একটি ছবি ও একটি ট্রেন- আমরা এই রাজনীতির তীব্র নিন্দা জানাই by মাহফুজ আনাম
আজ আমরা এমন এক ছবির কথা লিখছি, যা ছাপতে পারিনি। লিখছি এমন এক ট্রেনের কথা, যে ট্রেনের ৫০০ জন যাত্রী হয় মারা পড়তেন, নয় তো মারাত্মকভাবে আহত হতেন। ছবিটি আমরা ছাপতে পারিনি। এটি ছিল খুব হূদয়বিদারক, অতি জীবন্ত আর বড় বেশি সামঞ্জস্যহীন।
এটা ছিল আনোয়ারা বেগমের (৪০) ছবি। সরাসরি তাঁর মাথা লক্ষ্য করে ছোড়া ককটেলের আঘাতে মগজের কিছু অংশ উড়ে যায়। আমাদের প্রতিবেদক জায়মা ইসলাম ওই দৃশ্যের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘চিকিত্সকেরা যখন আনোয়ারার মাথায় পেঁচানো কাপড় সরালেন, অনুধাবন করলেন তাঁর মাথা থেকে গলগলিয়ে বের হতে থাকা রক্ত বন্ধ করাটাই যথেষ্ট কাজ নয়, তাঁর খুলিটা রক্ষা করা হবে আসল কাজ। অস্ত্রোপচারের টেবিলে আনোয়ারা চাঁদির হাড়ের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, বের হয়ে ছিল তাঁর মগজের উপরিভাগ। ক্ষত থেকে বের হচ্ছিল গান পাউডারের উগ্র গন্ধ।’
আনোয়ারা বেগম সাধারণ মানুষ। একটি ব্যাংকে রান্নাবান্নার কাজ করতেন। সেদিন কাজ শেষে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। পথে বিরোধী দলের মিছিল দেখে এক পাশে সরে দাঁড়ান তিনি। তখনো জানতেন না আর মাত্র কয়েক গজ দূরেই তাঁর মৃত্যু। দেশে যা ঘটছে, এর সঙ্গে যার কোনো সম্পর্কই নেই, রাস্তার পাশে দাঁড়ানো এমন একজনকে লক্ষ্য করে ককটেল ছোড়া হলো কেন, তা বোধগম্য নয়। এখানে শুধু একটা জিনিসই বোঝা যায়, একজন মানুষকে হত্যার লক্ষ্য হচ্ছে আতঙ্ক সৃষ্টি।
সাবেদ আলী নামের একজন সিএনজি অটোরিকশা চালকের গাড়ি লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ছোড়া হলে তিনি আগুনে দগ্ধ হন। এতে তাঁর মুখমণ্ডল ও শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে যায়। তার বাম হাতের মাংস হাড় পর্যন্ত পোড়ে।
রুবেল নামের আরেক সিএনজি অটোরিকশা চালকের গল্পও একই। ককটেল বিস্ফোরণে তাঁর গাড়িতে আগুন লাগে। তাঁর বেলায় যা ঘটেছে, দুর্বৃত্তরা প্রথমে অটোরিকশা উল্টে দেয়। এতে ভেতরে আটকা পড়েন তিনি। এর পর ককটেল ছোড়া হয়। হামলাকারী যে তাঁকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল, এখানে তা পরিষ্কার। একজন সাহসী পথচারীর চেষ্টায় রক্ষা পান তিনি।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিএর দুজন কর্মী পরস্পরের দিকে ফুটন্ত পানি ছুড়ে মারেন। এ পানি গায়ে পড়ে সাত বছরের শিশু রাকিবের। শরীরের ১৫ শতাংশ ঝলসে যায় তার।
গত মঙ্গল ও বুধবাররের সহিংসতায় ১৬ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে বুধবারই মারা গেছেন সাতজন। গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন ২৯০ জন। একই সময়ে দুই শিশু নিহত হয় এবং ১৪ বছরের মনিরসহ ১৯ জন গুরুতর আহত বা দ্বগ্ধ হয়েছে। বাবার সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছিল মনির। ৪ নভেম্বর রাস্তার পাশে রাখা বাবার ভ্যানগাড়িতে ঘুমিয়ে ছিল মনির। এ সময় ওই গাড়িতে লাগানো আগুনে দগ্ধ হয় সে।
চট্টগ্রামগামী মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনে ৫০০ জন যাত্রী ছিল। চাঁদপুর ও লাকসামে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছিল। দুই কৃষক সময় মতো সতর্ক করে দেওয়ায় ট্রেনটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। শেষ রাতে ওই রেলপথের ৬০ ফুট উপড়ে ফেলা হয়েছিল। এতে ভোর পাঁচটার দিকে রওনা হয়ে যাওয়া ট্রেনটি বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতো। আকাশে ওড়ার সময় পেতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে একটি বিমানের যে ক্ষতি হয়, রেললাইন উপড়ে ফেলার ভয়াবহতাও একই রকম। এটা কীভাবে আমাদের নিয়তি হতে পারে? দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যেসব সাধারণ মানুষ জড়িত নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের হত্যার পরিকল্পনা কীভাবে করতে পারে দেশের নাগরিকদের একটি অংশ?
