ওসি আর নেতা মিলে ঘুষ ভাগাভাগি

দোহার থানার ওসি মাহমুদুল হকের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের সঙ্গী জেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা। ওসির ঘুষ বাণিজ্যের ৪০ শতাংশ দিতে হয় ওই নেতাকে, আর ৬০ শতাংশ নেন ওসি। ওই নেতা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে মাহমুদুল হককে ওসি করার নেপথ্যে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ওসি এবং ওই নেতার দহরম-মহরম যৌথ ঘুষ বাণিজ্যের খবর স্থানীয়দের কাছে অনেকটা ওপেনসিক্রেট। প্রভাবশালী এই আওয়ামী লীগ নেতা থানায় বসে কিংবা ফোনেই ঠিক করে দেন কাকে ধরতে হবে কাকে ছাড়তে হবে। কার কাছ থেকে কত টাকা আদায় করতে হবে। বাস্তব অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, তিনিই দোহার থানার বিকল্প ওসি। সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, দোহারে এমন কোনো খাত নেই যেখান থেকে ওসি মাহমুদ ঘুষ নেন না। অন্যতম খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্রেফতার ও আটক বাণিজ্য, মাদকের স্পট, মাছের আড়ৎ, ফুটপাতের দোকান, হাট-বাজার, অবৈধ মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, অটোরিকশা স্ট্যান্ড, ভটভটি, বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহন থেকে চাঁদা ও মাসোহারা নেন ওসি মাহমুদ। এছাড়া মোটা অংকের ঘুষ আদায় করেন বালু মহাল, হুন্ডি ব্যবসায়ী ও জুয়ার বোর্ড থেকে। এছাড়া ওসির গ্রেফতার ও আটক বাণিজ্যের আরেকটি বড় অস্ত্র হল দণ্ডবিধির ৫৪ ধারা ও রিমান্ডে নিয়ে আসামিদের নির্যাতন করা এবং ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায় করা।
সূত্র জানায়, ওসি হওয়ার জন্য মাহমুদুল হক পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে ১৬ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে থানার সহকর্মীদের প্রচার করেন। আর এই টাকা তোলার জন্য তিনি ঘুষ অভিযানে নিজেকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখেন। এ কাজে ব্যবহার করেন তার খয়ের খাঁ ও দালাল হিসেবে পরিচিত কিছু রাজনৈতিক নেতাকে। এজন্য দালালদের ধরিয়ে দেয়া তালিকা অনুযায়ী ওসি এলাকার জামায়াত-শিবির ও বিএনপির নেতাকর্মীদের টার্গেট করে গ্রেফতার ও বিভিন্ন মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখান। অনেক ক্ষেত্রে এসব কাজ রাজনৈতিক দালালচক্র করে থাকে। তারা জামায়াত কর্মীদের আটক করে বা বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে ঘুষ আদায় করেন। আর বিরোধী দলের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষিত হলে ওসির অবস্থা পোয়াবারো হয়। শুরু হয়ে যায় গণগ্রেফতার বাণিজ্য। যাকে তাকে ধরে নিয়ে নাশকতা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার ভয় দেখান। নিরীহ মানুষকে আটকের পর একটি অংশকে ঘুষ নিয়ে থানা থেকেই ছেড়ে দেন। আবার কিছু লোককে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান করেন। ওসি মাহমুদ টাকা আদায় করেন থানার ক্যাশিয়ার মোহাম্মদ আলী ও ড্রাইভার ফিরোজের মাধ্যমে। কিন্তু নির্ধারিত রেটের বাইরে ঘুষের পরিমাণ কম হলে ওসি চরম ক্ষুব্ধ হন। পরে এর খেসারত দিতে হয়।
আটক বাণিজ্যের কিছু নমুনা : ৯ নভেম্বর বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচির দিন ইউপি মেম্বার শাসমুল হকসহ ৫ জনকে আটক করে দোহার থানা পুলিশ। পরে শামসুল হকের কাছ থেকে ৩০ হাজার এবং অন্যদের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা করে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৭ অক্টোবর দোহার মধুরচর এলাকার আকবর হাওলাদারের ছেলে জামায়াত কর্মী প্রবাসী মো. মাসুদকে আটক করে পুলিশ। বিদেশ থেকে বাড়ি ফেরা দেড় মাসের মধ্যে তার বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ এনে দ্রুত বিচার আইনে মামলা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। পরে ওসির চাহিদা অনুযায়ী