স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী by শেখ সাবিহা আলম

স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী, আমরা কি আর বইতে পারি/ এও কি একটা শাস্তি নয়, কষ্ট হয়, কষ্ট হয়/
আমার কষ্ট বুঝতে চাও, দোহাই পড়ার চাপ কমাও/ কষ্ট হয়, কষ্ট হয়।
কবীর সুমনের গানে ফুটে ওঠা স্কুলগামী শিশুদের এই আর্তি নিছক কবির কল্পনা নয়। এ এক নিরেট বাস্তবতা।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, পিঠে ব্যথা, সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারার কষ্ট নিয়ে শিশুরা তাঁদের কাছে আসছে। এদের প্রায় সবাই বলছে, স্কুলব্যাগের ওজন বেশি। বয়ে নিতে কষ্ট হয়। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুল—সব প্রতিষ্ঠানের শিশুদের কাছ থেকেই তাঁরা এমন অভিযোগ পেয়েছেন।
ঢাকা শিশু হাসপাতালেরই এক চিকিৎসক শোনালেন তাঁর এক শিশু রোগীর গল্প। তাতে শিশুটির শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি ফুটে উঠেছে অভিভাবকের অসহায়ত্ব। ঘটনাটি এমন—
শিশুটি মাঝে মাঝেই পিঠব্যথায় কাতরায়। কোনো কোনো দিন ব্যথা ঘাড় বা পায়েও ছড়িয়ে পড়ে। শিশু অস্থিবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসক দেখেশুনে বললেন, শিশুটি তার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি ওজনের বোঝা বয়ে বেড়ায় প্রতিদিন। এই বোঝা স্কুলব্যাগের বোঝা। এই বোঝাটা কমাতে হবে।
মা-বাবা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। তারপর সাহস নিয়ে বলেন, পরামর্শপত্রে যদি বিষয়টি লিখে দেন চিকিৎসক, তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে বোঝানো সহজ হবে। চিকিৎসক সারওয়ার ইবনে সালাম তা-ই করলেন।
বাংলাদেশের স্কুলপড়ুয়া শিশুরা ঠিক কত বেশি বোঝা বয়ে বয়ে একসময় অসুখ বাঁধিয়ে ফেলছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই বলে জানিয়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু চিকিৎসকেরা বলেছেন, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দেখেশুনে নির্দ্বিধায় বলা যায়, সবার অসচেতনতায় প্রতিদিন বাংলাদেশের শিশুরা একটু একটু করে গুরুতর শারীরিক ক্ষতির দিকে এগোচ্ছে।
ভারতের দিল্লির এক স্কুলের ছাত্র বরুণ জৈনের করুণ কাহিনিটি এখানে উদাহরণ হিসেবে চলে আসে। দিনটা ছিল ২০১২ সালের ২৫ জানুয়ারি। কিছুতেই সেদিন আর ব্যাগের ভার বইতে পারছিল না সে। হঠাৎ স্কুলের সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল। পুরো ভারতবর্ষকে কাঁদিয়ে ছেলেটি মারাও গেল।
জীবনই যদি না বাঁচল, তবে তা আবার কেমন ধারার পড়ালেখা? দিল্লিতে শুরু হলো স্বাক্ষর সংগ্রহ। তার পরিপ্রেক্ষিতে কোন ক্লাসের শিশুরা সর্বোচ্চ কত ওজনের ব্যাগ বইতে পারবে, সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় নীতিমালায় নির্দেশনাও দেওয়া হয়। দিল্লি হাইকোর্ট প্রাক্-স্কুলপর্যায়ে ব্যাগের ওজন শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের কম করার নির্দেশ জারি করেন।
তবে সম্প্রতি ইন্ডিয়ান জার্নাল অব পেডিয়াট্রিকস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩০ শতাংশ শিশু বেশি ওজনের ব্যাগ বহনের কারণে পিঠে ব্যথায় ভুগছে। আরেক প্রতিবেদনে ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, বেশি ওজনের ব্যাগ বহনের কারণে শিশুদের স্থায়ী শারীরিক ক্ষতি হয়ে থাকে। বয়ঃসন্ধিকালে হাড়ের কাঠামো ঠিক হয়, এ সময় বেশি ওজন বহন করা একেবারে অনুচিত।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্রে জানা গেল, সংযুক্ত আরব আমিরাতেও শিশুরা এইভাবে ভুগছে। গত বছর দেশটির ফেডারেল ন্যাশনাল কাউন্সিল সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ভারী ব্যাগ বহনের কারণে শিশুদের মেরুদণ্ডের স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। স্পেনেও আছে একই সমস্যা। দেশটির ‘আর্কাইভস অব ডিজিজ ইন চাইল্ডহুড’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, স্কুলব্যাগের অতিরিক্ত ওজনে শিশুর পিঠব্যথাসহ নানা শারীরিক সমস্যা হয়। একই অবস্থা পাকিস্তানের শিশুদেরও।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিশুদের অবস্থাটা আসলে কী, তা একনজরে বোঝার জন্য সার্বিক কোনো তথ্য-উপাত্ত খুঁজে পাওয়া গেল না। কৌতূহল থেকে এই প্রতিবেদক ১৫ দিন সময় নিয়ে কয়েকটি স্কুলের নার্সারি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম) শিক্ষার্থীদের ব্যাগ মেপে দেখেছেন। চিত্রটা এমন—ওয়ারীর কিন্ডারগার্টেন স্কুলের এক ছাত্রের ব্যাগের ওজন ছিল সাড়ে চার কেজি। ইস্কাটনের একটি স্কুলের প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রের ব্যাগের ওজন পাওয়া যায় তিন কেজি। ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কে অবস্থিত একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া এক ছাত্রের ব্যাগের ওজন সাড়ে ছয় কেজি। নিউমার্কেট-সংলগ্ন একটি বিখ্যাত সরকারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রের ব্যাগের ওজন ছিল সাত কেজি। শেরেবাংলা নগরের একটি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীর ব্যাগের ওজন পাওয়া যায় সাড়ে সাত কেজি।
