এখন আমার বেঁচে থাকাটাই শাস্তি

‘এখন আমার কেউ নেই। আমি একা, খুব অসহায়। এখন আমার বেঁচে থাকাটাই শাস্তি।’ বাবার স্মরণে আয়োজিত শোকসভায় অশ্র“সিক্ত কণ্ঠে এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিউল ইসলাম লিলনের একমাত্র ছেলে সৌমিন শাহরিদ জেভিন। এ সময় কান্নার শব্দে সভাস্থলের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। ঢুকরে কেঁদে ওঠেন সবাই। সৌমিনের মা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। নৃশংস হত্যাকাণ্ডে এবার বাবাকে হারালেন তিনি। এমন হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি কেউ। ওপরের দিকে চোখ তুলে দিকভ্রান্ত পথিকের মতো জেভিন বলছিলেন, ‘বাবা ছিল আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তার যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হতো তাহলে না হয় মেনে নিতাম। প্রাণীর প্রতি সহিংসতা হয় বলে যে মানুষটি আমিষ খাওয়া বাদ দিয়েছিলেন, তাকে কেন এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করা হল?
বৃহস্পতিবার দুপুরে সমাজবিজ্ঞান সমিতির উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মমতাজ উদ্দিন কলাভবনে আয়োজিত শোকসভায় তার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি কেউ।
সৌমিন আরও বলেন, ‘আমার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন একশ’ বছর বাঁচতে চান তিনি। অথচ পঞ্চাশ বছর বয়সেই তাকে এভাবে চলে যেতে হল। এ সময় তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের মাঝে বাবার আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখুন। তার আদর্শকে মরতে দিয়েন না।’
শোকসভায় প্রফেসর শফিউল ইসলামের বোন ওয়াসিম রুমানা লিপি বলেন, ‘আমরা সংবাদের শিরোনাম হতে চাই না। হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদের এখনই রুখে দিতে হবে, যাতে আর কোনো খুনি খুন করার সাহস না পায়। তিনি বলেন, আন্দোলন ম্লান হয়ে গেলে আরও রক্ত ঝরবে, তাই খুনিদের বিচার দাবিতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বারবার হত্যাকাণ্ডের শিকার মেনে নেয়া যায় না। আর যাতে এ রকম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা না ঘটে সেজন্য এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে সর্বোচ্চ আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
শোকসভায় আরও বক্তব্য দেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন নীলুফার সুলতানা, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ওয়ারদাতুল আকমাম, বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর জুলফিকার আলী, প্রফেসর আবদুর রহমান সিদ্দিকী, প্রফেসর সিদ্দিকুর রহমান, সাবেক শিক্ষক ফয়জার রহমান। সভা সঞ্চালনা করেন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবা সরকার।
রিমান্ডে নতুন তথ্য নেই, তদন্ত জঙ্গিদের দিকে : অধ্যাপক শফিউল ইসলাম হত্যা মামলার কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। হত্যার কারণ নিশ্চিত ও এর সঙ্গে জড়িতদের এখনও চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। এ কারণে নিহতের পরিবারসহ ক্যাম্পাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। তবে এ ঘটনার সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী জড়িত বলে ধারণা করছে পুলিশ। পুলিশের তদন্ত এখন সেদিকেই যাচ্ছে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার সরদার তমিজ উদ্দিন জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ঘটনার বর্ণনায় এটি মোটামুটি নিশ্চিত যে, প্রশিক্ষিত জঙ্গিরাই পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। অধ্যাপক শফিউল প্রচলিত ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার বাইরে গিয়ে নানান ব্যক্তিগত আচরণ ও মন্তব্য করেছিলেন। তিনি লালন চর্চার নামে প্রতি সপ্তাহেই বাসায় গানের আসর বসাতেন। তিনি ফেসবুকেও ধর্ম নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন। এ কারণে উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীদের টার্গেট হয়ে থাকতে পারেন।
