মামলায় জেরবার বিরোধী জনপ্রতিনিধিরা by কাফি কামাল ও আহমেদ জামাল

৫ই জানুয়ারির আলোচিত নির্বাচনের পরই উপজেলা নির্বাচনে বড় চমক দেখিয়েছিলেন বিএনপি ও জামায়াত জোটের প্রার্থীরা। পৌরসভা আর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও বিরোধী জোটের প্রার্থীদের বড় জয়ে উচ্চাশা ছিল এ জোটের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। কিন্তু বছর না যেতেই বরখাস্ত, মামলা, গ্রেপ্তার ও হয়রানির ভয়ে কোণঠাসা বিরোধী জোটের জনপ্রতিনিধিরা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হয়েছেন নানা কারণে। কারও কারও বরখাস্তের প্রক্রিয়া চলছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেকের বিরুদ্ধে আগেই রাজনৈতিক মামলা ছিল। নতুন করেও তাদের মামলায় জড়ানো হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে হয়রানিরও। জনপ্রতিনিধিরা অভিযোগ করেছেন উন্নয়ন কাজেও তারা বৈষম্যের শিকার। এতে যাদের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন হয়েছেন সেই ভোটারদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন না তারা। উপজেলা নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বেকায়দায় থাকা জামায়াতের প্রার্থীরা বড় চমক দেখালেও এখন এ দলটির নেতারাই বেশি বৈরিতার মুখোমুখি। এ পর্যন্ত জামায়াত সমর্থিত চারজন উপজেলা চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বরখাস্ত হয়েছেন আটজন চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান। বিএনপি সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা বেশি জর্জরিত মামলা ও হয়রানিতে।
বিএনপির জনপ্রতিনিধিরা কোণঠাসা
মাথার ওপর জনগণের প্রত্যাশার চাপ। নেই অর্থ বরাদ্দ। স্থবির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। সিটি করপোরেশনগুলোতে দাতা সংস্থার অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলোর মেয়াদও শেষ পর্যায়ে। আসছে না নতুন প্রকল্পও। সামনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও স্থানীয় এমপিদের প্রতিবন্ধকতার দেয়াল। পেছনে মামলা-হামলার তাড়া। ঘাড়ের ওপর খড়গ হয়ে আছে স্থানীয় সরকার আইনের নানা ধারা। পৌরসভা আইন ২০০৯-এর ৩১ ও ৩২ ধারা অনুযায়ী পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে কোন মামলার চার্জশিট হলে তার বরখাস্ত ও অপসারণ করা যাবে। বিএনপি সহ বিরোধীদল সমর্থিত পৌর মেয়রদের বিরুদ্ধে সে ধারাকে ব্যবহার করা হচ্ছে আইনি অস্ত্র হিসেবে। বিরোধী জোটের ডাকা কর্মসূচিসহ স্থানীয় নানা ঘটনায় দায়ের করা হচ্ছে একের পর এক মামলা। বরখাস্ত ও অপসারণসহ মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে নিম্ন থেকে উচ্চ আদালতে। মামলা জটিলতায় আত্মগোপনে যাওয়া ও আদালতে দৌড়ঝাঁপের কারণে জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে ব্যাঘাত ঘটেছে সিটি, পৌর ও উপজেলা পরিষদের কার্যক্রমে। এমন পরিস্থিতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন বিএনপি সমর্থিত সিটি মেয়র, পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। দেশের বিভিন্ন জেলার বিএনপি সমর্থিত অন্তত ১০ জন জনপ্রতিনিধি এমন তথ্য জানিয়েছেন। তারা অভিযোগ করছেন, সাধারণ বরাদ্দ কমিয়ে বিশেষ বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ বরাদ্দের সে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে সরকার দলীয় জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের মাধ্যমে। লোকাল রাজস্বের সীমিত আয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে কার্যক্রম। কিন্তু এলাকার জনগণ উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রদের দিকে তাকিয়ে আছেন, কবে প্রতিশ্রুতি দেয়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কিছু হলেও শুরু ও বাস্তবায়ন ঘটবে। আবার জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েও পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানরা সীমিত হয়ে পড়েছেন একটি কার্যালয় ও কিছু চেয়ার-টেবিলে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তারা পাচ্ছেন না তাদের প্রাপ্য সম্মানও। আবার উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ ২০০৯-এর ২৫, ২৬ ও ৪২ ধারা অনুযায়ী স্থানীয় এমপিকে উপজেলা চেয়ারম্যানদের মাথার ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে উপদেষ্টা হিসেবে। বিভিন্ন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইউএনওদের। তাদের হাতের মুঠোয় বন্দি স্থানীয় সরকারের উপজেলা পরিষদ শক্তিশালীকরণ প্রকল্প। জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, সরকার সমর্থিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বরাদ্দ পেলেও বিএনপি সমর্থিতদের কাছে তা হয়ে ওঠেছে সোনার হরিণ। উন্নয়ন বা সেবামূলক কোন কাজের অর্থ বরাদ্দ এবং সিদ্ধান্ত সবকিছুই নিচ্ছেন সরকারদলীয় স্থানীয় এমপি ও ইউএনওরা। সম্প্রতি বিভাগওয়ারী বিএনপি সমর্থিত স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময় করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া। সে সব মতবিনিময়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সরকারি অনিয়ম ও বঞ্চনার নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। খালেদা জিয়া সরকারের এমন ভূমিকার সমালোচনার পাশাপাশি ভবিষ্যতে ২০দলীয় জোট সরকার গঠন করতে পারলে স্থানীয় সরকারকে আরও শক্তিশালী করা এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় তাদের সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়ার অঙ্গীকার করেন।