তার পরিবার ৭০ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হন। এরপর সমঝোতা অনুযায়ী ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। সম্পূর্ণ নির্দোষ হিসেবে মাসুদ আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে এক তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদেশ চলে গেছেন। যাওয়ার সময় তার পরিবারকে দুঃখ আর ক্ষোভের সঙ্গে বলে গেছেন, বিদেশ থেকে আয় করা ঘাম ঝরানো টাকা আজ ওসিকে দিয়ে চলে যেতে হল। এমন দেশ তো আমরা চাইনি। তার এই ক্ষোভের কথা যুগান্তরকে জানিয়েছেন তার বাবা বয়োবৃদ্ধ আকবর হাওলাদার। মাসুদের পরিবার সূত্র জানায়, তার আরও ২ মাস বাড়ি থাকার কথা ছিল। কিন্তু ফের হয়রানি হওয়ার ভয়ে ছুটি শেষ হওয়ার আগেই তিনি বিদেশে চলে গেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান যুগান্তরকে জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি এবং জামায়াত কর্মীরা দোহারে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। কিন্তু ওসির হয়রানি ও আটক বাণিজ্যে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা এখন প্রতিবাদ জানাতে মাঠে সরব হতে শুরু করেছেন। অর্থাৎ ওসিই বিরোধী দলের নেতাদের সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামানোর ব্যবস্থা করছেন।
জয়পাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা যুগান্তরকে বলেন, অক্টোবরের শেষ দিকে দোহার থানার এসআই আবদুল কাদের মধ্য রাতে অভিযান চালিয়ে উত্তর জয়পাড়া এলাকা থেকে খলিল বাহিনীর ৪ ক্যাডারকে গুলিসহ আটক করে। এই চার ক্যাডারকে ছাড়াতে ওসির সঙ্গে রাতে দেনদরবার হয়। এক পর্যায়ে নগদ ৩ লাখ টাকা নিয়ে ওসি বিষয়টির রফা করেন। অস্ত্র আইনে মামলা না নিয়ে আইওয়াশ হিসেবে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে এলাকায় মিষ্টি বিতরণসহ আনন্দ উৎসব করে। এ ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দেয়। তারা ওসির এ রকম ভূমিকায় হতবাক হয়ে যান। ২৮ অক্টোবর রাতে আনোয়ার, কাশেম আলী, রনি ও তার বোনের জামাইকে বাড়ি থেকে বিনা অপরাধে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। পরে ১৭ হাজার টাকায় তাদের মুক্তি মেলে।
এছাড়া দোহার উপজেলায় বিপুলসংখ্যক চোরাই মোটরসাইকেল রয়েছে। থানা পুলিশ প্রত্যেক দিন গড়ে ২ থেকে ৩টি করে অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করে থানায় নেয়। ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করে পরে ছেড়ে দেয়া হয়। এমনকি মোটরসাইকেল চোর ধরে বড় অংকের টাকা ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে এই ওসির বিরুদ্ধে। সূত্র জানায়, ঢাকা জেলার মধ্যে দোহার থানায় মামলার সংখ্যা সবচেয়ে কম দেখিয়ে আইজি মেডেলও জিতেছেন ওসি মাহমুদ। আসলে এটা তার কূটকৌশল। অত্যন্ত ধুরন্ধর প্রকৃতির এই ওসি একদিকে মামলা না নিয়ে সমানে ঘুষ আদায় করছেন, অন্যদিকে থানায় মামলার সংখ্যা কম দেখিয়ে নিচ্ছেন আইজির কাছ থেকে পুরস্কার। অর্থাৎ তিনি এক ঢিলে দুই পাখি মারছেন। অথচ ওসির এই চাতুরতায় এলাকার মানুষের কোনো লাভ নেই। বরং এলাকার আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ও জনহয়রানি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। সাধারণ ভোটারা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন জনপ্রতিনিধিদের ওপর। কিন্তু নামকাওয়াস্তে করিৎকর্মা দাবিদার এই ওসি তো একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন। তাকে নাকি কোথাও জবাবদিহি করতে হয় না। কেননা, তার খুঁটির জোর নাকি খুব শক্ত। তাই এত বদনাম করার পরও এই ওসি এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন। যেখানে সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে ওসির ঘুষ নেয়ার সাক্ষ্য দিচ্ছেন সেখানে কীভাবে এই ওসি বহাল রয়েছেন তা নিয়ে এলাকাবাসী বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.