যে রাজনীতির লক্ষ্য মানুষ হত্যা করা, তা কখনো জনগণের রাজনীতি হতে পারে না। আজকাল ভেবেচিন্তেই মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। যেন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের নামে কিছু খুনিকে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যাদের মূল লক্ষ্য হত্যা করা, যানবাহন ও দোকানে আগুন দেওয়া। অন্য কথায় বলতে গেলে, তাদের কাজ হলো সর্বোচ্চ ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানো।
তা নাহলে যাত্রী সেজে হিউম্যান-হলারে আগুন দেওয়ার ঘটনার ব্যাখ্যা কী দেব? তারা চালকের পালানোর পথ বন্ধ করার চেষ্টা চালায়, যাতে তিনি পুড়ে মরেন। এ ধরনের সাধারণ যাত্রী সেজে গণপরিবহনে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা উঠে পড়ে। গান পাউডার ছিটিয়ে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে নামার শেষ মুহূর্তে জ্বলন্ত দেশলাই কাটি ছুড়ে মারে।
এটি কীভাবে অবাধ নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হতে পারে?
বাংলাদেশে আজ বিরোধীদলের কর্মীরা দেদার মানুষ মারছেন। এখানে একজন পথচারী মারা পড়েন তো সেখানে মারা যাচ্ছে একজন স্কুলছাত্র, আরেক জায়গায় হত্যা করা হচ্ছে কোনো সিএনজি অটোরিকশা চালককে। এসব হত্যার ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং পূর্বপরিকল্পিত হত্যার হিসেবে অবশ্যই নিন্দনীয়।
এ বছরের শুরুতে রাজনৈতিক আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেওয়ার পর থেকে যাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাদের রক্ত স্পষ্টতই খালেদা জিয়ার হাতে লেগে আছে। আমরা বিশেষত এ ব্যাপারে তাঁর দোষ ধরতে পারি যে নিরীহ পথচারীদের মৃত্যুতে তিনি কখনো নিন্দা জ্ঞাপন করেননি, বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনায়, যারা কোনোভাবেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। এতগুলো মৃত্যুর ঘটনায় তিনি কখনো সামান্য সহানুভূতি বা সমবেদনা জানাননি।
যাই হোক, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি বলতে পারবেন এসব ঘটনার জন্য তাঁর কোনো দায়দায়িত্ব নেই? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি মীমাংসিত প্রশ্ন নতুন করে তাঁর তুলে ধরাটাই কি বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মূল কারণ নয়? তিনি কি সর্বান্তকরণে বলতে পারবেন, বিরোধী দলকে আলোচনায় আনতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছেন? একটি সমাধানের লক্ষ্যে সরকার ও শাসক দলের পক্ষ থেকে যে যথেষ্ট নমনীয়তা দেখানো হয়েছে, খতিয়ে দেখতে গেলে এই দাবি কি টিকবে? প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপক সাফল্যের সব দাবি যদি আমরা মেনেও নিই, তিনি যে বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় (অনেকে বলেন এ মনোবৃত্তি তাঁর কখনো ছিল না) পৌঁছাতে এবং স্বাধীনতার উত্সব বলে পরিচিত নির্বাচনমুখী শান্তির পথ এনে দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ, এর প্রমাণ রয়েছে।
আবারও বলছি, এ বছর ৪৮ দিনের হরতালে মারা গেছে ২৯০ জন। এর মধ্যে শুধু অক্টোবর-নভেম্বরেই মারা যান ৩৪ জন। এ ছাড়া দুই শিশু নিহত ও ১৯ জন আহত হয়।
কারা এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী?