মামলায় জর্জরিত বিএনপি সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেবল কেন্দ্রীয় নেতারাই নন, মামলা খড়গে বিএনপি সমর্থিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। সিটি মেয়র থেকে শুরু করে পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরাও বিভিন্ন মামলার আসামি। অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সরিয়ে দেয়া হয়েছে দায়িত্ব থেকে। কেউ কেউ উচ্চ আদালতে লড়াই করে দায়িত্ব ফিরে পেলেও চলছে অনেকের লড়াই। সর্বশেষ একদশক আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার সম্পূরক চার্জশিটে আসামির তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও হবিগঞ্জের পৌর মেয়র জিকে গউছের নাম। মামলার পর থেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন তারা। সম্প্রতি বিএনপির একটি কেন্দ্রীয় বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে রাস্তায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন গাজীপুর সিটি মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নান। ওই দিন তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় বেআইনি অস্ত্রে সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশের সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে। ২০১৩ সালের ২৭শে ডিসেম্বর কেন্দ্র ঘোষিত আন্দোলন কর্মসূচি পালনকালে দুদফা গুলিবিদ্ধ হন রাজশাহী সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। পরে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় পুলিশের গাড়িতে বোমা হামলায় ঘটনায় পুলিশ সদস্য সিদ্ধার্থ রায় হত্যাকাণ্ড, পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ ও বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসিকে গুলি করার অভিযোগে। ওই মামলায় তিনি দু’দফা স্বল্প মেয়াদে কারাভোগও করেন। তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলায় চার্জশিট দেয়া হলেও হুলিয়া মাথায় নিয়েই দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সিটি করপোরেশনের জমি উদ্ধার সংক্রান্ত ঘটনায় এখন অন্যের জমিতে অনধিকার প্রবেশের অভিযোগে দু’টি মামলার আসামি করা হয়েছে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র আহসান হাবিব কামালকে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের মামলা। ৮ই নভেম্বর রাতে একটি ইজিবাইক পোড়ানোর মামলায় আসামি করা হয়েছে খুলনার সিটি মেয়র মনিরুজ্জামান মনিকে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মনজুর আলমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা না থাকলেও রয়েছে ভূমি দখলের মামলা। নানা মামলায় কারাভোগ করছেন পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের অনেকেই। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান সরওয়ার জাহান চৌধুরী ও ভাইস চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ চৌধুরীকে ২রা সেপ্টেম্বর, রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সাঈদ চাঁদকে ১১ই জুন বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া গ্রেপ্তার করা হয় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক কবির, পঞ্চগড়ের আটোয়ারি উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুর রহমান আবদার, বোদা উপজেলা চেয়ারম্যান শফিউল আলম শফিকে। পবিত্র হজ নিয়ে লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যের প্রতিবাদে গত ১লা অক্টোবর যশোরে এক মানববন্ধনে হামলার ঘটনায় দু’টি মামলা দায়ের হয়। এতে যশোর পৌর মেয়র মারুফুল ইসলাম, কেশবপুর পৌর মেয়র আবদুস সামাদ বিশ্বাস, মনিরামপুর পৌর মেয়র শহীদ ইকবাল, বাঘারপাড়া পৌর মেয়র আবদুর রহিম মনাকে আসামি করা হয়।
বরাদ্দে বৈষম্যের শিকার, মর্যাদাও পাচ্ছি না: বুলবুল
