খোলা চোখে- সত্য-মিথ্যা ও রাজনীতির ঘোলা জল by হাসান ফেরদৌস
গল্পটা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে নিয়ে;
তবে এর সত্য-মিথ্যা আমার পক্ষে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। একবার এক নির্বাচনী
জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় একটা বই হাতে নিয়ে হক সাহেব বললেন, ‘আমি পবিত্র
কোরআন হাতে নিয়ে বলছি, নির্বাচিত হলে আপনাদের প্রত্যেকের বকেয়া কৃষিঋণ
মাফ করে দেব।’
ভাষণ শেষ হলে তাঁর এক সহকারী সবিস্ময়ে
প্রশ্ন করলেন, ‘স্যার, একেবারে কোরআন শরিফ হাতে নিয়ে এমন একটা ওয়াদা করে
ফেললেন!’ হক সাহেব মুচকি হেসে বললেন, ‘কোরআন শরিফ কে বলল, আমি তো রুমাল
দিয়ে প্যাঁচানো এক টুকরো কাঠ সবাইকে দেখালাম।’
জর্জ অরওয়েল একসময় মন্তব্য করেছিলেন, রাজনীতিকদের ভাষা আমাদের নিত্যদিনের ভাষা থেকে ভিন্ন। তাঁদের কাজই হলো মিথ্যাকে সত্য বানানো, দরকার হলে দিনে-দুপুরে খুনকেও ‘সম্মানজনক’ কাজ বলে প্রমাণ করে ছাড়া। এমনকি একদম শুদ্ধ বাতাসকেও তাঁরা ভারী ওজনের জিনিস বানাতে পারেন।
হক সাহেব ও জর্জ অরওয়েল উভয়কেই মনে পড়ল বাংলাদেশের বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে ‘আইসিএনএনের একটি প্রতিবেদন নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের জল ঘোলা করার চেষ্টা দেখে। সপ্তাহ দুয়েক আগে আইসিএনএনের ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ২০০৯ সালে বিডিআরের সদর দপ্তরে যে রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়, তার পেছনে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআইয়ের হাত রয়েছে। বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় রাজনীতিক সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মাধ্যমে গোয়েন্দা দপ্তরটি ৪০ কোটি টাকা বিতরণ করে। মূল লক্ষ্য ছিল, এই টাকা ব্যবহার করে বিডিআরের সদস্যদের মধ্যে সদ্য নির্বাচিত হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উসকে দেওয়া এবং সেই সরকারের পতন ঘটানো।
অন্য আলোচনায় যাওয়ার আগে আইসিএনএন জিনিসটা কী, তা বোঝা দরকার। আইসিএনএন আমেরিকান স্যাটেলাইট টেলিভিশন স্টেশন ‘কেবল নিউজ নেটওয়ার্ক’ (সিএনএন)-এর নিজস্ব ওয়েবসাইটের অন্তর্ভুক্ত হলেও এতে প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদন সিএনএনের নিজস্ব প্রতিনিধিদের পাঠানো নয়। দেশে-বিদেশে যে কেউ তালিকাভুক্তির পর সাম্প্রতিক কোনো বিষয়ে নিজস্ব সূত্র ব্যবহার করে প্রতিবেদন পাঠাতে পারেন। প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর জন্য সিএনএন দায়ী নয়। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব প্রতিবেদন সিএনএন সম্পাদনা বা তথ্যশুদ্ধিরও প্রয়োজন দেখে না। কোনো প্রতিবেদন অসত্য বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিবেচিত হলে এবং পাঠকমহল সিএনএনকে সে ব্যাপারে সতর্ক করে দিলে সেসব প্রতিবেদন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে আইসিএনএনের প্রতিবেদনটি সে রকমই একটি প্রতিবেদন। খবরটি সত্য নয়, সে কথা জানা মাত্রই সিএনএন প্রতিবেদনটি তার ওয়েবসাইট থেকে প্রত্যাহার করে নেয়।
