জৈব গ্যাস প্রযুক্তি- রান্না, ব্যবসায় জৈব গ্যাস by অরুণ কর্মকার

রুমানা-আফজাল দম্পতির বাসা টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গায়। এলাকাটিতে গ্যাস-সংযোগ নেই। তাই নিজেদের রান্নার জন্য জৈব গ্যাসের ব্যবস্থা করতে চার বছর আগে স্থাপন করেছিলেন একটি মুরগির খামার। তাতে এখন নিজেদের প্রয়োজন তো মিটছেই, আরও ২৩টি পরিবারকে গ্যাস সরবরাহ দিচ্ছেন তাঁরা। পারিবারিক এই জৈব গ্যাস প্রকল্পের আসল পরিচালক গৃহকর্ত্রী রুমানা নাসরিন। স্বামী মো. আফজাল হোসেন ওরফে পামিরুল তাঁর সহায়ক ও ব্যবস্থাপক। আর আছেন একজন সাহায্যকারী— মো. দানেশ। দেশে এখন প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের সারা বছরের রান্না চলে জৈব গ্যাসে। তবে সেখানে রুমানা-আফজাল দম্পতির মতো উদ্যোক্তা কম, যারা নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আশপাশের মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছেন। অধিকাংশ পরিবার নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে নিজ নিজ গরু বা মুরগির খামারের বর্জ্য ব্যবহার করে জৈব গ্যাস উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে প্রকল্পটি পরিদর্শনের সময় প্রথম আলোকে রুমানা বলেন, ‘গ্যাসে রান্নার আনন্দই আলাদা। সুবিধাও অনেক। প্রথমে নিজেদের প্রয়োজনে করেছিলাম। পরে আশপাশের বাসিন্দারাও গ্যাস নেওয়ার আগ্রহ দেখান। তাই খামারের আয়তন বাড়িয়ে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে।’
আফজাল বলেন, ‘এটা ব্যবসা হিসেবেও খারাপ না। প্রতি মাসে গ্যাস বিক্রি করে প্রায় ১৪ হাজার টাকা আয় হয় তাঁদের। গ্যাস প্ল্যান্ট করতে প্রায় ৬০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ১০ হাজার টাকা পাওয়া গেছে সরকারি অনুদান হিসেবে। রক্ষণাবেক্ষণে তেমন কোনো ব্যয় নেই। বছরে একবার কিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ব্যাপার থাকে মাত্র।’
আফজাল জানান, তাঁদের খামারে এখন তিন হাজার লেয়ার (ডিমের জন্য প্রতিপালিত) মুরগি। শুরু করেছিলেন এক হাজার দিয়ে। তাঁরা এখন মোট ২৫টি চুলায় গ্যাস দেন। এর মধ্যে দুটি নিজেদের। অবশিষ্ট ২৩টির প্রতিটি চুলার জন্য মাসে ৬০০ টাকা করে নিচ্ছেন। মুরগির খামার ও গ্যাসের উৎপাদন আরও বাড়ানোর কথা ভাবছেন তাঁরা। গ্যাস থাকার কারণে তাঁদের বাড়িতে ভাড়ায় থাকার জন্য অনেক পরিবার ‘সিরিয়াল’ দিয়ে রাখেন।
অবশ্য চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার সাদুল্যাপুর ইউনিয়নের পশ্চিম পুটিয়ারপাড় গ্রামে আবদুল কাদের আরও বড় একটি জৈব গ্যাস প্রকল্প চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন গ্রামীণ শক্তির পরামর্শক এম এ গোফরান। প্রায় ১২ হাজার মুরগির বর্জ্য দিয়ে পরিচালিত ওই জৈব গ্যাস প্ল্যান্টের মাধ্যমে এখন ৯০টি চুলায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে বলে টেলিফোনে প্রথম আলোকে জানান আবদুল কাদেরের ছেলে মো. আল-আমিন। তিনিই ওই খামার ও গ্যাস প্ল্যান্টের পরিচালক। ইডকল ও সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এটিই সম্ভবত দেশের সবচেয়ে বড় জৈব গ্যাস প্ল্যান্ট।
বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো জৈব গ্যাসের দেশব্যাপী এই প্রকল্পেও সহায়তা করছে সরকারি খাতের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল)। বিশ্বব্যাংক, জার্মানির কেএফডব্লিউ ও নেদারল্যান্ডসের এসএনভির ঋণ ও অনুদানে দেশের ২৪টি এনজিওর সহায়তায় ইডকল এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তাদের লক্ষ্য ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে এক লাখ জৈব গ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন।
