স্কুল শিক্ষার গাঁথুনিটা শক্ত হওয়া চাই by একে এম শাহনাওয়াজ

সবকিছুর রাজনীতিকরণ সুস্থ ধারার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। অবস্থার বাস্তবতায় একে রাজনীতিকরণ না বলে কুরাজনীতিকরণ বলা শ্রেয়। কে যে আমাদের ক্ষমতাসীন দলগুলোকে বুঝিয়েছে বেশিসংখ্যক প্রথম বিভাগ না পেলে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের কৃতিত্ব প্রকাশ পাবে না। অবশ্য নিজ মেধায় অনেক বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী উজ্জ্বল ফলাফল করলে কোনো বাধা নেই। কিন্তু বলপূর্বক বা কৌশলে মেধাবী বানানোতে রয়েছে সংকট।
অধুনা প্রথম-দ্বিতীয় বিভাগের যুগ নেই। এখন গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফলাফল হয়। উর্বর ভাবনা এ পদ্ধতিতেও আছে। ধরি যদি ৭০ ভাগ বি, ২০ ভাগ এ আর ১০ ভাগ বি প্লাস পায় তাহলে চলবে না- ফলাফলে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে। এ আর এ প্লাসে যত সয়লাব করে ফেলা যাবে, তত শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর সরকারের কৃতিত্বের আলো ছড়াবে। এ কারণেই স্কুলের শিক্ষকদের কাছে কৌশলী বার্তা নাজিল হয়, ছাত্রছাত্রীরা কষ্ট করে কিছু লিখলেই পরীক্ষকের কলম সচল করতে হবে হাত খুলে নম্বর দিতে। স্কুলগুলোতে শতভাগ পাসের রেকর্ড গড়তে হবে। এভাবেই পাস, এ, এ প্লাস আর স্বর্ণ মোড়ানো এ প্লাসের জোয়ারে মেধাবী শিক্ষার্থীরা মেধাচর্চার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। পুরোটা কেড়ে নিয়েছে জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতা। ঘাড়ের ওপর একের পর এক প্রাইভেট টিউটরের নিঃশ্বাস। একের পর এক শিক্ষকের বাড়ি আর কোচিং সেন্টারে ছোটাছুটি। এভাবে ছকেবন্দি হয়ে গেছে পড়াশোনা। ছক পূরণ করতে করতে সময় শেষ। ফলে সিলেবাসের বাইরে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে জানা হয় না। সুকুমার রায় অচেনা থেকে যান। হ্যান্ডস ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন আর পড়ার টেবিলে থাকে না। বাঙালির হাজার বছরের সভ্যতা-সংস্কৃতি জানার অবকাশ কোথায় এ দুর্ভাগা শিক্ষার্থীদের!
এই ছকবন্দি লেখাপড়ার পরিণতি কেমন, আমরা যারা দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি তারা টের পাচ্ছি। মেধা বিস্ফোরণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাবীদের মুখ থুবড়ে পড়া নিয়ে এবার বেশ বিতর্ক জমেছিল। যারা রাজনীতির বদ্ধ জলাশয়ে ঘোরাফেরা করেন, তারা দায়ী করছেন পরীক্ষা পদ্ধতি ও প্রশ্নপত্রের অন্যায় কড়াকড়িকে। অন্যপক্ষ বলতে চাচ্ছে, জিপিএ-৫ ধরনের ফলাফল প্রমাণ করছে না এসব শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত যতটুকু মেধাচর্চা করে আসার কথা তা করে আসতে পারছে। এর অর্থ এই নয় যে, সব শিক্ষার্থীর মেধার ঘাটতি বয়েছে। বরঞ্চ তারা যে শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে, তাতে সিলেবাসের ছকের বাইরে জানার জগৎ শানিত করার তেমন সুযোগ নেই বললেই চলে।
গলদ তো একটা আছেই। আমাদের শিক্ষার্থীদের অবমূল্যায়ন করছি না, তবে ওদের দুর্ভাগ্য নিয়ে ভাবছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাচ্ছে ফলাফলে আলোকোজ্জ্বল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সরকারের কৃতিত্ব সাধারণ্যে প্রকাশ পাক। ভর্তিযুদ্ধে উচ্চ গ্রেড পাওয়ার একটি ভূমিকা আছে, আবার অভিভাবকদের মধ্যে ছেলেমেয়ের ফলাফলের সঙ্গে সামাজিক মর্যাদা রক্ষার তাড়নাও রয়েছে। তাই শিক্ষার্থী জানার জন্য নিজেকে কতটা শানিত করতে পারল সেটা মোটেও বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। ছকবন্দি পদ্ধতিতে ফলাফল কতটা উজ্জ্বল হল সেটাই বিবেচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে।
এ কারণে এখনকার উজ্জ্বল ফলাফল করা ছাত্রছাত্রীদের অনেক ছেঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার পর দেখা যায় তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম অল্প কিছুসংখ্যক বাদ দিলে অধিকাংশের পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে জানার সঞ্চয় খুবই কম। গুণগত দিক থেকে তাদের অধিকাংশই মেধাবী এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ভুল পদ্ধতিতে এ, এ প্লাসের প্রতিযোগিতায় ছিল বলে যৌক্তিকভাবে নিজেকে তৈরি করতে পারেনি। তাই এ শূন্যতা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাকে প্রচণ্ডভাবে তাড়িয়ে বেড়ায়। জাতিও সামগ্রিক অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি, দুদশক আগেও যেসব ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেত তাদের ভিত্তিটা অনেক বেশি সবল ছিল। এটি আমি সাধারণীকরণ করে বলছি। অন্তত প্রথমবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি, বাংলা উভয় ক্ষেত্রে ভাষা ও বানান জ্ঞান অনেক ভালো ছিল। এখন তো সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশের অনুশীলনী পরীক্ষায় বাংলা বানানের ভুল কাটতে কাটতে পৃষ্ঠা লাল হয়ে যায়। তখন ভাবতে হয়, এ অবস্থা নিয়ে এ ছাত্র বা ছাত্রীটি স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরোল কী করে!
