জাতীয় নির্বাচন- ওদের গোপনে কথা বলতে দিন by শান্তনু মজুমদার
জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মধ্যে
সমঝোতার আশাবাদের মৃত্যু খোঁজা ঠিক হবে না। বিবদমান দুই পক্ষ কিন্তু
অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও পরস্পরকে ছাড় দিচ্ছে। সরকারপক্ষ প্রধানমন্ত্রী পদ
ছাড়া মন্ত্রিসভার যেকোনো পদ প্রধান বিরোধী দলের জন্য অবারিত করে রাখার কথা
বলছে।
বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মুখ থেকে
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নির্বাচনকালে ছেঁটে দেওয়ার দাবি করা হয়েছে, যা
কিনা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে ফেলার দাবি থেকে অনেকটাই সরে আসা।
দাবি আর দাবি প্রত্যাখ্যানের পর্ব চলছে, চলতেই থাকবে। এসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, মূলধারার দুই দল একান্তে কথা বলছে বলে খবর বেরিয়েছে। এ খবর সত্য হলে তফসিলবিরোধী সহিংসাপর্ব দেখেও প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতার বিষয়ে আশাবাদ রাখা যায়।
মূলধারার প্রধান দুই দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুই নেতার একান্ত আলাপ করতে পারাটা উভয় পক্ষের রাজনৈতিক পরিপক্বতার প্রমাণ দিচ্ছে। আমাদের রাজনীতি চলতি বছরের শুরু থেকে ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর। লোকক্ষয় হচ্ছে, সম্পদহানি হচ্ছে। প্রধান দুই পক্ষ তূণের সবচেয়ে বিষাক্ত শব্দ ও বাক্যের তিরগুলো ছুড়ছে; এগুলো পরস্পরকে বিঁধছে। কথার লড়াই এখন যেন ‘ইজ্জতের সওয়াল’ হয়ে উঠেছে—কথার মধ্যে যুক্তি যা-ই থাকুক বা না থাকুক। জোরসে দাবি জানানো আর জোরসে দাবি হটানোই এখানে কেতা। আর আছে সুশীল সমাজীয় নিন্দা-মন্দ ও পরামর্শ। দিবানিশি। প্রমাণ করার সাংঘাতিক চেষ্টা যে রাজনীতিকেরা কিছু বোঝেন না; কিচ্ছু বোঝেন না। কে কত বুঝি আর বলতে পারি, তা-ই এখন মুখ্য।
নীরবতাও যে কখনো কখনো হিরণ্ময় হতে পারে, তা মনে হয় বিস্মরণে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতির আলোচনায় অনেক দূষণের মধ্যে বাক্দূষণ অন্যতম হয়ে উঠেছে। কত বেশি কথা হচ্ছে! এ অবস্থার দুই দ্বিতীয় প্রধান নেতা যে সেমি-গোপনীয়তার মধ্যে নিজেদের মতো করে কথা বলে নিলেন বলে শোনা যাচ্ছে, সে জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বই ধন্যবাদ পাবেন; আর কেউ নন। এই তো ওঁরা বুর্জোয়া রাজনীতিক হয়ে উঠছেন! সত্যি বলতে কি, জাতীয় জীবনের এই ঘোর দুর্যোগ মুহূর্তে দুই বিবদমান পক্ষের কাছ থেকে আসল কথাবার্তাগুলো খুল্লামখুল্লা করে শুনে নেওয়ার দাবি বা আশা করাটা বাতুলতা।
কেন বাতুলতা? বাতুলতা এই কারণে যে কে কতটুকু ছাড় অন্য পক্ষকে দেবে কিংবা কতটুকু ছাড় মেনে নেবে, তা ডজনকে-ডজনকে টিভি ক্যামেরা, কয়েক ডজন টক শো, সর্বোপরি ১৬ কোটি উৎসুক-উৎকণ্ঠিত জনতার চোখের সামনে দিয়ে করতে চাইলে পুরো ব্যাপারটাই কেঁচে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কারণ, প্রথমত, ‘বিশেষজ্ঞ পরামর্শ’, ‘বিশেষজ্ঞ পরামর্শ’ ও ‘বিশেষজ্ঞ পরামর্শ’ আর সাধারণের প্রত্যাশার ফলে দুই পক্ষের ওপরে অসহ্য চাপ পড়ে। দ্বিতীয়ত, প্রতি পদে রাজনীতিকদের ভুল-ধরাধরির মাধ্যমে স্বীয় মেধা ও প্রতিভা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় সাধারণ জনগণের বিভ্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তৃতীয়ত, এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—দুই পক্ষই অনেক দিন থেকে পরস্পরকে সবচেয়ে বাজে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। এটা কড়া সমর্থকদের মধ্যে মাদকের মতো কাজ করছে। এই কড়া সমর্থকেরা হাটে-মাঠে, নগরে-বন্দরে, কল-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাজে কথাগুলো প্রশ্নহীন উদিগরণ করছেন এবং জনমত নিজদের দিকে টানার কোশেশ করছেন।
এ অবস্থায় প্রধান দুই পক্ষ হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে যদি সমঝোতার পথে আসে, যুক্তিশীলতার পথে আসে, তাহলে তো এঁদের জন্য বিপদ হয়ে যাবে। আর এই কড়া সমর্থকদের বিপদে পড়ে যাওয়া মানে দলের বিপদে পড়ে যাওয়া। কেননা, এই কড়া সমর্থকেরাই তো দলের প্রাণ। প্রগতিশীল ব্যক্তিদের যৌক্তিক সমালোচনা, সুশীল সমাজের ভ্রুকুটি, সাধারণ লোকজনের গালাগাল উপেক্ষা করে এঁরাই না দলের জন্য জানবাজি-মানবাজি করেন। এখন, দল এত দিন যেসব কথা অহেতুক-অযৌক্তিক কথা বলেছে, তা থেকে সরে এসে ভালো ভালো কাজ করতে শুরু করলে এই লোকগুলো যান কোথায়?