ইডকলের প্রকল্প ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি সংস্থা এবং অনেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগেও দেশে জৈব গ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপিত হচ্ছে। সব মিলে বর্তমানে দেশে এর সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো। প্রতি মাসেই এই সংখ্যা বাড়ছে। তবে জৈব গ্যাস প্রকল্প বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো দ্রুত সম্প্রসারণশীল নয়। এর কারণ, অধিকাংশ পরিবারে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল থাকলেও তা সংখ্যায় জৈব গ্যাস প্রকল্প চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আবার যাঁদের তা যথেষ্টসংখ্যক আছে, তাঁরাও সবাই প্রকল্প করতে এগিয়ে আসছেন না। এ জন্য এখন ইডকলের একটি বড় উদ্যোগ হচ্ছে মানুষকে বোঝানো (মোটিভেশন)।
গ্রামাঞ্চলে যাদের স্বল্পসংখ্যক গবাধিপশু বা হাঁস-মুরগি আছে, তেমন অনেকগুলো পরিবারে তৈরি বর্জ্য একটি স্থানে একত্র করে যৌথ ব্যবহারের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নেরও চেষ্টা চলছে। সর্বোপরি, জৈব গ্যাস তৈরির জন্য যে গবাদিপশু বা হাঁস-মুরগির বর্জ্যই লাগবে, তা নয়। মানুষের পয়োবর্জ্য ব্যবহার করেও একইভাবে জৈব গ্যাস উৎপাদন করা যায়। এটা করা হলে গ্যাস উৎপাদনের পাশাপাশি একই সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও গড়ে তোলা সম্ভব।
গবেষণা: জৈব গ্যাসের ব্যবহার বহুমুখী করার বিষয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার গবেষণা চলছে। টাঙ্গাইলের সাদ-বিন এমরান এমনই একটি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের কেটিএইচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন এমরান। এরপর ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ‘পলি জেনারেশন ইউনিট’ বিষয়ে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
সম্প্রতি টাঙ্গাইলে তাঁদের বাসায় কথা হয় এমরানের সঙ্গে। তিনি বলেন, সুইডেনের ওই প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ‘পলি জেনারেশন ইউনিট’ নামে একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এর মাধ্যমে কোনো প্ল্যান্টে উৎপাদিত জৈব গ্যাসের একাংশ দিয়ে রান্নাবান্না, একাংশ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ওই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জেনারেটরের তাপ ব্যবহার করে পানি বিশুদ্ধ করা সম্ভব হবে।
এমরান বলেন, অবশ্য ছোট প্ল্যান্ট দিয়ে ওই সমন্বিত কাজটি সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে জৈব গ্যাসের প্রায় সব প্ল্যান্টই ছোট। তবে এগুলো বড় করার সুযোগ আছে। সুইডেনের উদাহরণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছোট ছোট খামারের বর্জ্য একত্র করে এক জায়গায় বড় একটি প্ল্যান্ট চালানো এবং সেখানে উৎপাদিত গ্যাস দিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। তাতে যেসব খামার বা পরিবারের বর্জ্য ব্যবহৃত হবে, তাঁরা সবাই সেখান থেকে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানি পাবেন।
ইডকলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ছয় আকারের জৈব গ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপিত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি হচ্ছে দৈনিক ১ দশমিক ২ ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদনক্ষম। এরপর রয়েছে যথাক্রমে ১ দশমিক ৬, ২, ২ দশমিক ৪, ৩ দশমিক ২ এবং সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ ঘনমিটার ক্ষমতার।
এর মধ্যে প্রথম চারটি পরিবারভিত্তিক ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়। এগুলো দিয়ে সাধারণত একটি পরিবারই গ্যাস ব্যবহার করতে পারে। শেষের দুটিতে একাধিক পরিবারের ব্যবহার করার মতো গ্যাস উৎপাদিত হয়। তবে গ্যাস উৎপাদনের কাঁচামাল (মুরগি, গরু এমনকি মানুষের পয়োবর্জ্য) সহজলভ্য হলে এক জায়গায় পাশাপাশি একাধিক প্ল্যান্ট বসিয়ে আশপাশে সংযোগ দেওয়া কিংবা এমরানের বর্ণিত সমন্বিত কাজে ব্যবহার করা সম্ভব।
সমস্যা কী: এলেঙ্গার রুমানা-আফজাল দম্পতির জৈব গ্যাসের অন্যতম গ্রাহক মো. বায়েজিদ হোসেন। তিনি একজন শিক্ষক। গ্রাহক হিসেবে কোনো সমস্যা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, শীতকালে গ্যাস সরবরাহ একটু কম হয়। এ ছাড়া কোনো সমস্যা নেই।
আরেকজন গ্রাহক বলেন, লাইনে কখনো কখনো পানি জমে গ্যাস সরবরাহে কিছুটা বিঘ্ন ঘটায়। তবে এখন তা অনেক কমেছে। কারণ, লাইনে পানি ছেঁকে রাখার জন্য ফিল্টার বসানো হয়েছে।
প্ল্যান্টের মালিক আফজাল হোসেনও একটি সমস্যার কথা বলেন। যখন মুরগি বদল করতে হয়, তখন গ্যাসের উৎপাদন কম হয়। অবশ্য গ্যাস লাইনে পানি জমার সমস্যা সমাধানে যেমন ফিল্টার বসানো হয়েছে, তেমনি মুরগি বদলের সমস্যা সমাধানেরও একটি কার্যকর উপায় তিনি বের করেছেন। অন্য একটি শেডে আগে থেকেই তিনি কিছু মুরগি রেখে দেন, যেগুলো বদলে ফেলা মুরগির শেডে সঙ্গে সঙ্গে ঢোকানো হয়। তাই ভবিষ্যতে আর সমস্যা হবে না বলে তিনি নিশ্চিত।
পরিবেশ-প্রতিবেশ: অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানি সংস্থানের পাশাপাশি জৈব গ্যাস পরিচ্ছন্ন পরিবেশও নিশ্চিত করতে পারে। প্রতিটি বাড়িতে কিংবা যৌথ অংশীদারির ভিত্তিতে জৈব গ্যাস উৎপাদনের উদ্যোগ নিলে গরু-হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা থেকে মাটি, পানি ও বায়ুদূষণ রোধ করা সম্ভব। মানুষের বর্জ্য ব্যবহার করা হলে পরিবেশের আরও বড় সংরক্ষণ হতে পারে।
এ ছাড়া, ব্যাপকভাবে জৈব গ্যাস উৎপাদনের উদ্যোগ নিলে শহর-নগরে দুর্গন্ধময় ভাগাড় ব্যবস্থাপনা দরকার হয় না। গ্যাস উৎপাদনের পর বর্জ্যের পরিশোধিত যে অংশ (স্লারি) থেকে যায়, তা শুকিয়ে উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কোনো কোনো উদ্যোক্তা এ রকম স্লারি উৎপাদন করে বাজারজাত করছেন এবং তা জনপ্রিয়ও হয়েছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক লাখ লোক অধ্যুষিত একটি এলাকায় জৈব গ্যাস উৎপাদনের মতো বর্জ্য হয় প্রতিদিন প্রায় ২০ মেট্রিক টন। এই বর্জ্য ব্যবহার করে গ্যাস উৎপাদন করা যায় প্রায় এক হাজার ৪০০ ঘনমিটার, যা দিয়ে প্রায় এক হাজার ২০০ চুলায় প্রতিদিন রান্না করা সম্ভব।
একটি জৈব গ্যাস প্ল্যান্ট প্রায় ৩০ বছর ব্যবহার করা যায়। পাঁচ বছর নির্মাণ গ্যারান্টি ও তিন বছরের নির্মাণ-পরবর্তী সেবার নিশ্চয়তা দেয় ইডকল ও তার তালিকাভুক্ত এনজিওগুলো।
{প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলো টাঙ্গাইল প্রতিনিধি কামনাশীষ শেখর}

No comments

Powered by Blogger.