উত্তর কিছুটা জানা ছিল। তবে একটি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলে পাঠকের অনুধাবনে সুবিধা হবে। তার আগে আমি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বন্ধুদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। মাস তিনেক আগে একজন স্নেহভাজন কলেজ শিক্ষিকা কোনো এক গ্রন্থ প্রকাশকের পক্ষ থেকে আমাকে অনুরোধ করল একটি পাঠ্য বই রচনা সম্পন্ন হয়েছে, প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে আমি যাতে পাণ্ডুলিপিটি দেখে দিই। আমি আমার ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কথা জানিয়ে অপারগতা প্রকাশ করলাম। ওরা নাছোড়বান্দা। বলল, স্যার আপনার তেমন একটা পরিশ্রম করতে হবে না। এ বইটির এক এক ইউনিট দেশের নামকরা কলেজের এক একজন শিক্ষক লিখেছেন। তারপরও বেশ কয়েকজন শিক্ষক মিলে সম্পাদনা করেছেন। তারা সবাই পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করেছেন যথেষ্ট ঝাড়াই বাছাই করে। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন শিক্ষক যুক্ত রয়েছেন এ গ্রন্থ রচনায়। এখন ছাপার জন্য প্রেসে যাওয়া বাকি। সুতরাং আপনি একবার চোখ বুলিয়ে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকলেই আমরা আনন্দ পাব। অগত্যা রাজি হলাম। পাণ্ডুলিপি এলো। ফুলস্কেপ কাগজে চমৎকার টাইপ করা ৪০০ পৃষ্ঠার বেশি সুবিশাল পাণ্ডুলিপি। প্রথম ১০ পৃষ্ঠা দেখে আমি ভীত হয়ে পড়লাম। প্রকাশককে খবর দিলাম। বিনয়ের সঙ্গে বললাম, দয়া করে পাণ্ডুলিপিটি ফেরত নিয়ে যান। কিছুটা ভাষাগত আর বেশিরভাগ ভুল বানান কাটতে কাটতে পৃষ্ঠাগুলো রীতিমতো লাল হয়ে গেছে। ৪০০ পৃষ্ঠার মহাসমুদ্রে আমি সাঁতার দেব কেমন করে! অবস্থা বুঝে প্রকাশক থ। এবার হাজার অনুরোধের জালে আমাকে আটকে ফেললেন। বললেন, আপনার কাছে না আনলে তো এ অবস্থায় ছাপা হয়ে যেত। এখন আপনি না দেখে দিলে বই প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে আপনাকে রাজি হতে হবে। পেশায় শিক্ষক হওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে নিলাম। দীর্ঘ পরিশ্রমে প্রুফ সংশোধন করতে হল। পাঠক, বিস্মিত হলেও বিশ্বাস করবেন, এ ৪০০ পৃষ্ঠার মধ্যে একটি পৃষ্ঠাও নির্ভুল পেলাম না!
এরপর থেকে আমার কাছে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে এত ভালো ফলাফল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের এ দশা কেন। আমার কাছে স্কুলের শিক্ষকদের গড়পড়তা অবস্থা কী তা জানার মতো উদাহরণ নেই। যখন দেখি মানবেতর জীবনযাপনের উপযোগী বেতন কাঠামোতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেসরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, তখন এর চেয়ে ভালো আশা করব কেন!
