আল বেরকাম্যু: জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি- অ্যাবসার্ডিস্ট যখন মানবতাবাদী by মাসরুর আরেফিন
গত সপ্তাহে নিউইয়র্কের স্ট্র্যান্ড বুক
স্টোরে ঢুকতেই চোখ পড়ল বড় আকারের একটা ব্যানার ঝুলছে, তাতে লেখা ‘আলবের
কাম্যু—জন্মশতবর্ষের উদ্যাপন’। এর নিচেই একটা টেবিলজুড়ে কাম্যুর যত উপন্যাস
আর এগুলোর ওপর খাড়া করে রাখা আলজেরিয়ান ক্রনিকলস, কাম্যুর ইংরেজিতে সদ্য
প্রকাশ হওয়া শেষ বই।
ইউনিয়ন স্কয়ারের কাছের এই বহুতল বইয়ের
দোকানটিতে আমার যাওয়ার অন্য এক ‘অ্যাবসার্ড’ কারণ রয়েছে। এই দোকানেই দীর্ঘ
সাত-আট বছর কাজ করেছেন আমাদের প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। আমি
নিউইয়র্ক গেলেই তারেক মাসুদের যুবক বয়সের স্মৃতিধন্য এই দোকানে যাই মূলত এক
অজানা টান থেকে—এর সিঁড়ির ধাপে ধাপে যেন এখনো ঝুলে আছে তাঁর ছায়া, আর আমি
যেন তা চাইলেই ছুঁতে পারব। এ চিন্তাটিই ‘অ্যাবসার্ড’—জীবন ও মৃত্যুর
দ্বৈতধর্মকে অস্বীকার করতে চাওয়া আমার এই দুঃখবিলাস!
এই ‘অ্যাবসার্ডিটি’কে আলবের কাম্যুর মতো করে ভাষা দিতে আর কোনো লেখক পেরেছিলেন বলে জানা নেই। কাম্যু তাঁর অতি সরল গল্পকথনে জীবনের যে অর্থহীনতাকে ফুটিয়ে তোলেন, তা আমাদের ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়, জীবনের নানাবিধ সত্যের সামনে দ্বিধান্বিত করে। বিশ্বব্যাপী আলবের কাম্যুর প্রবল জনপ্রিয়তার এটাই কারণ। বেশ কঠিন ভাষা ও কঠিন বয়ানের অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও কথাশিল্পী কাম্যু যখন মাত্র ৪৬ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, এর মাত্র তিন বছর আগে ৪৩ বছর বয়সে তিনি জিতে নেন সাহিত্যে দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম নোবেল বিজয়ীর অভিধা; তখন তাঁর জনপ্রিয়তা কোনো সেলিব্রেটি রক স্টারের মতোই। জীবনসত্যের দ্বৈততাগুলো—সুখ ও দুঃখ, আলো ও অন্ধকার, বাঁচা ও মরা—কাম্যুতে এসে প্যারাডক্স বা কূটাভাসের চেহারা নিয়ে নেয়: মৃত্যু আছে জানা সত্ত্বেও এবং এই ব্রহ্মাণ্ড সে বিষয়ে নীরব, তা জেনেও আমরা আমাদের জীবনকে মূল্য দিই। দ্বৈততার মধ্যে বাস করা সম্ভব (কাম্যুর ভাষায়: দুঃখের পর্বগুলো আমি মেনে নিতে পারি। কারণ, আমি জানি এর পরে হয়তো আমার সুখের অভিজ্ঞতালাভ হবে।), কিন্তু প্যারাডক্সের মধ্যে নয় (আবার তাঁর ভাষায়: ‘আমি জানি, আমার জীবনের বিরাট মূল্য আছে, কিন্তু আমি এটাও জানি যে জীবন মূল্যহীন’)।
অর্থহীনতার সঙ্গে আমাদের এই যে নিত্যদিনের জানাশোনা, কাম্যু তাঁর লেখায় সে বিষয়টিরই সন্ধান করে গেছেন, দেখতে চেয়েছেন আমরা মানুষেরা কীভাবে এ রকম অ্যাবসার্ড পরিমণ্ডলের মধ্যে বেঁচে থাকি। তিনি প্রশ্ন করে গেছেন: জীবনকে মূল্যবান বলতে হলে জীবনের তো অর্থ থাকতে হবে। যদি মেনে নিলাম যে জীবনের কোনো অর্থ নেই, সুতরাং কোনো মূল্যও নেই, তাহলে কি আমাদের নিজেদের মেরে ফেলাই উচিত নয়? এখানেই লুকিয়ে আছে কাম্যুর ‘আত্মহত্যা’বিষয়ক বিখ্যাত দার্শনিক প্রশ্নগুলো। জীবনের অর্থহীনতা এড়ানোর জন্য কেউ চাইলেই জীবনকে শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু জীবনের যেমন অর্থ নেই, মৃত্যুরও তো তেমনই। জীবনকে অর্থ দিতে চান? কী লাভ তাতে? শেষে তো মৃত্যুই। আর মৃত্যুকে অর্থপূর্ণ করতে চান? জীবনই তো থাকবে না তখন। কাম্যুর উপসংহার: এসবের বদলে বরং অর্থহীনতা আর মৃত্যু, দুটোকেই উপভোগ করা ভালো।
