‘ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়’ by সিরাজুর রহমান

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে যাত্রা ধরনের এক রকম নাটক গ্রিসে খুবই জনপ্রিয় হয়। এশিলাস, সোফোক্লিস আর ইরিপাইডিস নাট্যকারদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ছিলেন।
এ নাটকগুলো সাধারণভাবেই গ্রিক ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত। নাটকগুলো উপকথা-ভিত্তিক হলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। গ্রিক ট্র্যাজেডির একটা বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে ট্র্যাজেডিগুলো যে ঘটবে, আগে থাকতেই সে সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। কিন্তু ট্র্যাজেডিগুলো ঘটা প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা কেউ করেননি।

ঠিক যেন বর্তমান বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আজ সর্বনাশের গভীর খাদের একেবারে কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েছে বলা ভুল হবে। খাদে পড়ে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু এ সর্বনাশ যারা ঠেকাতে পারতেন তারা পায়ের ওপর পা তুলে দিব্যি আয়েশে নিশ্চেষ্ট বসে আছেন। ইতিহাসে আছে, রোম যখন পুড়ছিল সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। আসলে তিনি ‘লুট’ (দোতারা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে এবং গান করে নিজের সঙ্গীত প্রতিভা জাহির করতে চেয়েছিলেন।
দেশের জনসমর্থন সরকারের পক্ষে নেই। দেশের এবং বিদেশের বিভিন্ন মিডিয়ার জরিপ অনুযায়ী ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ বর্তমান সরকার এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করে না। তারা তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে না হলেও নিদেন একটা নির্দলীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্বাচন চায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গোঁ ধরে বসে আছেন। তার অধীনে এবং তার খেয়াল-খুশি অনুযায়ী তিনি নির্বাচন করবেনই করবেন, কেননা তা না হলে তিনি পাকাপোক্তভাবে গদি ও গণভবন দখল করে রাখতে পারবেন না। অন্যদিকে দেশ-বিদেশের সবাই এখন বুঝে গেছে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট কিছুতেই এই প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচন হতে দেবে না। তারা জানে এ ব্যাপারে দেশের মানুষ পুরোপুরি তাদের সঙ্গে আছে।
মার্কিন সরকার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, চীন, এমনকি জাতিসংঘও বার বার বলেছে, নির্বাচন করার আগে সরকারের উচিত বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের ভিত্তিতে সবার গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সামনা-সামনি তাদের ‘হ্যাঁ’ বলেছেন, কিন্তু পেছনে হাত দিয়ে দলের সমর্থকদের ইশারায় বলেছেন ‘না’। এবং বিদেশিরা সামনে থেকে সরে গেলেই তিনি বিরোধীদের টেনিস খেলার টেকনিকে ‘রং-ফুট’ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। বনানীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আদৌ কোনো বৈঠক হয়েছে কি না জানি না, কিন্তু স্পষ্টতসই সরকারি অনুপ্রেরণায় জোর প্রচারণা হয়েছে যে বৈঠক অবশ্যই হয়েছে এবং ‘মেঘের কোলে রোদ’ অবশ্যই হেসেছে। বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষ মনে মনে খুবই আশাবাদী হয়েছিল।
এদিকে শেখ হাসিনা তার মহাজোটের ভেতরেই ঘুঁটি চালাচালি করে নতুন কয়েকজন মন্ত্রী এবং ১১ জন উপদেষ্টা নিয়োগ করে ঘোষণা দিলেন যে, তিনি একটা ‘সর্বদলীয়’ নির্বাচনী মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। বাংলাদেশের সবচাইতে কম শিক্ষিত মানুষটিও আপনাকে বলে দেবেন, তার নিজের জোটের তিন দল থেকে কয়েকজনকে মন্ত্রী নিয়োগ করলে সেটাকে সর্বদলীয় বলা যায় না। খালেদা জিয়া তার ১৮ দলের জোটের প্রতিনিধিদের নিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের কাছে আপিল করতে গেলেন। তাদের দাবি ছিল নির্বাচনী পদ্ধতি সম্বন্ধে সংলাপ এবং সমঝোতা হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা বিলম্বিত করার জন্য প্রেসিডেন্ট যেন ইলেকশন কমিশনকে নির্দেশ দেন। জনাব আবদুল হামিদ তাদের হতাশ করলেন, প্রমাণ করলেন যে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার চাইতে তিনি আওয়ামী লীগ দলীয় প্রেসিডেন্ট হওয়াই বেশি পছন্দ করেন।

