানুষই যদি সে না হয়, মরার তার প্রশ্ন ওঠে না। ঘোড়াটা সোয়ারি হারিয়ে কিছুক্ষণ বেকুব হয়ে থেকে কোনো না কোনো দিকে চলে যাবে। মোগল বাহিনী অনায়াসে দিল্লি-আগ্রা কবজা করবে। তারপর? এত বড় দুনিয়ায় যুগ যুগ ধরে কত কী ঘটবে, ঘটতে থাকবে। আলী দোস্ত তখন কার কাজে লাগবে কে জানে!

No comments

Powered by Blogger.