আমরা মনে করি, প্রকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে হলে স্কুলগুলোর সার্বিক মানোন্নয়নে নজর দিতে হবে। এ নজরদারি সবচেয়ে বেশি থাকবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যেখানে শিক্ষার্থীর মান ও মেধার প্রথম ভিত্তি তৈরি হবে। দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষকের বেশি প্রয়োজন এখানে। সুতরাং এমন যোগ্যদের আকর্ষণ করতে হলে শিক্ষকের বেতন কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সবার আগে ভাবতে হবে।
নতুন শিক্ষা কাঠামোর কিছু কিছু দিক নিয়ে আমরা অনেকেই প্রশংসা করেছি। এর একটি সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়া। ভাবা হয়েছিল, এবার গাইডবই মুখস্থ করা থেকে সরে আসতে হবে। শিক্ষার্থীর সৃজনশীল ক্ষমতা বাড়বে। মাথা খাটিয়ে উত্তর লিখতে হবে। এ কারণে শিক্ষার্থীর গুণগত মান বাড়বে। কিন্তু অন্যায়-দুর্নীতি আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দেশে কি আর শুভ আয়োজন সম্পন্ন করা সম্ভব হয়! জানা গেল, সৃজনশীল প্রশ্ন-উত্তরের গাইডবই তৈরি হয়ে গেছে। এ ধারার একজন প্রকাশক জানালেন, এখন প্রকাশকরা স্কুল কেনেন। আমার কৌতূহল বাড়ল। তিনি বুঝিয়ে দিলেন। অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ বিশেষ কিছুর বিনিময়ে সৃজনশীল প্রশ্নের কোনো বিশেষ গাইড তাদের স্কুলে পাঠ্য করে দেয়। সেই বইতে যে সৃজনশীল প্রশ্ন ও তার উত্তর দেয়া আছে, স্কুলের নির্বাচনি পরীক্ষাগুলোতে তা-ই আসবে। অতএব মুখস্থ বিদ্যাই লিখে দিয়ে আসবে শিক্ষার্থী। জানি না এ বিবরণ কতটা সত্য। সত্য হলে শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশের সব আয়োজন ভেস্তে যাবে।
স্কুল শিক্ষার হযবরল অবস্থার আরেকটি কারণ বিনা পয়সায় সরবরাহকৃত এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত বইগুলোয় তথ্যগত ভুলের ব্যাপক উপস্থিতি, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়কেই বিভ্রান্ত করছে। কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় গ্রন্থে মুদ্রিত ভুলের ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে। বছরের পর বছর এসব ভুল পড়ে যেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। অথচ এ নিয়ে কোনো পক্ষের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। স্কুল শিক্ষকরা এসব ব্যাপারে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন কিনা জানি না। পত্রিকায় এ ধরনের কোনো রিপোর্ট বা পত্র প্রকাশিত হয়েছে কিনা তাও আমার জানা নেই। আমি নিজ কৌতূহল নিবারণের জন্য উল্লিখিত জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি জানালেন, শিক্ষক বা কোনো পক্ষের অভিযোগে নয়, তিনি তার নিজের গরজেই অনুসন্ধান করেছেন।
ক্লাস টুতে পড়া এক পুত্রের মা টেলিফোনে জানালেন তিনি বিপাকে পড়েছেন। পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে, কোন মাসে নবান্ন হয়। ছেলেটি জানে তার এনসিটিবি থেকে প্রকাশিত আমার বাংলা বইতে বলা আছে হেমন্তকালে নবান্ন হয়। ও জানে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস মিলে হেমন্ত ঋতু। একটি মাস চাওয়ায় ছেলে লিখে দিয়ে এসেছে কার্তিক মাস। মা চিন্তিত। তিনি জানেন, কার্তিক হচ্ছে মরা কার্তিক। তখন তো খাদ্যের আক্রা। নবান্ন উৎসব হয় কেমন করে! আমাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার বাংলাপিডিয়া খুললেন তিনি। সেখানে লেখা আছে, নবান্ন হয় পৌষ মাসে। এখন গোলক ধাঁধায় পড়ে গেছেন এ অভিভাবক। আমি উত্তর দিতে পারিনি। সম্ভবত আমিও গোলক ধাঁধায় পড়ে গেছি।
স্কুল শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়ন নিয়ে ভাবতে গেলে যেসব অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতার ছবি ভেসে ওঠে, তারই কয়েকটি ছিটেফোঁটা উপরে উল্লেখ করা হল। এতে বোঝা গেল সংকট একমুখী নয়, বহুমুখী। ফলে এ সত্য মানতে হবে, স্কুল শিক্ষার মানন্নোয়ন প্রকৃত অর্থে যদি আমরা চাই, তবে বাগাড়ম্বর আর বাহাদুরি নয়- বাস্তবতার উঠোনে দাঁড়িয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.