পাবলিক কিংবা সুশীল সমাজ কেয়ার করুক বা না করুক, এঁদের কথা মাথায় রাখতে হয় দলকে। একই সঙ্গে মাথায় রাখতে হয় বিপুলসংখ্যক সমর্থকের কথা, যাঁরা দলকে ভোট দেন অনেক সময় আদর্শ-অনুপ্রাণিত হয়ে নয়, জোশের বশে। এ জন্য বড় দলগুলোকে দিয়ে প্রকাশ্যে সবকিছু ঝেড়ে কাশতে বলাটা কোনো কাজের কথা নয়। আর রিয়েল পলিটিকসে সারাক্ষণ উচিত-অনুচিতের কথা বলার মধ্যেও বিশেষ কিছু নেই। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে যে দ্বন্দ্বটি চলছে, তা নিছক নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি-বিষয়ক একটি দ্বন্দ্ব মাত্র নয়; নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থাকে সামনে রেখে কোন পক্ষ কীভাবে একাত্তর সালকে ব্যাখ্যা করছে বা ভবিষ্যতে ব্যাখ্যা করবে, তারও একটা ফয়সালা চলছে এখন। এ অবস্থায় কোনো পক্ষই আসলে এ মুহূর্তে ছাড় দেওয়া বা না-দেওয়ার বিষয়ে চিৎকার করে সব জানান দিয়ে আলাপে এগোনোর অবস্থাতে নেই।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সবকিছু প্রকাশ্যে বলতে যাওয়ার আরেকটি প্র্যাকটিক্যাল সমস্যা আছে। ঔপনিবেশিক শাসক ও সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে ‘মানি না, মানি না’ বলার সংগত অনুশীলনটি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। এখনো ঠিক হোক বা বেঠিক হোক, যেকোনো ইস্যুতেই ‘মানি না, মানি না’ বলতে পারাটাই ‘ম্যানলি’, ‘পৌরুষ’ আর ‘বীরত্বের’ লক্ষণ। জাতীয় মানসে গেঁথে থাকা ‘মানি না, মানি না’ ব্যাপারটা থেকে প্রকাশ্যে, খোলামেলাভাবে বেরিয়ে আসার মাধ্যমে ‘দুর্বল’ ও ‘অপদার্থ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও নিতে চাইবে না কোনো পক্ষ। এসব দিক থেকে দেখলে সর্ব শীর্ষপর্যায়ের নয়, বরং তার পরের পর্যায়গুলোতে ব্যাপক ‘একান্ত আলাপ’ ফলদায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আমাদের মেনে নিতে হবে যে বড় বড় জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে যখন ছাড় দেওয়া ও ছাড় নেওয়ার বিষয় থাকে, তখন সবকিছু প্রকাশ্যে একেবারে সূর্যালোকের নিচে দাঁড়িয়ে করার আশা করাটা শিশুতোষ। ইরানের পরমাণু কর্মসূচিজনিত জটিলতার দিকে তাকাই। গত কয়েক মাসে সিরিজ গোপন আলোচনা হয়েছে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। প্রকাশ্যে উভয় পক্ষ সহযোগিতামূলক, স্পষ্ট-অস্পষ্ট, বিভ্রান্তিকর নানা কথাবার্তা বলেছে। কিন্তু আসলে কী হচ্ছে, ইরান কতটুকু ছাড় দিচ্ছে কিংবা দিতে বাধ্য হচ্ছে, পরমাণু কর্মসূচি ত্যাগের বিনিময়ে ইরান কী পাচ্ছে, তা প্রকাশ করা হয়নি। শেষমেশ এই রোববার এসে জানা গেল যে দুই পক্ষে একটা রফা হয়ে গেছে। এটা ঠিক ন্যায়-অন্যায়, জনগণের তথ্য জানার অধিকারের মতো ভারিক্কি শব্দ দিয়ে বোঝার বিষয় নয়। এটা ধরে নেওয়ার ব্যাপার যে পরিস্থিতির উত্তরণ চাইলে কেবল নিজেরটুকু বুঝে নেওয়ার অবস্থানে থাকলে কাজ হবে না; আবার সমর্থকদের মন হারানোর ঝুঁকিও নেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যাপারে অন্যায্যভাবে উৎসাহী দেশি-বিদেশি পক্ষের সংখ্যাও তো কম নয় বলে শোনা যায়। এদের চাপটাপ যদি থেকে থাকে, সেগুলোকেও তো প্রধান দুই পক্ষকে সামালটামাল দিতে
হবে আরকি। এ অবস্থায় ‘একান্ত আলাপ’ কিন্তু লাগছেই।
সবকিছু তো প্রকাশ করতে হবেই, কিন্তু তার আগে বিবদমান দুই পক্ষ কথা বলুক না নিজেদের মতো করে কয়টা দিন—একান্তে, গোপনে। ‘কী কথা তাহার সাথে?’, তা মিনিটে মিনিটে জানার এতই প্রয়োজন? এতই তথ্য-আকুল সমাজ হয়ে গেলাম আমরা? নাকি মিডিয়ার খোরাক, টক শোর খোরাক জোগানোর জন্য পাকার আগেই তিতকুটে অবস্থাতেই গাছের ফলটি ধরে টানাটানি করা হচ্ছে?
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
No comments