মহানগর পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, অধ্যাপক শফিউল ইসলাম তার গ্রামের এক দরিদ্র ছাত্রীর লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। সে নিয়মিতই অধ্যাপক শফিউলের বাসায় যাতায়াত করত। এমন কি শফিউলের কাপড়চোপড় ধোয়া ও গৃহস্থালির কিছু কাজও করে দিত। বর্তমানে ওই মেয়েকে মাসহ নগরীর শাহ মখদুম থানায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে। র‌্যাব মেয়েটিকে তিনদিন জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। ওই মেয়েকে পুলিশ এখনও গ্রেফতারও দেখায়নি। এই মেয়েটি হত্যাকাণ্ডের কারণ কিনা তাও পরিষ্কার করেনি পুলিশ।
অধ্যাপক শফিউল হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও মতিহার থানার ওসি আলমগীর হোসেন যুগান্তরকে জানান, পুলিশের রিমান্ডে থাকা ১১ আসামির কাছ থেকে এখনও কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষকদের সংগঠন প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সদস্য প্রফেসর জালাল উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখনও হত্যার মোটিভ উদ্ধার ও খুনিরা গ্রেফতার না হওয়াটা দুঃখজনক। পুলিশ আইওয়াশ করতেই যাকে তাকে ধরে আনছে। গতকাল দুপুরে সমাজবিজ্ঞান সমিতি আয়োজিত শোকসভায় নিহতের বোন ওয়াসিম রুমানা বলেন, দেশ এখনও স্বাধীন হয়নি। আপনারা সজাগ হোন। স্বাধীনতাবিরোধীরাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। খুনিদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। হত্যাকাণ্ডের জন্য জঙ্গিদের দায়ী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও নিহত শফিউলের একমাত্র ছেলে সৌমিন শাহরিদ জেভিন ওই শোকসভায় বলেছেন, ‘এটা সম্পূর্ণ জঙ্গি হামলা, মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন আমার বাবা।’ তিনি আরও বলেন, আমিও তো বাবার মতাদর্শী ও একই ভাবধারার লোক। আমি আসলেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, তদন্ত সঠিকভাবে এগোলে গত কয়েক দিনে হয়তো অনেক কিছু উদঘাটন করা সম্ভব হতো। তবে এমনও হতে পারে, পুলিশ তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতেই সময় নিচ্ছে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাই কোনো ‘ম্যাজিক’ আশা না করে তাদের আরও কিছুটা সময় দেয়া দরকার।’
বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহী মহানগর পুলিশের নতুন কমিশনার মো. শামসুদ্দিন যোগদান করেছেন। পরে তিনি মহানগর পুলিশের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। বিকালে তিনি শফিউল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তবে এ নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
শিবির সভাপতিকে গ্রেফতারে ছাত্রলীগের আলটিমেটাম : বেলা ১২টার দিকে শিক্ষক হত্যার বিচারের দাবিতে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে শিবির সভাপতি আশরাফুল ইসলাম ইমনকে গ্রেফতারে প্রশাসনকে ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেন রাবি ছাত্রলীগ সভাপতি মিজানুর রহমান রানা।
সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক খালিদ হাসান বিপ্লবের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে আরও বক্তব্য দেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাইদুর ইসলাম রুবেল, ইয়াসির আরাফাত সৈকত ও রাবি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আহমদ আলী মোল্লা। বক্তারা বলেন, জাতিকে মেধাশূন্য করতে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র একের পর এক শিক্ষক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকরা হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচার দাবিতে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন এবং শিক্ষকদের কালোব্যাজ ধারণ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন।
মেয়রের সঙ্গে শিবির নেতাদের বৈঠক : দুপুরে রাসিক মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মহানগর শিবিরের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক নাফিস রাইয়ান, সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন প্রমুখ। এ সময় শিবির নেতারা ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কবলে ইসলামী ছাত্রশিবির’ নামের একসেট বই মেয়রের হাতে তুলে দেন।

No comments

Powered by Blogger.