অরণ্যে রোদন- মায়ের রক্ত তোমার হাতে by আনিসুল হক

‘প্রিয় আনিসুল হক স্যার, খবরে শুনলাম, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার পদত্যাগপত্র বাতিল করেছেন, সমন্বিত পরীক্ষা পুনর্বহাল করা হয়েছে। খবরে আরও শুনলাম, বৃহস্পতিবার অবরোধ বাড়ানো হয়েছে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। শুক্রবার সকাল ১০টায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা।
আমার আপু মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাননি। আমার বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন হেডমাস্টার। তাঁর সাধ্য নেই মেয়েকে বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর। সাধারণত মেডিকেলের প্রশ্ন আর অ্যাগ্রিকালচারের প্রশ্নের ধরন এক রকম হয়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার শখ আপুর সেই ৬ অক্টোবর থেকে, যেদিন মেডিকেলের রেজাল্টে আপুকে হার মানতে হলো। কিন্তু স্যার, যদি সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অবরোধ হয়, তাহলে উত্তরাঞ্চলের পরীক্ষার্থীরা কীভাবে ঢাকায় সকাল ১০টার পরীক্ষায় অংশ নেবেন? জানি, চান্স পাওয়া অনেক কঠিন, কিন্তু আমার আপুর কি পরীক্ষাটাই দেওয়া হবে না? ইতি, ক্লাস এইটে পড়ুয়া একজন ছোট ভাই।’

আমার ফেসবুক পাতায় এই চিঠিটা এসেছিল গত বুধবার। এটা আমি ফেসবুকে প্রকাশও করেছিলাম। আর এদিকে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শুক্রবারের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করেছে। সেই খবরটাও জানলাম ফেসবুকেই নিচের বার্তাটার মাধ্যমে:
‘ব্রেকিং নিউজ
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত।
স্যার, এভাবে আর কত? এভাবে পেছাতে পেছাতে তো দেশটা পিছিয়ে যাচ্ছে। ইবি ভর্তি পরীক্ষা তো তিনবার পেছাল। চবির ভর্তি পরীক্ষা হতে হতে স্থগিত আছে। এভাবে পেছালে যাঁরা পরীক্ষা দিচ্ছেন, তাঁদের পরীক্ষা দেওয়ার মানসিকতা থাকে?
আসলেই উদ্ভট এক উটের পিঠে চলছে স্বদেশ।’
যেহেতু আগের বার্তাটা প্রকাশ করেছিলাম, ফলে পরীক্ষা স্থগিতের খবরসমেত এই বার্তাটাও প্রকাশ করাটা জরুরি হয়ে পড়ল। প্রকাশ করলাম।
এর আগে এই বার্তা পেয়েছিলাম:
‘অনেকে, যাঁরা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবেন না, তাঁরা হয়তো ভবিষ্যৎ সাফল্যের চাবি-ই পাবেন না; কিন্তু আমরা যারা চাবি পেয়েছি, তারা তো চাবি পেয়েও তালা খুলতে পারছি না। আমাদের PGCB-এর Asst. Manager (Elec/Mech) post-এ পরীক্ষা ২৩ নভেম্বর সকাল ১০টা (বুয়েট), কিন্তু শুক্রবার ভোর পাঁচটা পর্যন্ত অবরোধ। যাঁরা ঢাকার বাইরে থেকে আসবেন পরীক্ষা দিতে, তাঁরা তো দিতে পারবেন না। কী হবে এই দুই নেত্রীর নোংরা রাজনীতি করে?