খবরটি যে সত্য নয়, অথবা সিএনএন নিজে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি, এ কথা সরকারি নেতা-নেত্রীদের না জানার কথা নয়। তবু তর্কের খাতিরে ধরা যাক, সিএনএন ও আইসিএনএনের মধ্যে যে তফাত আছে, সে কথা আমাদের রাজনৈতিক নেতারা জানেন না। কিন্তু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর বিষয় জানা মাত্রই সরকারের নিরাপত্তাব্যবস্থা সজাগ হবে এবং তা নিয়ে তদন্ত করবে, সেটাই স্বাভাবিক। সরকারপ্রধান এ নিয়ে তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলবেন, এই প্রতিবেদনের কোনো একটি বিষয়ে যদি কণামাত্র সত্যতা থাকে, তা তন্নতন্ন করে খুঁজে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, এমন আশা দেশের মানুষ করতেই পারে। এমন একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল, তা জেনেও যদি দেশের সরকার বা তার গোয়েন্দা-নিরাপত্তা বিভাগ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাতে শুধু তাদের দায়িত্বহীনতা নয়, অযোগ্যতাও ধরা পড়ে। ঘটনা ঘটেছে চার বছর আগে। আইসিএনএন না জানানো পর্যন্ত সে খবর দেশের গোয়েন্দা বিভাগ কেন জানল না, বা জেনে থাকলেও তা সরকারপ্রধানের গোচরে আনল না, এমন প্রশ্ন তোলাও অযৌক্তিক নয়। এমন অভিযোগে দু-চারজনের চাকরি যাবে, সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু এসবের কোনো কিছুই হয়নি। সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা, প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় বিডিআর বিদ্রোহের ওপর দীর্ঘ তদন্ত ও পর্যালোচনার পর আদালতের রায় প্রকাশের অব্যবহিত পরে। রায়ে বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দা দপ্তরের কোনো সংযোগ আছে, অথবা উল্লেখিত বিরোধী রাজনীতিকটি জড়িত, সে কথার কোনো উল্লেখ নেই। তারপর দেশের সরকারপ্রধান জনসভায় প্রতিবেদনটির সূত্র উল্লেখ করে অপ্রমাণিত অভিযোগগুলো উপস্থিত করলেন। আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন উপমন্ত্রী আলাদাভাবে সাংবাদ সম্মেলন করে সেই একই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করলেন। দেশের প্রতিটি পত্রিকায় সে খবর কমবেশি ফলাও করে ছাপাও হলো।
প্রতিবেদনটি যে সত্য নয়, সে কথা সরকার না-ও জানতে পারে। এতে তাদের অদক্ষতা প্রমাণিত হয়, কিন্তু মিথ্যাচারের জন্য তাদের অভিযুক্ত করা যায় না। কিন্তু খবরটি সত্য নয়, সে কথা সিএনএন নিজেই জানিয়েছে। তার পরও সরকারের কোনো পর্যায়ের কেউই তাঁদের উত্থাপিত অভিযোগ প্রত্যাহার করেননি, অথবা এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশও করেননি। কিছু পত্রিকা অবশ্য সিএনএনকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, খবরটি ভিত্তিহীন। কিন্তু যে গুরুত্বের সঙ্গে প্রথম খবরটি ছাপা হয়েছিল, ঠিক সেই একই রকম গুরুত্বের সঙ্গে খবরের ভিত্তিহীনতার প্রসঙ্গটি স্থান পায়নি। ফলে, যাঁরা প্রথম খবরটি পড়েছেন, কিন্তু পরের ‘রিজয়েন্ডার’ পড়েননি, তাঁরা মনে করবেন খবরটি সঠিক ছিল।