আমরা এখানে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, রাজনৈতিক কারণেই এ সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। এটি জনসমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা। বিরোধী দল গণআন্দোলনের পথে যাওয়ার বদলে সহিংসতা ও হত্যার পথ বেছে নিয়েছে। শুরু তারা গণআন্দোলন গড়ার চেষ্টা করছে বলে মনে হয়েছে। রাজপথে কোনো গণসমাবেশ নেই, নেতা-কর্মীরা মাঠে নেই, আছে কেবল সন্ত্রাসীরা, যাদের কাজই হলো মানুষের শরীরে ও সম্পত্তিতে আগুন লাগানো।
মানুষের হূদয় ও মনকে জয় করার কোনো চেষ্টা চলছে না, চলছে কেবল মানুষকে সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা। তারা ৪৮ ঘণ্টার ‘অবরোধ’ কর্মসূচির সময় যেভাবে বাড়াল, এতে জনগণকে নিয়ে না ভাবার বিষয়টি বরং জোরালো হয়ে ওঠে। ‘অবরোধের’ চরিত্র হরতালের মতো হওয়ার কথা নয়। শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার মতো শহুরে নাগরিকদের বিচরণের কিছু বিষয় এ ধরনের আন্দোলনের আওতামুক্ত থাকার কথা। তবে শহরের ভেতরে চলাফেলা করলেই বেপয়োরা হামলার শিকার হয়েছে মানুষ। যেসব বিদ্যালয় খোলা রাখ চেষ্টা চলেছে, তাদের প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনায় মৃত্যুর জন্য যদি বিরোধীদলকে দায়ী করা হয়, তবে একইভাবে এর দায়ভার সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ওপরও বর্তায়। এ পরিস্থিতির সমাধানে ক্ষমতাসীন দল সত্যিকার অর্থে কখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সংলাপের জন্য জনগণের যে দাবি, তা পূরণে বিরোধীদলের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো সত্যিকার পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সংলাপের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও একের পর এক অবমাননাকর মন্তব্য সমঝোতার সম্ভাবনাকে নস্যাত্ করে দিয়েছে। বিরোধী দলের নেতাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার, জামিন নামঞ্জুর ও রিমান্ডে পাঠানোর মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়, ক্ষমতাসীন দল সফল কোনো সংলাপ চায় না, বরং পরোক্ষভাবে সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে।
সহিংসতা ও মৃত্যুর জন্য আমরা বিরোধী দলকে এককভাবে দায়ী করার পাশাপাশি সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকেও দায়ী করব। কারণ তারা সমাধানের বদলে আমাদের রাজনীতিকে আরও সংঘাতের পথে ঠেলে দিচ্ছে। এ লেখাটি যখন লিখছিলাম তখন খবর পেলাম, গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর শিশুপার্কের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে চারজন নারীসহ ১৯ যাত্রী দগ্ধ হন। গান পাউডার দিয়েই হোক আর পেট্রোল বোমা মেরেই হোক, হামলাটি যেভাবে চালানো হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। অবরোধের চরিত্র কী হবে—এ বিষয়ে বিরোধী দল সচেতনভাবে অস্পষ্টতা জিইয়ে রেখেছে। এটি কখনো হরতালের মতো হবে না।
আমরা এ রাজনীতির নিন্দা জানাই এবং এর প্রতি তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা ও চরম বিরক্তি প্রকাশ করছি। আমরা রাজনীতির নামে সহিসংতা ও মৃত্যুর এ উন্মত্ততার অবসান চাই। এই অনৈতিক, কুরুচিপূর্ণ, নৃশংস, স্বার্থান্বেষী ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির প্রতি আমাদের ধৈর্য এখন শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে এবং আমরা এর মূলনীতির প্রতি চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। এটা গণতন্ত্র হতে পারে না।