এ রকম অনেক অনেক চিঠি এসে আমার ফেসবুকের ইনবক্স ভরে গেছে।

দুই
এই বার্তাগুলো থেকে আমরা কী বার্তা পাচ্ছি? রাজনীতি নাকি মানুষের কল্যাণের জন্য? রাজনীতি নাকি দেশের ভালোর জন্য? একটা দিন হরতাল হলে, ধর্মঘট হলে, অবরোধ হলে মানুষকে কত রকমের দুঃখ-কষ্ট-হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়; এই চিঠিগুলো তার সামান্যই উদাহরণ। এসব বার্তা নিশ্চয়ই ক্ষমতান্ধ, ক্ষমতাবধির, ক্ষমতাপাষাণ আমাদের নেত্রীদের কাছে পৌঁছাবেও না, তাঁদের মনে সামান্য বিচলনও সৃষ্টি করতে পারবে না। মানুষ মারা যাচ্ছে, মানুষ পুড়ে যাচ্ছে—সেসব খবরেই যাঁরা বিচলিত হন না, কার ভর্তি পরীক্ষা হলো কি হলো না, তাতে তাঁদের কী এসে যায়? তাঁদের দরকার ক্ষমতা। কী অপরাধ করেছিলেন ব্যাংক কর্মচারীদের জন্য রান্নার কাজ করা আনোয়ারা? কেন তাঁর মাথা বরাবর বোমা ছুড়ে মারা হলো? কী অপরাধ করেছিলেন সিএনজিচালিত ট্যাক্সিচালকেরা? বর্বরতার কোন স্তরে আমরা নেমে গেছি যে আমরা যাত্রীবোঝাই বাসে, চালক বা যাত্রীসমেত ট্যাক্সিতে পেট্রল ঢেলে আগুন দিচ্ছি, গান পাউডার ছুড়ে আগুন দিচ্ছি? কেন নির্বিচারে ককটেল ছুড়ে মারছি? এগুলোকে বলে রাজনৈতিক কর্মসূচি? এটা কি পোড়ামাটি নীতি যে আমি এই দেশের মানুষ চাই না, গাছপালা চাই না, শুধু পোড়ামাটি থাকলেই চলবে?
আর অবরোধ ও হরতালের মধ্যে পার্থক্য কী? প্রথম আলোয় বিএনপির নেতাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, অবরোধ হলো সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করা, কিন্তু দোকানপাট স্কুল-কলেজ খোলা থাকতে পারে। যানবাহন বন্ধ থাকলে স্কুল খোলা থাকবে কী করে?
শুধু যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি পরীক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তা নয়, জুনিয়র ও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার অর্ধকোটি শিশুকে আর তাদের পরিবারগুলোকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে চরম উৎকণ্ঠা ও হয়রানির অন্ধকূপে। আর সব ক্লাসের শিক্ষার্থীদেরই বার্ষিক পরীক্ষার সময় এটা। রোম পুড়ছে, তাঁরা বাঁশি বাজাচ্ছেন?
অবরোধ মানে এত দিন জানতাম রেলপথে, রাজপথে মানুষের সমাবেশ। আওয়ামী লীগ যখন অবরোধ ডেকেছিল, তখন ঢাকার কোন কোন পয়েন্টে কোন নেতা থাকবেন, তা আগের দিনেই প্রকাশ করে সেসব জায়গায় কর্মীদের সমবেত হতে বলা হয়েছিল—সেটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। পত্রিকান্তরে পড়লাম, বেগম জিয়া নাকি বিএনপির নেতাদের বিভিন্ন পয়েন্টের দায়িত্ব দিয়েওছিলেন, কিন্তু কেউ তাঁর আদেশও মানেননি। অবরোধ ডাকা হবে, আর রাজপথে নেতা-কর্মীরা থাকবেন না; রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হবে ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের, যারা ব্যাগে করে ককটেল নিয়ে বা পেট্রলবোমা নিয়ে বা গান পাউডার নিয়ে অতর্কিতে হামলা করবে কোনো যানবাহনের ওপরে, গোপনে কোনো রেলপথের ফিশপ্লেট খুলে রাখবে, স্লিপার উপড়ে রাখবে—এটা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন হতেই পারে না। এটা একেবারেই সন্ত্রাসবাদী কৌশল। বিএনপির মতো একটা গণসংগঠনের পক্ষে এ কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
আমার বলতে দ্বিধা নেই যে আজকের সংকটের মূলে এই সরকার। উচ্চ আদালতের নির্দেশে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। দেশে-বিদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল গ্রহণযোগ্য একটা বিষয়। এই সরকারের অনেক ভালো কাজ থাকা সত্ত্বেও সরকার যে জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল, তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো, এই ব্যবস্থা তুলে দেওয়া। কারণ, তাতে প্রত্যেক ভোটারের মর্যাদাকে আঘাত করা হয়েছে। সংকট সৃষ্টি করে সেটা সমাধানের জন্য সরকার সংলাপ ও সমঝোতার চেয়ে পুলিশি পদক্ষেপকে শ্রেয়তর বিকল্প হিসেবে নিয়েছে। নির্মমভাবে বিরোধী কর্মসূচিকে দমন করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। বিরোধীদের বিক্ষোভ কর্মসূচি তাই জনসমাবেশভিত্তিক না হয়ে ককটেল-বোমা-আগুনভিত্তিক হওয়ার পেছনে সেটা একটা বড় কারণ। কিন্তু সরকারের সৃষ্টি করা এই পিছল ফাঁদে কেন বিরোধী দল পা দিল, সেটাও একটা প্রশ্ন। যেকোনো দাবি, তা যত মহৎই হোক না কেন, জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া তা অর্জন করা যায় না।
১৯৫২ সালের ছোট্ট শহর ঢাকার মিছিলে ৩০ হাজার লোক হয়েছিল। স্কুলের ছাত্রীরা পর্যন্ত মিছিলে অংশ নিত। ১৯৬৯ সালে সারা দেশের প্রতিটি রাজপথে লাখ লাখ মানুষ বেরিয়ে এসেছিল। ১৯৭১ সালের মার্চে রাস্তায় থাকত শুধু মানুষ আর মানুষ। ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনে জরুরি অবস্থা কারফিউ ভেঙে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল বলেই এরশাদ সরকারের পতন ঘটেছিল। এমনকি ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে জনতার মঞ্চে যোগ দিতে মতিঝিল অফিসপাড়া থেকে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। বিএনপির আন্দোলনে মানুষ কই?