কাম্যুর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস দি আউটসাইডার-এ আমরা দেখি এর চূড়ান্ত রূপ—কীভাবে এর নায়ক মেখসো প্রতি মুহূর্তে তার জীবনের অর্থহীনতার মধ্যে নির্বিবাদে গা ভাসিয়ে চলেছে, কীভাবে আপাতদৃষ্টিতে বিনা কারণেই সে খুন করে বসল এক আরব যুবককে, আর শেষে কীভাবে বিচারের অর্থহীন ধাপগুলো পেরিয়ে সে এখন খুশি মনে গিলোটিনে শিরশ্ছেদের প্রতীক্ষায়। শিরশ্ছেদের আগে আগে ফাঁসির সেলে কী চিৎকার করে যাজককে অপমান করল সে—জীবনের কোনো সামান্য মানেও হয় না, কারোই অধিকার নেই অন্যের বিষয়ে জাজমেন্ট দেওয়ার, কারণ এই আমি-তুমি-সে-ব্রহ্মাণ্ড- ঈশ্বর—এই পুরো চক্রটাই অর্থহীন। এর পরেই আলবের কাম্যুর সবচেয়ে বিখ্যাত লাইনগুলো যেখানে মেখসো বলছে: ‘যেনবা আমার সেই অন্ধ রাগ আমাকে ধুয়ে দিল, আমাকে আশামুক্ত করে দিল; প্রথমবারের মতো, ওই তারা আর সংকেতে ভরা রাতের বেলাটিতে, আমি আমাকে খুলে দিলাম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নম্রতামাখা উদাসীনতার কাছে।’
আউটসাইডার উপন্যাস এক লহমায় কাম্যুকে তুলে দিল বিশ শতকের সর্বসেরা লেখকদের তালিকায়। পঞ্চাশের দশকের কাছাকাছি এসে ব্যাপারটি এমন হয়ে গেল যে কাফকা ও কাম্যুর লেখা মানবজীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধ ও জীবনের চোরাস্রোতে ধাবমান নৈরাশ্যবাদের বাইরে গিয়ে সাহিত্যচর্চাই যেন অসম্ভব; বিশ্বসাহিত্যে একদিন এমনই বিশাল বিপুল ছিল আলব্যের কাম্যুর প্রভাব। আজও তার কিছু কমেছে কি?
তো, আলবের কাম্যুর জন্মশতবার্ষিকীর ব্যানারের নিচে দাঁড়িয়ে, ঠিক তাঁরই মতো অবেলায় তারেক মাসুদেরও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অর্থহীনতাকে উপলব্ধি করতে করতে কিনে ফেললাম আলজেরিয়ান ক্রনিকলস। আগেই বলেছি, কাম্যুর জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ বই এটি, প্রকাশকাল ১৯৫৮, যা সম্পূর্ণ আকার নিয়ে প্রথমবারের মতো ইংরেজি ভাষায় আলোর মুখ দেখল এই ২০১৩ সালে এসে। সুখপাঠ্য এ বইটিতে কাম্যুর ট্রেডমার্ক অস্তিত্ববাদী বয়ানের ছিটেফোঁটাও নেই। এখানে বরং আমরা পাই তাঁর কিংবদন্তিতুল্য মানবাধিকারকর্মী চেহারাটির স্বচ্ছ এক পরিচয়। টিম স্পিরিট, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং কোনো জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা—কাম্যুর এই প্রবল ইতিবাচক বিশ্বাসগুলো একটা মূর্তিমান রূপ নিয়েছিল তার নিজেরই জীবনে, ফুটবল খেলার মাঠে। তিনি তাঁর জম্মভূমি আলজেরিয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল টিমের গোলকিপার ছিলেন ১৯২৮ থেকে ১৯৩০ সাল অবধি। কাম্যুর আলজেরিয়ান ক্রনিকলস-এ জড়ো করা সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ও বিবিধ রচনা তাঁর এই ফুটবল-উত্তর পর্বের নানা বোধ ও চেতনার এক পাঁচমিশালি। তবে এর সব কটা লেখার বিষয় একটিই: আলজেরিয়ার সঙ্গে তাঁর আত্মার সম্পর্ক।
১৯১৩ সালে আলজেরিয়াতেই জন্ম ফরাসি অভিবাসী আলবের কাম্যুর। ফ্রান্স থেকে আসা কাম্যুর মতো লোকদের ওখানে বলা হতো ‘কালো পা’ মানুষ, তাচ্ছিল্যভরে অবশ্যই। ১৯৪২ সালে কাম্যু আলজেরিয়া ছাড়লেন। এতগুলো বছর তাঁর কাটল এখানে, তাঁর সব প্রধান উপন্যাসের পটভূমি ওই আলজেরিয়াই, তার পরও কাম্যু তীব্র সমালোচিত হয়েছেন আলজেরিয়ার স্বাধীনতা বিষয়ে তাঁর দৃশ্যমান নীরবতার কারণে। এডওয়ার্ড সাইদ পরে কাম্যুকে এ কারণে তুলোধুনা করেছেন, আমরা জানি। সত্যি যে কাম্যু কখনো বিপ্লবী ছিলেন না, অন্য অস্তিত্ববাদী দার্শনিক বন্ধু জাঁ-পল সার্ত্রের তুলনায় তিনি ছিলেন মহা ‘শান্তিকামী’ এক লোক। কিন্তু সমালোচকেরা আলজেরিয়া প্রশ্নে কাম্যুকে এত দিন যা যা বলে এসেছেন, তার মোক্ষম জবাব হিসেবে এসেছে আলজেরিয়ান ক্রনিকলস-এ কাম্যুর রচনাগুলোতে। তখনকার ফরাসি উপনিবেশ আলজেরিয়ার ইতিহাসের দুই দশক এ বইতে উপস্থিত—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকে ১৯৫৮ সালে শার্ল দ্য-গলের ফিফথ রিপাবলিক প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত। কাম্যু আলজেরিয়ার কাবিলিয়াতে তখন মাত্র সাংবাদিকতার জীবন শুরু করেছেন। ওই সময় তিনি চাক্ষুষ করলেন প্রকৃতির অভিশাপ এক ভয়ংকর খরাকে। তিনি সংবাদপত্রে লিখলেন, ওই সর্বগ্রাসী খরার বিষয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে একজন সামান্য সাংবাদিক কত অসমর্থ। কাম্যুর ভাষায় : ‘সত্য হচ্ছে, আমরা প্রতিদিন এমন সব মানুষদের সঙ্গে বাস করছি, যাদের অবস্থা তিন শ বছর আগের ইউরোপিয়ান চাষাদের মতো; কিন্তু তার পরও আমরা, শুধু কেবল আমরাই, তাদের এই ভয়াবহ দশার ব্যাপারে কত উদাসীন।’ শাসক ফরাসিদের শাসিত আলজেরিয়ানদের প্রতি এই উদাসীনতার কথাটি এ বইয়ে উঠে এসেছে বারবারই। এরপর আলজেরিয়ানরা গড়ে তুলল স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এফএলএন) আর সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল ‘ফরাসি হটাও’ প্রতিরোধ আন্দোলনের। শুরু হলো আলজেরিয়ান ওয়ার, ফরাসি সেনাবাহিনী নামল বর্বরতার এক ভয়াল খেলায়। কাম্যু ভগ্নমন হলেন। তিনি, ফরাসি বামপন্থীদের অবাক করে দিয়ে, আলজেরিয়ার পূর্ণ স্বাধীনতায় কখনো বিশ্বাস রাখেননি, বরং ফরাসি সেনাদের নৃশংসতা তাকে আতঙ্কিত করে তুলল। তিনি লিখলেন, ‘ফরাসিদের অত্যাচারগুলো আমাদের অনেক বেশি ক্ষতি করছে, যতটা না করছে শত্রুপক্ষের শত খানেক গেরিলার কাজকারবার।’ একই সঙ্গে এনএফএলের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হলেন তিনি। ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতার নামে নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপরে চালানো ভায়োলেন্স ‘রক্তের এক কূটতার্কিক খেলামাত্র’, যাতে তাঁর বিন্দুমাত্র সমর্থন ছিল না।
১৯৫৫ সালে আলজেরিয়ান গেরিলাদের প্রতি এক খোলা চিঠিতে কাম্যু লিখলেন: ‘আমার অনুভূতি কী তা আপনাদের আমার জানানো দরকার। এই মুহূর্তে আমার ব্যথার কারণ আলজেরিয়া, যেমন কিনা অন্যেরা ধরুন ব্যথা বোধ করে তাদের ফুসফুসে।’ এক প্রচণ্ড শক্তিশালী তুলনা এটি, কারণ মনে রাখতে হবে, ফুসফুসের যক্ষ্মা রোগে কাম্যু তখন ভুগছেন, এমনকি একসময় মারাও যেতে বসেছিলেন। আলজেরিয়া ছিল কাম্যুর অক্সিজেন—একদিকে ঔপনিবেশিক শক্তির অনাচার ও অন্যদিকে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী ভায়োলেন্স—এই দুয়ের মধ্যে পড়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল তাঁর।