মাহফুজ আনাম, সম্পাদক, ডেইলি স্টার
আনোয়ারা বেগম সাধারণ মানুষ। একটি ব্যাংকে রান্নাবান্নার কাজ করতেন। সেদিন কাজ শেষে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। পথে বিরোধী দলের মিছিল দেখে এক পাশে সরে দাঁড়ান তিনি। তখনো জানতেন না আর মাত্র কয়েক গজ দূরেই তাঁর মৃত্যু। দেশে যা ঘটছে, এর সঙ্গে যার কোনো সম্পর্কই নেই, রাস্তার পাশে দাঁড়ানো এমন একজনকে লক্ষ্য করে ককটেল ছোড়া হলো কেন, তা বোধগম্য নয়। এখানে শুধু একটা জিনিসই বোঝা যায়, একজন মানুষকে হত্যার লক্ষ্য হচ্ছে আতঙ্ক সৃষ্টি।
সাবেদ আলী নামের একজন সিএনজি অটোরিকশা চালকের গাড়ি লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ছোড়া হলে তিনি আগুনে দগ্ধ হন। এতে তাঁর মুখমণ্ডল ও শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে যায়। তার বাম হাতের মাংস হাড় পর্যন্ত পোড়ে।
রুবেল নামের আরেক সিএনজি অটোরিকশা চালকের গল্পও একই। ককটেল বিস্ফোরণে তাঁর গাড়িতে আগুন লাগে। তাঁর বেলায় যা ঘটেছে, দুর্বৃত্তরা প্রথমে অটোরিকশা উল্টে দেয়। এতে ভেতরে আটকা পড়েন তিনি। এর পর ককটেল ছোড়া হয়। হামলাকারী যে তাঁকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল, এখানে তা পরিষ্কার। একজন সাহসী পথচারীর চেষ্টায় রক্ষা পান তিনি।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিএর দুজন কর্মী পরস্পরের দিকে ফুটন্ত পানি ছুড়ে মারেন। এ পানি গায়ে পড়ে সাত বছরের শিশু রাকিবের। শরীরের ১৫ শতাংশ ঝলসে যায় তার।
গত মঙ্গল ও বুধবাররের সহিংসতায় ১৬ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে বুধবারই মারা গেছেন সাতজন। গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন ২৯০ জন। একই সময়ে দুই শিশু নিহত হয় এবং ১৪ বছরের মনিরসহ ১৯ জন গুরুতর আহত বা দ্বগ্ধ হয়েছে। বাবার সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছিল মনির। ৪ নভেম্বর রাস্তার পাশে রাখা বাবার ভ্যানগাড়িতে ঘুমিয়ে ছিল মনির। এ সময় ওই গাড়িতে লাগানো আগুনে দগ্ধ হয় সে।
চট্টগ্রামগামী মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনে ৫০০ জন যাত্রী ছিল। চাঁদপুর ও লাকসামে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছিল। দুই কৃষক সময় মতো সতর্ক করে দেওয়ায় ট্রেনটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। শেষ রাতে ওই রেলপথের ৬০ ফুট উপড়ে ফেলা হয়েছিল। এতে ভোর পাঁচটার দিকে রওনা হয়ে যাওয়া ট্রেনটি বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতো। আকাশে ওড়ার সময় পেতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে একটি বিমানের যে ক্ষতি হয়, রেললাইন উপড়ে ফেলার ভয়াবহতাও একই রকম। এটা কীভাবে আমাদের নিয়তি হতে পারে? দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যেসব সাধারণ মানুষ জড়িত নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের হত্যার পরিকল্পনা কীভাবে করতে পারে দেশের নাগরিকদের একটি অংশ?