এই লেখা এ পর্যন্ত যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের এবার দয়া করে লেখার শুরুতে হক সাহেবের গল্পটা মনে করতে বলি। রাজনীতিক মাত্রই মিথ্যা বলেন, যেকোনো উপায়ে, যেকোনো মূল্যে নির্বাচিত হওয়াই তাঁর লক্ষ্য। হক সাহেব সম্ভবত সে কাজই করেছিলেন। কোনো কোনো মিথ্যা আছে, প্লেটোর ভাষায়, তাকে ‘মহৎ ও সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে বিবেচনা করা যায়। প্লেটো বিশ্বাস করতেন, যাঁরা দেশ চালাবেন, তাঁরা দেশ চালানোর স্বার্থ দু-চারটা মিথ্যা বলতেই পারেন। মিথ্যা কথা বলে যদি দশের ভালো হয়, তাহলে মিথ্যা বলা কোনো অপরাধ নয়। হক সাহেবের বলা মিথ্যাকে আমরা সেই পর্যায়ভুক্ত করতে পারি। আমরা জানি, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কৃষিঋণ ও বকেয়া খাজনা মওকুফের ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন।
কিন্তু এখানে মিথ্যার যে উদাহরণটি আমাদের বিবেচ্য, তাকে ‘নোব্ল লাই’ বা মহৎ মিথ্যা বলতে আমার দ্বিধা আছে। এ হচ্ছে জেনে-শুনে ডাহা মিথ্যা প্রচার করা, যার একমাত্র উদ্দেশ্য নির্বাচন মাথায় রেখে রাজনৈতিক ফায়দা আদায়। কিন্তু চুরির মতো মিথ্যার সমস্যা হলো, ধরা না পড়লে তার মস্ত ফায়দা রয়েছে, আর ধরা পড়ে গেলে বমাল শ্রীঘর। নিজের অজ্ঞতা বা ভুল স্বীকার করে নিলে অবশ্য অপরাধ বহুলাংশে লাঘব সম্ভব। আমাদের রাজীতিকেরা অবশ্য কখনোই কোনো ব্যাপারে নিজেদের দোষ স্বীকার করেন না। তাঁরা অকাতরে মিথ্যা বলবেন এবং ধরা পড়ে যাওয়ার পরে হয় সেই একই মিথ্যা জপে যাবেন, অথবা কথিত মিথ্যার ব্যাপারে পুরোপুরি ‘স্পিকটি নট’, মুখে কুলপ এঁটে থাকবেন।
এ অবস্থায় দেশের রাজনীতিকদের চোখে আঙুল দিয়ে তাঁদের মিথ্যা কথন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের তথ্যমাধ্যমের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। সরকারি নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য তারা যে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ-প্রচার করে, সেই একই গুরুত্বের সঙ্গে তাঁদের বলা মিথ্যাচার তুলে ধরাও সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বের অন্তর্গত। আমেরিকায় দেখেছি, অধিকাংশ পত্রপত্রিকা ও টিভি নেটওয়ার্ক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর বক্তব্যে কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, তা যাচাইয়ের জন্য ‘ফ্যাক্ট চেক’-এর ব্যবস্থা করে থাকে। যেমন ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় ‘ফ্যাক্ট চেকার’ নামের একটি নিয়মিত কলাম রয়েছে।
পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে, ‘পিনোকিও’ গল্পে মিথ্যা বললেই তার নাকটি লম্বা হয়ে যেত। সেই গল্প মাথায় রেখে ওয়াশিংটন পোস্ট হয় ‘সত্য’, এই চেক মার্ক (হু), অথবা এক থেকে চার ‘পিনোকিও’ দিয়ে থাকে। সামান্য ভুলের জন্য এক পিনোকিও, ডাহা মিথ্যার জন্য চার পিনোকিও।
প্রিয় পাঠক, আইসিএনএনের গাঁজাখুরি গল্প নিয়ে যে কাণ্ড হলো, তার জন্য আপনারা বাংলাদেশের রাজনীতিকদের জন্য কয়টা ‘পিনোকিও’ দেবেন?
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments