সন্ত্রাস-প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে মানুষ মুক্তি চায়

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করলেও পরে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে এসেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনষ্ট করেছেন। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। আবদুল আলিমকে মন্ত্রী বানিয়েছেন। খালেদা জিয়াও স্বাধীনতাবিরোধী নিজামী-মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়েছেন। তাদের হাতে শহীদের রক্তে ভেজা পতাকা তুলে দিয়েছেন। এর চাইতে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, এক দিনের জন্য নয়, ৩৬৫ দিনের গণতন্ত্র চাই। প্রতিহিংসার রাজনীতি চিরতরে মুছে দিতে চাই। ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর দেশে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাম- আজও তা বহাল আছে। তবে গণতন্ত্রের নামে দেশে এখন যা চলছে তা মানুষ চায়নি। ৫ বছর পর পর একবার জনগণের ভোট নিয়ে যারা সরকার গঠন করে তারা বাকি সময় আর জনগণের খবর নেন না। জনগণের ভালো-মন্দে তাদের কিছু যায় আসে না। এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। আমরা গরুর গাড়ি জাদুঘরে পাঠিয়েছি। সুযোগ পেলে দারিদ্র্যকে ইতিহাসের ঘরে পাঠিয়ে দেব। ক্ষুধা ও মঙ্গাকে মুছে দেব। সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব।
বুধবার বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে জাতীয় পার্টি আয়োজিত মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন। দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক মাহজাবীন মোর্শেদ এমপির সভাপতিত্বে মহাসমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন- জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, মহাসচিব সাবেক মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলু এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি, একেএম মাইদুল ইসলাম এমপি, এমএ হান্নান এমপি, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, এসএম ফয়সল চিশতী, গোলাম কিবরিয়া টিপু এমপি, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা এমপি, মোর্শেদ মুরাদ ইব্রাহিম, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া।
লাখো মানুষের এই সমাবেশে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, লালদীঘির ময়দান আজ কানায় কানায় পূর্ণ। মহাসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। কারণ মানুষ এখন মুক্তি চায়। তারা মুক্তি খুঁজছে। রাজনীতিতে এখন দমবন্ধ করা পরিবেশ। মানুষ স্বচ্ছ রাজনীতি চায়, শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়। ঘুষ-দুর্নীতি-সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-লুটপাট ও প্রতিহিংসা থেকে মুক্তি চায়। জাতীয় পার্টি জনগণের সেই কাক্সিক্ষত মুক্তির পথ দেখাতে চায়। তিনি বলেন, দেশে সন্ত্রাসের রাজনীতি কায়েম হয়েছে। প্রতিহিংসার রাজনীতি কায়েম হয়েছে। দেশ অকার্যকর হতে চলেছে।
বিগত সময়ের সমালোচনা করে এরশাদ বলেন, চলমান ২৪ বছর আর এর আগের ৯ বছরের তুলনা করুন। ৯ বছরে কি সভা-সমাবেশে বোমা হামলা হয়েছে? জঙ্গি হামলা হয়েছে? টেন্ডারবাজি কাকে বলে তা কি জনগণ জাতীয় পার্টির সময় দেখেছে?
তিনি বলেন, অধিকারের এক রিপোর্টে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে ১৬২ জন গুম হয়েছে। এর মধ্যে ২০ জনের লাশ পাওয়া গেছে। জাতীয় পার্টির শাসনামলে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এ সময় এরশাদ তার শাসনামলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতু জাতীয় পার্টির সময় হয়েছে।
সাবেক এই রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, জাতীয় পার্টি ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন দেশের যুবশক্তি পালিয়ে মালয়েশিয়ায় যায়। থাইল্যান্ডে গিয়ে তারা ক্রীতদাস হয়। দেশে এখন চলছে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ, দলীয়করণ। সেই সঙ্গে প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রতিদিন ধর্ষণের খবর, ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি, হত্যা, এসিড সন্ত্রাস, যৌতুকের আগ্রাসন, মানুষের টুকরো-টুকরো লাশ। দুর্বল প্রশাসন, সুশাসনের অভাব এবং বিচার ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় দেশের আজ এ অবস্থা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অস্থির অসহিষ্ণু রাজনীতি। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য দরকার জাতীয় পার্টির সরকার।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আরও বলেন, আমরা হরতালে বিশ্বাস করি না। হরতালে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় ক্ষতি হয়। অর্থনীতির ক্ষতি হয়। আমি হরতাল নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু এই দাবি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। জাতীয় পার্টি অহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। জনগণকে সংগঠিত করে জাতীয় পার্টি হত্যা-খুন-গুম-দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করতে চাই। তিনি বলেন, দেশের মানুষ শুধু ভোটের দিন গণতন্ত্র ভোগ করে। ভোটের পর আর কেউ জনগণের কথা মনে রাখে না। শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্রের মাপকাঠি নয়। গণতন্ত্র এখন সংসদ ভবনের মধ্যেই আবদ্ধ।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, আমরা ক্ষমতায় গেলে গণতন্ত্র মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেব। উপজেলা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে থাকবে। তৃণমূল পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। জাতীয় পার্টিই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল- দাবি করে তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি। সত্যিকারের জাতীয়তাবাদীরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা তুলে দিতে পারে না। বিএনপি এই কাজটি করেছে। তারা সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী শক্তি নয়। ক্ষমতায় গেলে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করে এরশাদ বলেন, ঢাকার ওপর চাপ কমানো হবে। প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। চট্টগ্রামকে সত্যিকারের বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।