মারাত্মক নির্বাচনী তফসিল
ভেতরে ভেতরে তিনি শেখ হাসিনাকে নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনুমোদন দেন এবং তার পরপরই সরকারের ক্রীড়নক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ গত সোমবার রাত সাড়ে সাতটায় বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারে ভাষণ দিয়ে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেন। এরপর যা হয়েছে তা থেকে বিরোধী দল ও জোট সম্বন্ধে একটা সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায়। সিইসির ভাষণের পরপরই জোট ও বিএনপির নেতা খালেদা জিয়া নেতাদের একটা বৈঠক ডাকেন। আরও পরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের মারফত ঘোষণা দেন যে মঙ্গল ও বুধবার বিএনপি ও ১৮ দলের জোট দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি পালন করবে।
লক্ষণীয় যে, মাত্র দিনদুয়েক আগেও খালেদা জিয়া এবং অন্য নেতারা পরিষ্কার বলেছিলেন, সংলাপ ও সমঝোতা ছাড়া নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হলে তারা লাগাতার হরতাল এবং সড়ক, রেল ও নদী পরিবহন অবরোধ করবেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এবার আর ভুল করেনি। তারা নেতাদের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা না করে তফসিল ঘোষণার পরপরই, অর্থাত্ সোমবার রাত আটটা থেকেই অবরোধসহ সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি শুরু করে। এ সংক্রান্ত সর্বোচ্চ তিতন ব্যক্তি, অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও সিইসির অন্যায্য এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের প্রতিকারের দায়িত্ব বিরোধী দলের নেতাদের ওপর সম্পূর্ণ ছেড়ে না দিয়ে নিজেদের হাতেই তুলে নিয়েছে জনতা। আমার মনে হয় এ ব্যাপারটি থেকে বিএনপির কোনো কোনো নেতা শিক্ষা নিতে পারলে উপকৃত হবেন। তাদের বুঝতে হবে, নেতা হতে হলে জনতার সামনে থাকতে হবে, পেছনে থেকে নেতা হওয়া যায় না।

যে শিক্ষা সরকারকে জরুরিভাবে নিতে হবে
বাংলাদেশের সর্বত্র হরতাল ও অবরোধ চলছে। দেশের অবশিষ্ট অংশের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যানবাহন ভাংচুর এবং সম্পত্তি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের ক্যাডার এবং দলীয়কৃত পুলিশ ও র্যাব মানুষ খুন করছে, জখম করছে, রক্ত ঝরাচ্ছে। ভুয়া অভিযোগে পুলিশ যাকে পাচ্ছে তাকেই গ্রেফতার করছে।
সরকারকেও বড় একটা শিক্ষা নিতে হবে সোমবার রাতের ঘটনাগুলো থেকে। তারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেককে গ্রেফতার করে রেখেছে, গ্রেফতারের ভয়ে অন্যরা পলাতক আছে। সরকার ভেবেছিল বিএনপির নেতৃত্বকে দুর্বল করে ফেলা হলেই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ভেস্তে যাবে। এখন তাদের বুঝে নেয়া উচিত যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে, অন্তত নির্দলীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্বাচন সত্যিকারের একটা গণদাবি, শুধু খালেদা জিয়ারই নয়।
সরকারের গলাবাজ প্রচারবিদরা বিদেশিদের চোখে ধুলো দেয়ার কোনো চেষ্টারই ত্রুটি রাখবে না। কিন্তু সেটা অরণ্যে রোদনেরই শামিল হবে। বিদেশিদের চোখ হাসিনার গুপ্তচরদের চাইতেও বেশি তীক্ষষ্ট। মাত্র চার দিন আগে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট একটা সর্বসম্মত প্রস্তাবে সংলাপের ভিত্তিতে সবার গ্রহণযোগ্য একটা স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার দাবি জানিয়েছে। তার দু’দিন আগে (২০ নভেম্বর) মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র কমিটিও এক আলোচনা সভায় একই দাবি জানিয়েছে। এ কমিটির চেয়ারম্যান কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাভোট কিছুদিন আগেই স্বচক্ষে বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে গেছেন।
একই তারিখে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটের জন্য শেখ হাসিনাকেই দায়ী করেছে। পত্রিকাটি ২০১১ সালে সংবিধান পরিবর্তন, মানবাধিকারের চূড়ান্ত অবমাননা, তথাকথিত আন্তর্জাতিক আদালতে রাজনৈতিক বিচার এবং বিরোধী দলগুলোকে বাদ দিয়েই নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য শেখ হাসিনার গদি-লিপ্সাকেই দায়ী করেছে। তাত্পর্যপূর্ণভাবে পত্রিকাটি বাংরাদেশের বিরুদ্ধে অবরোধের সম্ভাবনারও ইঙ্গিত দিয়েছে। তাত্পর্যপূর্ণভাবেই চীনও ‘স্বাধীন ও সমৃদ্ধ’ বাংলাদেশ দেখতে চায় বলে জানিয়েছে।