যে রাজনীতির লক্ষ্য মানুষ হত্যা করা, তা কখনো জনগণের রাজনীতি হতে পারে না। আজকাল ভেবেচিন্তেই মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। যেন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের নামে কিছু খুনিকে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যাদের মূল লক্ষ্য হত্যা করা, যানবাহন ও দোকানে আগুন দেওয়া। অন্য কথায় বলতে গেলে, তাদের কাজ হলো সর্বোচ্চ ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানো।
তা নাহলে যাত্রী সেজে হিউম্যান-হলারে আগুন দেওয়ার ঘটনার ব্যাখ্যা কী দেব? তারা চালকের পালানোর পথ বন্ধ করার চেষ্টা চালায়, যাতে তিনি পুড়ে মরেন। এ ধরনের সাধারণ যাত্রী সেজে গণপরিবহনে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা উঠে পড়ে। গান পাউডার ছিটিয়ে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে নামার শেষ মুহূর্তে জ্বলন্ত দেশলাই কাটি ছুড়ে মারে।
এটি কীভাবে অবাধ নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হতে পারে?
বাংলাদেশে আজ বিরোধীদলের কর্মীরা দেদার মানুষ মারছেন। এখানে একজন পথচারী মারা পড়েন তো সেখানে মারা যাচ্ছে একজন স্কুলছাত্র, আরেক জায়গায় হত্যা করা হচ্ছে কোনো সিএনজি অটোরিকশা চালককে। এসব হত্যার ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং পূর্বপরিকল্পিত হত্যার হিসেবে অবশ্যই নিন্দনীয়।
এ বছরের শুরুতে রাজনৈতিক আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেওয়ার পর থেকে যাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাদের রক্ত স্পষ্টতই খালেদা জিয়ার হাতে লেগে আছে। আমরা বিশেষত এ ব্যাপারে তাঁর দোষ ধরতে পারি যে নিরীহ পথচারীদের মৃত্যুতে তিনি কখনো নিন্দা জ্ঞাপন করেননি, বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনায়, যারা কোনোভাবেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। এতগুলো মৃত্যুর ঘটনায় তিনি কখনো সামান্য সহানুভূতি বা সমবেদনা জানাননি।
যাই হোক, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি বলতে পারবেন এসব ঘটনার জন্য তাঁর কোনো দায়দায়িত্ব নেই? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি মীমাংসিত প্রশ্ন নতুন করে তাঁর তুলে ধরাটাই কি বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মূল কারণ নয়? তিনি কি সর্বান্তকরণে বলতে পারবেন, বিরোধী দলকে আলোচনায় আনতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছেন? একটি সমাধানের লক্ষ্যে সরকার ও শাসক দলের পক্ষ থেকে যে যথেষ্ট নমনীয়তা দেখানো হয়েছে, খতিয়ে দেখতে গেলে এই দাবি কি টিকবে? প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপক সাফল্যের সব দাবি যদি আমরা মেনেও নিই, তিনি যে বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় (অনেকে বলেন এ মনোবৃত্তি তাঁর কখনো ছিল না) পৌঁছাতে এবং স্বাধীনতার উত্সব বলে পরিচিত নির্বাচনমুখী শান্তির পথ এনে দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ, এর প্রমাণ রয়েছে।
আবারও বলছি, এ বছর ৪৮ দিনের হরতালে মারা গেছে ২৯০ জন। এর মধ্যে শুধু অক্টোবর-নভেম্বরেই মারা যান ৩৪ জন। এ ছাড়া দুই শিশু নিহত ও ১৯ জন আহত হয়।
কারা এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী?
