রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাব

হাজারো অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের কাছে ফেরত পাঠানোর আগে তাদের গতিবিধি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার একটি প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। আল-জাজিরা আমেরিকার হাতে যাওয়া বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ডকুমেন্টে এ তথ্য উঠে এসেছে। জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোয় প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাস করে। স্থানীয়দের বাসাবাড়িতে আশ্রয় খুঁজে আর প্লাস্টিক শিট ও বাঁশ দিয়ে বনে কুঁড়েঘর তৈরি করেও আছে অনেকে। অতিরিক্ত ৩০ হাজার শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত রয়েছে। তারা জাতিসংঘ পরিচালিত ক্যাম্পে বসবাস করছে। সেখানে তাদের গতিবিধি সীমিত আর চাকরির তেমন সুযোগ নেই। ফেব্রুয়ারি মাসে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন জাতীয় কৌশলের ঘোষণা দেয় ঢাকা। কিন্তু এর বিস্তারিত প্রকাশ করেনি কর্তৃপক্ষ। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলোর সংক্ষিপ্ত আল-জাজিরা আমেরিকাকে দিয়েছে। ৩১শে মার্চ ২০১৪ তারিখে দেয়া ওই ডকুমেন্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিকদের প্রকৃত সংখ্যা এবং অবস্থান নির্ণয় করার জন্য জরিপ তালিকা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের যথাযথ কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন উপযুক্ত স্থানে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হবে। এতে বলা হয়, মৌলিক মানবাধিকার প্রয়োজন মেটাবে আইওএম আর ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রস মানবাধিকার সেবাগুলো সরবরাহে সমন্বয় করবে। মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেছেন, তারা শুধু জাতিসংঘ পরিচালিত শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া শাখার উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে সম্মত হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশের ওই নির্দেশনায় এমন কোন ইঙ্গিত নেই নিবন্ধিত হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার দেয়া হবে কিনা। রোহিঙ্গাদের মুক্তভাবে চলাফেরা করার এবং পরিচয়পত্র বা পাসপোর্টের আবেদন করার সুযোগ থাকবে কিনা আইওএম সে প্রশ্ন ঠেলে দিয়েছে বাংলাদেশের জাতিসংঘ রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটরের কার্যালয়ের দিকে। তারা আবার পাল্টা নির্দেশ করেছে আইওএম-এর দিকে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে একাধিকবার মন্তব্য জানতে চাওয়া হলেও কোন জবাব মেলেনি। মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পাওয়ার অস্বীকৃতি আর দৈনন্দিন জীবনে কঠোর নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে স্বীকৃতিবিহীন ও আইনি শূন্যতার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। কর্মসংস্থানে বৈধতা না থাকায় নির্যাতন আর দুর্নীতির আশঙ্কা রয়েছে। ন্যায়বিচার পাওয়ারও কোন অবলম্বন নেই। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বে সর্বাধিক নির্যাতিত সম্প্রদায়ের মধ্যে রোহিঙ্গারা একটি। মিয়ানমারে ১৯৮২ সালের সংবিধানে তাদের নাগরিকত্ব প্রদানে অস্বীকৃতি জানানো হয়। এখন তারা চরম নির্যাতনের শিকার। ২০১২ সালে মিয়ানমারে সহিংসতার চূড়ান্ত পর্যায়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনে বাংলাদেশের সমালোচনা করা হয়। মিয়ানমারের ওই সহিংসতায় গণহত্যা আর ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গার গৃহহীন হওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। সেসময় নৌকাভর্তি শরণার্থীদের সমুদ্রে পুশব্যাক করে দেয়া হয়। বাংলাদেশ তাদের সীমান্ত সিল করে দেয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় বলেছিলেন, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অতিরিক্ত ঘনবসতির দেশ। আমরা এ ভার বহন করতে পারবো না। ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র ওনচিতা শাদমান বলেন, তারা রোহিঙ্গাদের তালিকা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগ এসেছে ২০১২ সালের সহিংসতার পর। শরণার্থী মর্যাদা সম্পন্ন ৩০ হাজার রোহিঙ্গার বেশির ভাগই এসেছে ৭০-এর দশকের শেষে এবং ৯০-এর দশকের শুরুতে। এদিকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের ওই জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনায়, কোন রোহিঙ্গাকে অবৈধভাবে নিয়োগ, আশ্রয় প্রদান বা পরিচয়পত্র বানিয়ে দিলে বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য শাস্তিমূলক নতুন আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ফিল রবার্টসন বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অনেক বাংলাদেশীর জন্য ভয়াবহ। কিন্তু এটা রোহিঙ্গাদের জন্য আরও খারাপ। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠানো হলে তাদের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের মাঝে রেখে তাদের সঙ্গে পিংপং বলের মতো আচরণ করা হচ্ছে। তাদের এদিক থেকে ওদিক ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। যেন কোন প্রকার অধিকারের বালাই নেই।
এদিকে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা নৌকাযোগে অবৈধ ও  ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে। এখানে এসে অনেক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মাদক চোরাচালান এবং অন্য অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার অভিযোগ উঠছে নিয়মিত। স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর এক ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ দিদারুল ফেরদৌস বলেন, বৈধ কাজের অনুমোদন না থাকায় তারা অবৈধ কাজে ঝুঁকে পড়ছে। অনেক সময় কম মজুরিতে তারা কাজ করছে আর স্থানীয়রা এ কারণে ক্ষুব্ধ। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ভিত্তিক মানবাধিকার গ্রুপ ফর্টিফাই রাইটসের ম্যাথিউ স্মিথ বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হয়েছে গত বছরে। তিনি এ জন্য দুষলেন ত্রুটিপূর্ণ সরকারি কৌশলকে। বাস্তবতা হলো সীমান্তের দু’দিকের কোন দিকেই রোহিঙ্গাদের জন্য তেমন আশার আলো নেই। তবু অনেকে স্বপ্ন দেখেন একদিন তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাবেন।

No comments

Powered by Blogger.