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, আমি যখন নির্বাচিত হয়ে মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছি তখন করপোরেশনের ঋণ ছিল ৪২ কোটি টাকা। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই দায়িত্বগ্রহণ ও পালন করছি। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনে তিন ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়। প্রথমত, একনেকের মাধ্যমে ৩-৫ বছর মেয়াদি কিছু প্রকল্পের কাজ পরিচালিত হয়। এটা একটি ধারাবাহিক উন্নয়ন প্রকল্প। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রতি বছর থোক বরাদ্দের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা হয়। সাধারণত স্বচ্ছতা ও সমান দৃষ্টিতে সেটা বণ্টন হলে আমরা কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা পেতাম। কিন্তু এবার দেয়া হয়েছে ৮ কোটি টাকা। বাকি টাকা থেকে পরবর্তী সময়ে উনার ইচ্ছা অনুযায়ী কিছু বরাদ্দ দেন। তৃতীয়ত, দাতা দেশ ও সংস্থার অর্থায়নে হতদরিদ্র ও দরিদ্রদের জন্য কিছু প্রকল্প পরিচারিত হয়। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের অধীনে ইউএনডিপির অর্থায়নে যে প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে সেখানে ৮০ হাজার মহিলা কর্মরত। এর মাধ্যমে হতদরিদ্র ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্যানিটেশন, শিক্ষাসহ নানা উৎসাহব্যঞ্জক ও প্রণোদনামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বর্তমানে সে সব প্রকল্পের গতিও ধীর হয়ে পড়েছে। আগামী মার্চে সে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। আগামীতে তা নিয়মিত থাকবে কিনা অনিশ্চিত। রাসিক মেয়র বলেন, আমরা রাজস্ব আয়ের উপর চলছি। চেষ্টা করছি, নানাখাত থেকে সতর্কতার সঙ্গে ও নায্যতার ভিত্তিতে নিজস্ব আয় বাড়ানোর। সিটি করপোরেশন সাবলম্বী হলে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দিতে পারবো। বুলবুল বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া আমাদের দাতাদের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ নেই। এখন সরকার যদি রাজনৈতিক বিভাজনের দৃষ্টিতে না দেখে সদিচ্ছার মাধ্যমে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয় তবে মানুষের জন্য উপকার হবে। আমরা সিটি করপোরেশনের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে চাই। আমাদের দাবি, সিটি গভর্নর সিস্টেম চালু হোক। রাসিক মেয়র দুঃখ করে বলেন, সরকারি বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। মান-মর্যাদাও পাচ্ছি না। সরকার আমাদের পতাকা দেয়নি, স্ট্যাটাস দেয়নি, এমন কি বডিগার্ড দেয়নি। আমরা সত্যিকার অর্থেই অরক্ষিত অবস্থায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।
বিএনপি সমর্থিতদের বিরুদ্ধে অস্ত্র এখন ৩১-৩২ ধারা: ম্যাব মহাসচিব
নাটোরের সিংড়া পৌর মেয়র ও মিউনিসিপ্যাল এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর মহাসচিব অধ্যাপক শামীম আল রাজী বলেন, পৌরসভাগুলোতে এডিপি বরাদ্দ কম-বেশি হচ্ছে। তবে সেটা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে এ, বি ও সি ক্যাটিগরির পৌরসভাকে ৭০, ৬০ ও ৫০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। চলতি অর্থ বছরে কমিয়ে প্রতিটি ক্যাটিগরির ক্ষেত্রে নামিয়ে আনা হয়েছে সমান ৪০ লাখে। তিনি বলেন, চলতি অর্থ বছরে পৌরসভার জন্য মোট বরাদ্দ ৩৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২৬ কোটি টাকা সাধারণ বরাদ্দ ও ১৯৯ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ। এই বিশেষ বরাদ্দের অর্থ বিশেষ ভাবেই বরাদ্দ হয়। আর তাতে বঞ্চিত হয় সারা দেশের পৌরসভাবাসী। ম্যাব মহাসচিব বলেন, সম্প্রতি পুরনো মামলার চার্জশিটে যুক্ত করা হয়েছে হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জিকে গউছের নাম। ঝালকাঠির নলছিটি, চাঁপাই নবাবগঞ্জ সদর ও শিবগঞ্জের পৌর মেয়র অপসারণের শিকার। নাটোরের নলডাঙ্গার পৌর মেয়র অপসারণের হওয়ার পর হাইকোর্টে মামলা করে পদ ফিরে পেয়েছেন। ম্যাব মহাসচিব বলেন, আমরা আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে আইনের দুর্বলতা ও কালো আইনগুলো রহিতকরণসহ ১৬ দফা দাবি নিয়ে সংগ্রাম করছি। নোয়াখালী পৌর মেয়র হারুনুর রশিদ আজাদ বলেন, বড় প্রকল্পগুলো দলীয় বিবেচনায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়রদের দেয়া হচ্ছে।
বরাদ্দ নেই, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও নেই: উপজেলা চেয়ারম্যানবৃন্দ
চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, নিয়ম অনুযায়ী উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হওয়ার কথা। নির্বাচিত হওয়ার পর ৬ মাসেও কোন বরাদ্দ পাইনি। উপজেলা পরিষদের রাজস্ব আয় থেকে প্রত্যাহিক কার্যক্রম চলছে। এমনিতেই উপজেলা পরিষদকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে না সরকার। তার ওপর আমরা বিরোধী জোটের রাজনীতি করি তাদের কোন কাজ করারই সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। পদ ছাড়া বলতে গেলে কিছুই পাইনি। এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দূরে থাক এখন নানা মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়ে পড়েছি। বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা চেয়ারম্যান মুহিত তালুকদার বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর দীর্ঘ ৮ মাস কেটে গেলেও এডিপির একটি টাকাও পায়নি উপজেলা পরিষদ। গত জুন ও সেপ্টেম্বরে যে বরাদ্দ পাওয়ার কথা ছিল সেটাও পাইনি। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, ৬ মাস পার হয়ে গেলেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য কোন বরাদ্দ পাইনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আবু আসিফ খান বলেন, স্থানীয় বিভিন্নখাত থেকে কিছু রাজস্ব আসে সেগুলো দিয়েই চলছে উপজেলার কার্যক্রম। সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া স্থানীয় রাজস্বের ১ ভাগ টাকার অংশ হিসেবে ৬০ লাখ টাকা পেয়েছিলাম। সেখান থেকে এডিপির কাজের বকেয়া হিসেবে ১২ লাখ টাকা পরিশোধ, ৮টি ইউনিয়নের প্রতিটিতে ৩ লাখ টাকা করে ২৪ লাখ টাকা উন্নয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত ২৫ লাখ টাকা অনুদান নিয়ে এবং উপজেলা পরিষদ থেকে ২২ লাখ টাকাসহ ৪৭ লাখ টাকায় আশুগঞ্জের একটি ড্রেনেজ ব্যবস্থার টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি অফিস বা অনুষ্ঠানাদিতে প্রাপ্ত সম্মানও পাই না। দাওয়াত পাই, গিয়ে দেখি অংশগ্রহণের পরিবেশ নেই।
বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে জামায়াতের জনপ্রতিনিধিরা
নানামুখী চাপে উপজেলা নির্বাচনের বিজয় ধরে রাখতে পারছে না জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচিত চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের একের পর এক গ্রেপ্তার, বহিষ্কার, জামায়াতের তৃণমূল নেতৃত্বকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। নানা আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে জামায়াত সমর্থিত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। সম্প্রতি চার উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার, ৮ চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান বহিষ্কার হয়েছেন। এর আগে শপথ নিতে গিয়েও গ্রেপ্তার হয়েছেন কয়েকজন। গ্রেপ্তার আর বহিষ্কারের পাশাপাশি হামলা-মামলার ভয়ে বেশ ক’জন চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান উপজেলা পরিষদের নিয়মিত কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারছেন না। ফলে স্বাভাবিক কারণে সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের অর্জিত বিজয় রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতা বলছেন, সরকারের অসহযোগিতার কারণে জামায়াত উপজেলার সুফল ভোগ তো দূরের কথা, এখন পদ রক্ষা করাই দায় হয়ে পড়ছে। তবে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের পদ ফিরে পাওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন দলটির নেতারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, নবম সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দলের শীর্ষ নেতাদের একের পর এক মৃত্যুদণ্ডের রায়, সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নামে অসংখ্য মামলা ও গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে জামায়াতে ইসলামীকে। এমন অবস্থায় উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের অপ্রত্যাশিত বিজয়ে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে দলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতি বহাল থাকায় উপজেলা পরিষদের সেই বিজয়ী পদগুলো রক্ষা করতে এখন রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে জামায়াতকে। এব্যাপারে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ডা. শফিকুর রহমান বলেন, সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালনে বাধা দিচ্ছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের গ্রেপ্তার করে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। প্রায় একই সুরে মন্তব্য করেছেন দলটির নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। সম্প্রতি পর পর কয়েকজন চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার হীন উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে। তিনি বলেন, জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়েই সরকার বিভিন্ন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করেছে। সরকার সাজানো মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করার পর এবার তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে তাদের সেবা থেকে জনগণকে বঞ্চিত করেছে। তিনি বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বরখাস্তের মধ্য দিয়ে এ সরকারের একদলীয় ফ্যাসিবাদী চরিত্র অত্যন্ত নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সূত্র জানায়, বিভিন্ন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে জামায়াতের উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ ডজনখানেক জনপ্রতিনিধিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে। এছাড়া গ্রেপ্তার আতঙ্কে বেশির ভাগ চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছেন আত্মগোপনে। এতে উপজেলা পরিষদের কাজে সময় দিতে পারছেন না তারা। নানা কায়দা কৌশলে মাঝে মধ্যে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য উপজেলা কার্যালয়ে গিয়ে  হাজিরা দিয়ে আসছেন কেউ কেউ। তবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে পারছেন না তারা। উল্লেখ্য, ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত ৪র্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৩৬টিতে