এরশাদ বলেন, বড় দুই দল সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় পার্টি আবার ক্ষমতায় এলে মানুষের মনের আশা পূরণ হবে। দেশে শান্তি ফিরে আসবে। খুন-গুম-অপহরণ বন্ধ হবে। তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আরও একবার জনগণের কাছে সুযোগ দাবি করে বলেন, আমাকে একবার সুযোগ দিন। আমি দেশটাকে বদলে দেব। নতুন বাংলাদেশ গড়ব। নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশ গড়ে দেব। জাতীয় পার্টি পারে, পারবে। আমরা পারব, আমরা পারব। আমরাই জনগণকে শান্তি দিতে পারব। সুখ দিতে পারব। জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারব।
সমাবেশে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হাজী সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন, অ্যাডভোকেট হুমায়ূন রশীদ, তাজ রহমান, সুনীল শুভ রায়, যুগ্ম-মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু, গোলাম মোহাম্মদ রাজু, নুরুল ইসলাম নুরু, জহিরুল আলম রুবেল, স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সদস্য সচিব মোবারক হোসেন আজাদ, যুবসংহতির সাধারণ সম্পাদক মো. বেলাল হোসেন, জাতীয় পার্টির যুগ্ম দফতর সম্পাদক আবুল হাসান আহম্মেদ জুয়েল, শিল্পবিষয়ক সম্পাদক কাজী মামুনুর রশীদ, যুগ্ম এনজিওবিষয়ক সম্পাদক আবু সাঈদ স্বপন, ছাত্র সমাজের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিরু, সংসদ সদস্য আমির হোসেন ভূঁইয়া, মুনিম চৌধুরী বাবু, অ্যাডভোকেট আলতাফ আলী, হাজী মোহাম্মদ ইলিয়াস, কেন্দ্রীয় নেতা সোমনাথ দে, আমির উদ্দিন ডালু, তরুণ বসু, কাজী শামসুল ইসলাম রঞ্জন।
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষ পরিবর্তন চায়। মানুষ পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। শুধু জাতীয় পার্টিই এই পরিবর্তন আনতে পারে। ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দান থেকে এরশাদের নেতৃত্বে এই পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হল।
জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলু বলেন, জাতীয় পার্টি নতুন করে জেগে উঠেছে। মানুষ আর দুই নেত্রীকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তারা চান এরশাদকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে। আগামী দিনের সরকার হবে এরশাদের সরকার। আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি আবার সরকার গঠন করবে।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম চট্টগ্রামের বীর জনতাকে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশে উপস্থিত হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও এই নবজাগরণের সঙ্গী হতে ছুটে এসেছি। কেননা এক উজ্জ্বল আলোময় ভবিষ্যৎ আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অন্ধকার পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে। তিনি আরও বলেন, জাতীয় পার্টি আজ আর দুর্বল দল নয়। আমরা সংসদে বিরোধী দলের আসনে সমাসীন। তিনি আরও বলেন, আজ আমরা এমন এক সময়ে এখানে মিলিত হয়েছি, যখন সারা দেশের মানুষ দিশেহারা। এক দল চায় ক্ষমতাকে কিভাবে পাকাপোক্ত করা যায়, আরেক দল চায় কিভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায়। এই দুই দলের রশি টানাটানিতে দেশের সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এজন্য আজ দরকার এরশাদের সরকার। অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম প্রশ্ন রেখে বলেন, সফল রাষ্ট্রনায়ক এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির ৯ বছরের শাসনামল যে স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে স্বর্ণযুগ ছিল এ কথা কী আপনারা অস্বীকার করতে পারবেন? যদি না পারেন তাহলে আর দ্বিধা কেন? আসুন আরেকবার আমরা সমবেতভাবে চেষ্টা করে দেখি সেই স্বর্ণযুগ বাংলার মানুষকে ফিরিয়ে দেয়া যায় কিনা? তিনি আরও বলেন, দেশের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে আসুন সব ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় পার্টিকে আবার সুসংগঠিত করি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আবার জাতীয় পার্টি রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবে। এরশাদ রাষ্ট্র চালাবেন।
সভাপতির বক্তব্যে মাহজাবীন মোর্শেদ বলেন, ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানের এই মহাসমাবেশ মহাসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয়েছে মানুষ আজও এরশাদের শাসনামলের কথা মনে রেখেছে। তারা আগামীতে আবার এরশাদের শাসনামলে ফিরে যেতে চান। এরশাদকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চান।
লালদীঘির ময়দানে জনসমুদ্র : দীর্ঘদিন পর বীর চট্টলার ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত জাতীয় পার্টির এই মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়। প্রখর খরতাপ উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকা থেকে হাজার-হাজার নেতাকর্মী-সমর্থক এবং জনতা দুপুরের মধ্যে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। ঢাক-ঢোলসহ নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে নানা রঙে সেজে তারা যোগ দেন জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশে। বিকাল গড়াতেই মহাসমাবেশ লালদীঘির ময়দান ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে। লাখো মানুষের উপস্থিতিতে মহাসমাবেশ পরিণত হয় জনসমুদ্রে।

No comments

Powered by Blogger.