৩৬ দফা কাঠমাণ্ডু ঘোষণা -সার্ক জ্বালানি চুক্তি সই

কর্মকর্তা পর্যায়ে সিরিজ আলোচনায় ‘ঐকমত্য’ না হওয়ায় সার্ক কাউন্সিল অব মিনিস্টারস্‌-এ মুখ্য এজেন্ডা হয়ে উঠেছিল জ্বালানি সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিয়মিত আলোচনায়ও সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। বাংলাদেশ ও ভারত আগাগোড়াই ইতিবাচক থাকলেও ভিন্নমত ছিল পাকিস্তানের। অন্য ৫ সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা ছিলেন নীরব। মধ্যরাতে দ্বিতীয় দফায় বৈঠকে বসেন দক্ষিণ এশিয়ার ৮ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। কিন্তু এক সদস্য গররাজি হওয়ায় আলোচনা ভেঙে যায়। উদ্বোধনী দিনে সর্বোচ্চ নেতাদের উপস্থিতিতে চুক্তিটি সইয়ের সময়ক্ষণ ঠিক ছিল। সেই সূচি বাতিল করেন আয়োজক রাষ্ট্র নেপালের প্রধানমন্ত্রী। মুহূর্তেই নেতিবাচক খবর ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্বগণমাধ্যমে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের শেষ দিনে এক অবকাশ বৈঠকে বসেছিলেন নেতারা। সেখানেই ঘটে নাটকীয়তা। সব টানাপড়েন পেছনে ঠেলে পাকিস্তানসহ সার্কের শীর্ষ নেতারা জ্বালানি সহযোগিতা সমপ্রসারণ চুক্তি সই করতে রাজি হন। ওই অবকাশ বৈঠকে অবশ্য অসুস্থতার কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অংশ নিতে পারেনিনি। তার প্রতিনিধি হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও সচিব অংশ নেন। পূর্বনির্ধারিত কোন সূচি না থাকলেও গতকাল সমাপনী অনুষ্ঠানেই চুক্তিটি সই করেছেন সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। কাঠমান্ডু ঘোষণার আগেই চুক্তিটি সই হয়। বাসস জানিয়েছে, ওই চুক্তির ফলে দক্ষিণ এশিয়ার জোট সার্ক-এর সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে বিদ্যুৎ বাণিজ্য এবং আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ গ্রিড নির্মাণ করতে পারবে। এর মধ্য দিয়ে সার্ক বিদ্যুৎ বাজারের ক্ষেত্র তৈরি হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আট দেশের শীর্ষ  নেতাদের উপস্থিতিতে পরররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এই চুক্তিতে সই করেন। ওই চুক্তি ও ৩৬ দফা্‌ কাঠমান্ডু ঘোষণার মধ্য দিয়ে কাঠমান্ডুর রাষ্ট্রীয় সভাগৃহে গতকাল সার্কের ১৮তম আসরের পর্দা নেমেছে।
চুক্তি স্বাক্ষর শেষে নেপালের প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্ভাবনাময় দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে যোগাযোগ উন্নয়নসহ একই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সন্ত্রাস দমনসহ নিরাপদ এশিয়া গড়ার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। গত ২১শে নভেম্বর কাঠমান্ডুতে ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ‘শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য নিবিড় সংহতি’- এই প্রতিপাদ্যে শুরু হয় দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সংস্থার এ সম্মেলন। সার্কের আট নেতার উপস্থিতিতে বিদায়ী চেয়ারম্যান মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম সম্মেলন উদ্বোধন করেন। সার্ক রীতি অনুযায়ী দায়িত্ব নেন স্বাগতিক দেশ নেপালের প্রধান মন্ত্রী সুশীল কৈরালা।
অবকাশ কর্মসূচিতে যোগ দেননি প্রধানমন্ত্রী, দেশে ফিরছেন আজ: ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতার কারণে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের অবকাশ কর্মসূচিতে অংশ নেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মেলনে আসা সার্কের শীর্ষ নেতাদের জন্য গতকাল সকালে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ধুলিখেলে এই অবকাশের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতার কারণে প্রধানমন্ত্রী ধুলিখেলে যেতে পারেননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, শ্রীলঙ্কার  প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ুম, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি সকালে হেলিকপ্টারে করে কাঠমান্ডু থেকে ধুলিখেলে যান। নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালাও এ সময় সার্ক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ছিলেন। সেখান থেকে কাঠমান্ডু শহরে ফিরে সার্ক সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা সম্মেলনের সমাপনী সভায় অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পর্বে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে অংশ নিতে মঙ্গলবার বিকালে নেপালে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। বুধবার সকালে কাঠমান্ডুর ‘রাষ্ট্রীয় সভাগৃহে’ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সব মতপার্থক্য সরিয়ে যৌথ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে আসার জন্য সার্ক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সম্মেলনের মূল আনুষ্ঠানিকতার বাইরে বুধবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা এবং আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন তিনি। সম্মেলনের সমাপনীর পর বৃহস্পতিবার রাতে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের  সৌজন্যে নেপালের প্রেসিডেন্ট রামবরণ যাদবের দেয়া নৈশভোজে যোগ দেন শেখ হাসিনা। আজ তিনি দেশে ফিরছেন।
৩৬ দফা কাঠমান্ডু ঘোষণা
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় ৩৬-দফা কাঠমান্ডু ঘোষণার মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-র ১৮তম শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। সংস্থার বর্তমান চেয়ারম্যান নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা সন্ধ্যায় সিটি হলে এ সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাপনী অধিবেশনে সংস্থাভুক্ত দেশগুলোর অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। কৈরালা ঘোষণা করেন, ১৯তম সার্ক সম্মেলনে ২০১৬ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হবে। এবারের সদ্য সমাপ্ত সম্মেলনে যুগান্তকারী সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন এনার্জি কো-অপারেশন (বিদ্যুৎ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হলো। ৮ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সমাপনী অধিবেশনে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তেশেরিং তোবগে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা সিটি হলে এ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন। চুক্তি স্বাক্ষর শেষে নেপালের প্রধানমন্ত্রী বলেন, সদস্য দেশের পরিবহন মন্ত্রীরা সার্ক যাত্রী পরিবহন মোটরযান চুক্তি ও সার্ক রেলওয়ে সহযোগিতা চুক্তির বিষয়ে আলোচনার জন্য আগামী ৩ মাসের মধ্যে বৈঠকে বসবেন। সুশীল কৈরালার সমাপনী ভাষণের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ধন্যবাদ জানান। পরে দক্ষিণ এশিয়ার ৮ দেশের শীর্ষ নেতারা এক ফটোসেশনে অংশ নেন।

No comments

Powered by Blogger.