ধর্ষক আতঙ্ক আশুগঞ্জে by জাবেদ রহিম বিজন

আতঙ্কে কয়েক শ’ নারী শ্রমিক কলোনি ছাড়া


চোর কিংবা ডাকাত আতঙ্ক নয়। এবার ধর্ষক আতঙ্ক আশুগঞ্জের বয়লার পাড়ায়। প্রতিরাতে ধর্ষকরা বয়লার পাড়ায় হানা দিয়ে কাউকে না কাউকে তুলে নিচ্ছে। গণধর্ষণ শেষে ছেড়ে দিচ্ছে। অব্যাহত এ ধর্ষণ আতঙ্কে বয়লার পাড়ার বাসিন্দারা তাদের কলোনি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এ অবস্থায় কর্মব্যস্ত ৪টি বয়লার এখন বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতি রাতেই সেখানে হানা দেয় ধর্ষক গ্রুপ। এ অবস্থায় সম্ভ্রম বাঁচাতে আশুগঞ্জ মধ্য সোনারমপুর এলাকার কয়েকটি বয়লারের কয়েক শ’ নারী শ্রমিক বাড়িতে চলে গেছে। সঙ্গে স্বামী-সন্তান সবাই। এ অবস্থায় বয়লার মালিকদের মাথায় হাত। বয়লার মাঠ বিরান। ধান নষ্ট হচ্ছে। ধর্ষণের ঘটনা ওই এলাকার বয়লার শ্রমিকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। স্বামীর সামনেই ধর্ষণের শিকার হয় এক নারী শ্রমিক। এর আগে বয়লার থেকে স্বামীসহ তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনার পর বয়লার শ্রমিকরা আর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সেখানে থাকার সাহস পাননি। আশুগঞ্জ থানা থেকে মাত্র কয়েক শ’ গজ দূরত্বের মধ্যে বয়লার নারী শ্রমিকের সম্ভ্রমহানি, পাশেই মহাসড়কে ওই দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য ভাবিয়ে তুলছে বয়লার মালিক আর তাদের স্টাফদের। একটি বয়লার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা জসিম সরদার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, দেখেন বয়লারগুলোর অবস্থা কি! থানা থেকে মাত্র এক শ’ গজ দূরত্বে আমরা বয়লার চালাইতে পারি না! কোন দেশে বাস করি আমরা? সরজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ১১ই নভেম্বর রাতে মধ্য সোনারামপুর এলাকার ফাহিম-১ নামের একটি বয়লারের এক নারী শ্রমিককে তার ঘর থেকে স্বামীসহ তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ওই বয়লারটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ফিসারির পাড়ে নিয়ে গিয়ে স্বামীর সামনেই তাকে ধর্ষণ করা হয়। কয়েক ঘণ্টা পর আবার তাকে ফেলে রেখে যায়। খবির নামের কিশোরগঞ্জ নিকলীর এক শ্রমিক জানান, ওই নারী শ্রমিকের বয়স ২০ বছর হবে। বয়লার শ্রমিক সূত্রে জানা গেছে, ধর্ষণের পর ওই নারী শ্রমিকের  স্বামীকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল দৃর্বৃত্তরা। এরপর ওই নারী শ্রমিক তার স্বামী কার কাছে বলবে না বলে আকুতি জানিয়ে তাকে রক্ষা করে। এদিকে ওই নারী শ্রমিককে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে বয়লার শ্রমিকরা এবং আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা সেখানে গিয়ে এক দুর্বৃত্তকে ধরে ফেলে। গণপিটুনিতে গুরুতর আহত ওই দুর্বৃত্তকে জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানোর পর রাত আড়াইটার দিকে সে মারা যায়। এই ঘটনার পর আতঙ্ক নেমে আসে ফাহিম-১ সহ আশপাশের আরও কয়েকটি বয়লারে। পরদিন থেকে শ্রমিকরা বয়লার ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে শুরু করে। ফাহিম-১, ফাহিম-২ এবং সানমুন-১, সানমুন-২ এই ৪ টি বয়লার পাশাপাশি। এখনও এ ৪টি বয়লারের যে সব শ্রমিক রয়ে গেছেন তারা আশ্রয় নিয়েছেন পশ্চিমের দারোগা আলীর বয়লারে। ১৩ই নভেম্বর দুপুরে এসব বয়লারে গিয়ে উল্লেখ করার মতো কোন শ্রমিক দেখা যায়নি। ৪টি বয়লারে গোটা ১৫-২০ জন শ্রমিকের দেখা মেলে। তাদের চোখেমুখে চরম আতঙ্কের ছাপ। ধর্ষণের ঘটনা নিয়েও মুখ খুলতে চান না কেউ। বৃদ্ধ হাসান আলী আর তার স্ত্রী আছিয়া বলেন, রাতে চিৎকার হুইন্না ঘুম ভাঙে আমরার। কিন্তু দরজা খুইল্লা বাইরে যাওয়ার সাহস পাই নাই। শুনছি ঘর থেকে টাইন্না জামাই-বউরে লইয়া গেছে। এরপর জামাইর সামনে বউএর ইজ্জত নষ্ট করছে। এ ঘটনার পর তারা আশ্রয় নিয়েছেন পাশে দারোগা আলীর বয়লারে। দুই নারী শ্রমিক হবিগঞ্জের লাখাইয়ের রাশিদা ও ফুলবানু আতঙ্কের মধ্যে আছেন বলে জানান। ফাহিম-১ বয়লারে প্রথমে কথা হয় আবদুল হক নামের একজনের সঙ্গে। ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমি ওইদিন ছিলাম না। বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। তবে আবদুল হক ঘটনাটি শুনেছেন বলে জানান। বলেন, রাতে জামাই-বউ দুইজনরে ধইরা নিছিল। পরে আবার দিয়া গেছে। এই বয়লারটি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের এই ৪টি বয়লারে প্রায় ১০০০ শ্রমিক কাজ করে। এর অর্ধেকই নারী। ঘটনার পর তারা কেউ আর এখন বয়লারে নেই। তবে ঘটনার বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি হুমায়ুন। ফাহিম-১ বয়লারটির মালিক কন্ট্রাক্টর হিরো মিয়া। তাকেও পাওয়া যায়নি। হুমায়ুনের সঙ্গে থাকা ইয়ামিন নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘ডাকাইতের ভয়ে সবাই পালাইছে। এহানে মানুষের নিরাপত্তা নাই। বয়লারের শ্রমিকরা জানান, বয়লারের পাশেই মহাসড়কে প্রতি রাতে এই দুর্বৃত্তরা অবস্থান নেয়। গাড়িতে ডাকাতি করে। বয়লারের ভেতর থেকে টোপ (ধানের স্তূপ ঢাকার খুপরি) নিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গাড়ি থামায়। এই দুর্বৃত্তদের উৎপাতে  ফাইভ স্টার নামের একটি বয়লার বন্ধ হয়ে গেছে। তারা আরও জানান, এই দুর্বৃত্তরা রাস্তায় ডাকাতি করার পাশাপশি বয়লারের ভেতর ঢুকে নারী শ্রমিকদের উত্ত্যক্ত করে। দীর্ঘদিন ধরেই তারা সেটি নীরবে সয়ে যাচ্ছেন। ফাহিম ও সানমুনের ৪টি বয়লারের শ্রমিকদের থাকার সব ঘর তালাবদ্ধ। ধান শুকানোর মাঠ ফাঁকা। আশুগঞ্জ বয়লার মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ডাকাতরা মেয়েছেলেরে ধইরা নিয়ে গিয়েছিল বলে শুনেছি। আমি এলাকায় ছিলাম না। পরে এসে ঘটনাটি জানতে পারি। ওই এলাকায় ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছে বলেও জানান তিনি। তবে আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবু জাফর নারী শ্রমিক ধর্ষণের অভিযোগ পাননি বলে জানান। তিনি ঘটনার বিষয়ে বলেন, ডাকাতরা বয়লারের ওপর দিয়ে ডাকাতি করতে যাওয়ার সময় লোকজন ঘেরাও করে গণপিটুনি দিলে এক ডাকাত মারা যায়। তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে এ ব্যাপারে একটি মামলা হয়েছে। নারী শ্রমিক ধর্ষণের  কোন ধরনের ঘটনা ঘটেনি। তিনি আরও বলেন, বয়লার এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.