আমরা এখানে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, রাজনৈতিক কারণেই এ সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। এটি জনসমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা। বিরোধী দল গণআন্দোলনের পথে যাওয়ার বদলে সহিংসতা ও হত্যার পথ বেছে নিয়েছে। শুরু তারা গণআন্দোলন গড়ার চেষ্টা করছে বলে মনে হয়েছে। রাজপথে কোনো গণসমাবেশ নেই, নেতা-কর্মীরা মাঠে নেই, আছে কেবল সন্ত্রাসীরা, যাদের কাজই হলো মানুষের শরীরে ও সম্পত্তিতে আগুন লাগানো।
মানুষের হূদয় ও মনকে জয় করার কোনো চেষ্টা চলছে না, চলছে কেবল মানুষকে সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা। তারা ৪৮ ঘণ্টার ‘অবরোধ’ কর্মসূচির সময় যেভাবে বাড়াল, এতে জনগণকে নিয়ে না ভাবার বিষয়টি বরং জোরালো হয়ে ওঠে। ‘অবরোধের’ চরিত্র হরতালের মতো হওয়ার কথা নয়। শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার মতো শহুরে নাগরিকদের বিচরণের কিছু বিষয় এ ধরনের আন্দোলনের আওতামুক্ত থাকার কথা। তবে শহরের ভেতরে চলাফেলা করলেই বেপয়োরা হামলার শিকার হয়েছে মানুষ। যেসব বিদ্যালয় খোলা রাখ চেষ্টা চলেছে, তাদের প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনায় মৃত্যুর জন্য যদি বিরোধীদলকে দায়ী করা হয়, তবে একইভাবে এর দায়ভার সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ওপরও বর্তায়। এ পরিস্থিতির সমাধানে ক্ষমতাসীন দল সত্যিকার অর্থে কখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সংলাপের জন্য জনগণের যে দাবি, তা পূরণে বিরোধীদলের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো সত্যিকার পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সংলাপের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও একের পর এক অবমাননাকর মন্তব্য সমঝোতার সম্ভাবনাকে নস্যাত্ করে দিয়েছে। বিরোধী দলের নেতাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার, জামিন নামঞ্জুর ও রিমান্ডে পাঠানোর মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়, ক্ষমতাসীন দল সফল কোনো সংলাপ চায় না, বরং পরোক্ষভাবে সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে।
সহিংসতা ও মৃত্যুর জন্য আমরা বিরোধী দলকে এককভাবে দায়ী করার পাশাপাশি সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকেও দায়ী করব। কারণ তারা সমাধানের বদলে আমাদের রাজনীতিকে আরও সংঘাতের পথে ঠেলে দিচ্ছে। এ লেখাটি যখন লিখছিলাম তখন খবর পেলাম, গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর শিশুপার্কের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে চারজন নারীসহ ১৯ যাত্রী দগ্ধ হন। গান পাউডার দিয়েই হোক আর পেট্রোল বোমা মেরেই হোক, হামলাটি যেভাবে চালানো হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। অবরোধের চরিত্র কী হবে—এ বিষয়ে বিরোধী দল সচেতনভাবে অস্পষ্টতা জিইয়ে রেখেছে। এটি কখনো হরতালের মতো হবে না।
আমরা এ রাজনীতির নিন্দা জানাই এবং এর প্রতি তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা ও চরম বিরক্তি প্রকাশ করছি। আমরা রাজনীতির নামে সহিসংতা ও মৃত্যুর এ উন্মত্ততার অবসান চাই। এই অনৈতিক, কুরুচিপূর্ণ, নৃশংস, স্বার্থান্বেষী ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির প্রতি আমাদের ধৈর্য এখন শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে এবং আমরা এর মূলনীতির প্রতি চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। এটা গণতন্ত্র হতে পারে না।
মাহফুজ আনাম, সম্পাদক, ডেইলি স্টার
No comments