আর দুই দলের দুই জোটের নেতাদের কাছে প্রশ্ন, আপনাদের কাছে কোনটা বড়—দেশ, নাকি ক্ষমতা? মানুষের জীবনের কি কোনোই মূল্য নেই আপনাদের কাছে?
এখনো সময় আছে, একপক্ষীয় নির্বাচন থেকে সরে আসুন। সরকারপক্ষ কিছু ছাড় দিক, যাতে বিএনপির একটা সম্মানজনক পথ থাকে নির্বাচনে আসার। বিএনপির পক্ষ থেকেও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই এগিয়ে আসা উচিত।
দ্বিতীয় কথাটা আজকের দিনে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর আগে একটা লেখা লিখেছিলেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে। এই দেশে মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য একটা অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা হয়, তার মাধ্যমেই বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ছেলেমেয়েরা ভর্তি হতে পারে। কিন্তু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা হয় আলাদা। শুধু যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা আলাদা হয়, তা নয়, অনেক সময় বিভাগগুলোর পরীক্ষাও হয় আলাদা। আগে যখন বিআইটি ছিল, তখন দেশের বিভিন্ন আইটির পরীক্ষা একসঙ্গে হতো, এখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটির আলাদা পরীক্ষা হয়, একটায় তো আবার বিভাগে বিভাগে আলাদা পরীক্ষা হয়। এর অন্যতম কারণ পরীক্ষার ফি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় হয়, শিক্ষক-কর্মচারীরাও কিছু টাকা পান। ছাত্রছাত্রীদের ভোগান্তিটা হয় চরম। তাঁরা এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটছেন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। টাকা নষ্ট হচ্ছে, সময় নষ্ট হচ্ছে; কখনো একই দিনে দুই প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা। তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোনটা ছাড়বেন, কোনটা ধরবেন। এই চরম অমানবিক ভোগান্তি থেকে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে সমন্বিত পরীক্ষার আয়োজন করা কি যায় না? ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল সেই চেষ্টা করছেন। সফল হতে পারেননি। শুধু দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রাজি হয়েছিল, সেটা নিয়েও বাধা। ড. ইয়াসমীন হক ও মুহম্মদ জাফর ইকবালকে তাই পদত্যাগ করতে হয়েছিল। যা-ই হোক, এটা ভালো যে তাঁরা পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেছেন।
আমি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের এই উদ্যোগের প্রতি দুই হাত তুলে পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। স্বপ্ন দেখছি, একদিন মেডিকেল কলেজগুলোর মতো অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানই একটি অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে।
তবে তারও আগে, এই রাজনৈতিক হানাহানি বন্ধ করে একটা সমঝোতায় আসার জন্য নেতাদের আকুল আবেদন জানাই। মনে রাখবেন, একটা মানুষের প্রাণ অনেক মূল্যবান, যা আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না, তা কেড়ে নেওয়ার অধিকার আমাদের কারোরই নেই। অবরোধের বোমায় মৃত আনোয়ারা বেগমের মেয়ে নাসিমা বিলাপ করে বলেছেন, কোনো বড় রাজনীতিবিদ তো হরতালে প্রাণ হারান না। আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য তাঁরাই দায়ী। আমার মায়ের রক্ত তাঁদের হাতে। আরব দেশের সব সুগন্ধি কি পারবে রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রক্তের এই গন্ধ দূর করতে?
আনিসুল হক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.