চেয়ারম্যান পদে, ১২৬টিতে পুরুষ এবং ৩৬টিতে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দলটির প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। বিজয়ী প্রার্থীদের প্রায় সবাই স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতের বিভিন্ন পদে রয়েছেন। নির্বাচন শেষে এপ্রিলে শুরু হওয়া শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে ১০ চেয়ারম্যানসহ অন্তত ২৫ জনপ্রতিনিধি পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। পরে বিভিন্ন সময়ে প্যারোলে বা জামিনে মুক্তি পেয়ে শপথ গ্রহণ করেন তারা। শপথ নিলেও গ্রেপ্তার আতঙ্ক ও আটক থাকার কারণে পরিষদের দায়িত্ব বুঝে পেতে কারও কারও সাত মাস সময় লেগেছে। এর মধ্যে কয়েক দফা আটক হয়েছেন বিভিন্ন উপজেলার চেয়ারম্যান ও ভাইস  চেয়ারম্যান। বিভিন্ন মামলার আসামি করে চার্জশিট দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে অন্তত ছয়জনকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১১ই নভেম্বর বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম মণ্ডলকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তার বিরুদ্ধে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ চারটি ‘নাশকতা’র মামলা রয়েছে। নুরুল ইসলাম মণ্ডল স্থানীয় জামায়াতের একজন দায়িত্বশীল। গত ১৮ই নভেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মাজেদুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান আবু সোলায়মান সরকার সাজুকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। মাজেদুর রহমান জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ও ভাইস চেয়ারম্যান আবু  সোলাইমান সরকার সাজু সুন্দরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি। গত ১লা অক্টোবর সুন্দরগঞ্জ পৌর মেয়র জামায়াত নেতা নুরুন্নবী প্রামাণিক সাজুকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তাকে ১১টি নাশকতার ঘটনায় আসামি করা হয়। গত ২রা অক্টোবর গাইবান্ধা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আবদুল করিমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে এই বরখাস্তের আদেশ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল করিমের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে দায়ের করা দু’টি মামলা গাইবান্ধার পৃথক দু’টি  আদালতে বিচারাধীন। এ কারণে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর আগে ৮ই সেপ্টেম্বর বগুড়ার শেরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান দবিবর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি। ২রা সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান সরওয়ার জাহান চৌধুরী ও ভাইস চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ চৌধুরীকে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সরওয়ার জাহান চৌধুরী ও সুলতান মাহমুদ চৌধুরী উখিয়ার বৌদ্ধ মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। ইতিমধ্যে এ মামলার চার্জ গঠন করেছেন আদালত। এর  প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব বরখাস্তের আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়েছে বলে জানান জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ। এছাড়া, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা আবদুর রউফ, ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি রেজাউল ইসলাম, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জসিম এবং কয়েকটি উপজেলার চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানসহ ছয় থেকে সাতজন আটক রয়েছেন। ঢাকা মহানগর জামায়াত তরুণ সদস্য আতাউর রহমান তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের অনেক চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানকে জামায়াত করার অপরাধে বরখাস্ত, গ্রেপ্তার করছে। তবে তাদের মনে রাখতে হবে জামায়াত এখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। এসব করে জনগণের মন থেকে জামায়াতকে মুছে দেয়া যাবে না। এদিকে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পুত্র পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদী বলেন, ২৪শে এপ্রিল দায়িত্ব গ্রহণের পর এখন পর্যন্ত নতুন সরকারি বরাদ্দ আসেনি। তেমন কোন কাজেরও সুযোগ পাইনি। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে সত্যিকার অর্থে উপজেলা পরিষদের বিধি মোতাবেক একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে কোন কাজের সুযোগ আমরা পাচ্ছি না। এ ব্যাপারে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, স্বৈরাচারী সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাজ করতে দিচ্ছে না। সরকারের এ জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এদিকে আসন্ন বিজয় দিবসের আগেই অথবা জানুয়ারির প্রথম দিকে জামায়াত নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল সূত্রে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.