ধানমন্ডির একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রের ব্যাগে আটটি বই, আটটি খাতা, পেনসিল বক্স, পানির ফ্লাস্ক ও টিফিন বক্স দেখা গেছে। ওই শিশুটির অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, বইয়ের চেয়ে খাতার ওজই বেশি। স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী স্কুল থেকে খাতা কিনতে হয়। দেখা যায়, একই বিষয়ে দু-তিনটি খাতাও নিতে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রের ব্যাগে পাওয়া গেছে সাতটি বই, সাতটি খাতা, ডায়েরি, পেনসিল বক্স, জ্যামিতি বক্স, টিফিন বক্স, পানির ফ্লাস্ক ও স্কেল। ওই ছাত্র জানায়, প্রতিদিন তাদের সাতটি বিষয়ের ক্লাস হয়।
দিল্লিতে যে শিশুটি মারা গিয়েছিল, সেই বরুণ জৈন তার শরীরের ওজনের ৪০ শতাংশ বোঝা বইছিল। কিন্তু বাংলাদেশের শিশুদের কী পরিমাণ ওজন বহন করা যুক্তিযুক্ত?
শিশুবিশেষজ্ঞ ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের শিক্ষক আবদুল্লাহ শাহরিয়ার বললেন, একজন শিশুকে কখনো তার নিজের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি বোঝা বইতে দেওয়া যাবে না। সেদিক থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রদের ব্যাগের ওজন হবে এক থেকে সর্বোচ্চ দুই কেজি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির তিন কেজি। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির শিশুদের চার কেজি। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন হতে পারে সর্বোচ্চ ছয় কেজি।
রাজশাহীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের সহকারী শিক্ষক আজমিরা খাতুন বলেন, পাঠ্যক্রম অনুযায়ী বই আনলে ওজন বেশি হওয়ার কথা নয়। শিশুরা অনেক সময় কোচিংয়ের জন্য বই-খাতা বহন করে অথবা নোট বই, গাইড বই নিয়ে আসে। এতে ওজন বাড়ে। তবে তিনি বলেন, সপ্তাহে দুটোর বেশি বাড়ির কাজ না দেওয়ার কথা বলা হলেও কোনো কোনো শিক্ষক এ নির্দেশনা মানেন না। ফলে শিশুদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শহরের স্কুলে ব্যাগের ওজন বেশি। তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন ও নামকরা স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেক সময় প্রকাশনা সংস্থাগুলোর যোগসাজশ থাকে। দুই পক্ষ মিলে পাঠ্যবইয়ের বাইরে বাড়তি বই জুড়ে দেয়। তিনি বলেন, উন্নত দেশে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক বই পড়ানো হয়। তবে সেগুলো শিশুদের প্রতিদিন স্কুলে বয়ে আনতে হয় না। শিশুরা গ্রন্থাগার থেকে বই নেয়, মনের আনন্দে পড়ে। শিক্ষক মাঝে মাঝে গল্পচ্ছলে দু-একটা প্রশ্ন করে বুঝে নেন, শিশুরা বই পড়ছে কি না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের প্রধান ও বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সহিদুল্লা বলেন, পিঠে-ঘাড়ে ব্যথার কারণ যে ভারী ব্যাগ, অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। ফলে বাচ্চাকে অনেক দেরিতে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন।
বেশি বোঝা বইলে কী ক্ষতি হতে পারে জানতে চাইলে শিশুবিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, দিনের পর দিন ভারী ব্যাগ বইলে শিরদাঁড়ার স্বাভাবিক অবস্থান নষ্ট হয়ে যায়। চাপ পড়তে পড়তে দুই হাড়ের মাঝখানে নরম পদার্থ শুকিয়ে যায়। এতে দীর্ঘস্থায়ী পিঠে ব্যথা, পিঠ বেঁকে যাওয়া, হাড়ে ফাটল ধরা ও শিশুর ঠিকমতো বেড়ে উঠতে না পারার মতো গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে।
করণীয় জানতে চাইলে চিকিৎসকেরা বলছেন, শিশুদের বাঁচাতে হলে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, বোঝা কমাতে হবে। সেটা কীভাবে হবে তা খুঁজে বের করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই। স্কুল কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে হবে। অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া দরকার।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফাহিমা হোসেন বলেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইয়ের তালিকা অনুসরণ করলে এ সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে তিনি জানান, কোন ক্লাসের শিশুরা কত ওজনের ব্যাগ বইবে, সে ব্যাপারে তাঁদের কোনো নির্দেশনা নেই।
চিকিৎসকেরা তাৎক্ষণিক দুটি পরামর্শ দিয়েছেন। এক. সব স্কুলে যদি নিরাপদ পানির সরবরাহটুকু করা যায়, তাহলে শিশুদের অন্তত পানির ফ্লাস্কটি বয়ে নেওয়ার কষ্টটা থেকে মুক্তি দেওয়া যায়। দুই. ব্যাগের ওজন কমাতে কিছু বই স্কুলে রাখার ব্যবস্থা করা। আর শিক্ষাবিদেরা জোর দিলেন, পাঠ্যবইয়ের বাইরে সম্পূরক, নোট ও গাইড বইকে ব্যাগে ঢুকতে না দেওয়ার ওপর।

No comments

Powered by Blogger.