বাংলাদেশ কি উত্তর কোরিয়া হয়ে যাবে?
বিগত প্রায় পাঁচ বছরে সরকার বিদেশি দাতা ও বন্ধুদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করেছে তাতে বাংলাদেশ বিশ্ব সমাজে উত্তর কোরিয়ার মতোই একঘরে ও অচ্ছুত হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। প্রথমেই বিচার-বহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকারের অবমাননার নিন্দায় বিশ্ব সমাজ সোচ্চার হয়েছে। শেখ হাসিনা তার স্বভাব-সুলভ গোঁয়ার্তুমি দিয়ে কারও পরামর্শই শোনেননি। ইলিয়াস আলীর মুক্তির দাবি জানিয়েছে ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে তার এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে বিশ্ব সমাজ, বিশেষ করে মার্কিন প্রশাসন ও নেতাদের তিনি রীতিমত অপমান করেছেন। পদ্মা সেতু দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারে বাধা দিয়ে ঋণদাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর ক্রোধের উদ্রেক করা হয়েছে। এখন আবার রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য সংলাপের ব্যাপারে তিনি ভারত ছাড়া গোটা বিশ্বের উপদেশ ও পরামর্শকে উপেক্ষা করে তাদের প্রতি অসৌজন্য দেখিয়েছেন।
বিশ্বায়নের যুগে কোনো দেশই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারে না। একমাত্র চীন ছাড়া আর কোনো দেশের সঙ্গেই উত্তর কোরিয়ার সদ্ভাব কিংবা কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। চীনও এখন উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে অস্বস্তি দেখাচ্ছে। বাংলাদেশেরও হয়েছে সেই দশা। ভারত ছাড়া আর কোনো দেশ ঢাকার সরকারের ওপর প্রীত নয়। বাংলাদেশ বিদেশি ঋণের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিচার না হলে বিশ্বব্যাংক সেতুর অর্থায়ন করতে অস্বীকার করেছে। ক্রমে ক্রমে অন্যান্য দেশ থেকেও ঋণ সম্পূর্ণ থেমে না গেলেও কমে আসবে। সেই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগও।
সরকারের ভ্রান্ত নীতি, বিশেষ করে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত অবিমৃশ্যকারিতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। বিদেশি রেমিট্যান্স হু-হু করে পড়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি বাণিজ্যিক সুবিধা দিতে অস্বীকার করছে বাংলাদেশকে। এদিকে দেশের ভেতরের সম্পদও লুটপাট হয়ে মালয়েশিয়া, দুবাই এবং লন্ডনে সম্পত্তিতে লগ্নি হয়ে গেছে। বর্তমান দুর্বৃত্ত সরকারকে গদিচ্যুত করা না হলে দেশ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। কিন্তু তাতে শেখ হাসিনার কী এসে যায়? তিনি দেশটাকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার পরিকল্পনা করেছেন বলেই মনে হয়।
সিরাজুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.