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরের বছরেই, ১৯৫৮ সালে, ফ্রান্সে যখন বের হলো কাম্যুর এই শেষ বইটি, স্বাভাবিক তখন ফরাসি ইন্টেলেকচুয়াল মহলের কাছ থেকে তাঁর ভাগ্যে জুটল নীরবতা ও উপেক্ষা। ওই বছরেরই মে মাসে ফরাসি সেনাবাহিনীর ডানঘেঁষা অংশটি আলজিয়ার্সে এক ক্যু করার প্রয়াস নিল; শুরু হলো এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির, যার উপসংহারে গিয়ে ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে দ্য গল প্রেসিডেন্ট হলেন। এর চার বছর পরে আলজেরিয়া স্বাধীন হলো, কিন্তু কাম্যু ততদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। লোকে বলে, রাশিয়ান বামপন্থীদের এক সাজানো মৃত্যুফাঁদ ছিল তাঁর ওই সড়ক দুর্ঘটনা।
বইটি বিরতি না দিয়ে যদি এক নিঃশ্বাসে শেষ করেন, তো আপনার পরিচয় ঘটবে দি আউটসাইডার বা দ্য প্লেগ-এর সঙ্গে সম্পূর্ণ সাযুজ্যহীন এক নতুন ‘শান্তিকামী’ কাম্যুর সঙ্গে, যিনি চরমপন্থা ও ভায়োলেন্সের প্রচণ্ড বিরোধী। ইংরেজিতে বোধ হয় এর চেয়ে আর উপযুক্ত কোনো সময়ে বাজারে আসতে পারত না এই বই। একদিকে ‘আরব বসন্তের’ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সন্ত্রাসবাদ এখনো প্রায়ই সংবাদপত্রের প্রথম পাতার প্রধান সংবাদ আর অন্যদিকে এই মহান লেখকের এখন জন্মশতবর্ষও বটে—সবমিলিয়ে তাঁর আলজেরিয়ান ক্রনিকলস কোনো ইতিহাসের বই নয়, কঠিন এক পৃথিবীতে প্রশ্নযোগ্য ‘ন্যায়’-এর আরও প্রশ্নযোগ্য ‘পক্ষে থাকার’ গাইড যেন এটি।
এই ‘অ্যাবসার্ডিটি’কে আলবের কাম্যুর মতো করে ভাষা দিতে আর কোনো লেখক পেরেছিলেন বলে জানা নেই। কাম্যু তাঁর অতি সরল গল্পকথনে জীবনের যে অর্থহীনতাকে ফুটিয়ে তোলেন, তা আমাদের ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়, জীবনের নানাবিধ সত্যের সামনে দ্বিধান্বিত করে। বিশ্বব্যাপী আলবের কাম্যুর প্রবল জনপ্রিয়তার এটাই কারণ। বেশ কঠিন ভাষা ও কঠিন বয়ানের অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও কথাশিল্পী কাম্যু যখন মাত্র ৪৬ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, এর মাত্র তিন বছর আগে ৪৩ বছর বয়সে তিনি জিতে নেন সাহিত্যে দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম নোবেল বিজয়ীর অভিধা; তখন তাঁর জনপ্রিয়তা কোনো সেলিব্রেটি রক স্টারের মতোই। জীবনসত্যের দ্বৈততাগুলো—সুখ ও দুঃখ, আলো ও অন্ধকার, বাঁচা ও মরা—কাম্যুতে এসে প্যারাডক্স বা কূটাভাসের চেহারা নিয়ে নেয়: মৃত্যু আছে জানা সত্ত্বেও এবং এই ব্রহ্মাণ্ড সে বিষয়ে নীরব, তা জেনেও আমরা আমাদের জীবনকে মূল্য দিই। দ্বৈততার মধ্যে বাস করা সম্ভব (কাম্যুর ভাষায়: দুঃখের পর্বগুলো আমি মেনে নিতে পারি। কারণ, আমি জানি এর পরে হয়তো আমার সুখের অভিজ্ঞতালাভ হবে।), কিন্তু প্যারাডক্সের মধ্যে নয় (আবার তাঁর ভাষায়: ‘আমি জানি, আমার জীবনের বিরাট মূল্য আছে, কিন্তু আমি এটাও জানি যে জীবন মূল্যহীন’)।
অর্থহীনতার সঙ্গে আমাদের এই যে নিত্যদিনের জানাশোনা, কাম্যু তাঁর লেখায় সে বিষয়টিরই সন্ধান করে গেছেন, দেখতে চেয়েছেন আমরা মানুষেরা কীভাবে এ রকম অ্যাবসার্ড পরিমণ্ডলের মধ্যে বেঁচে থাকি। তিনি প্রশ্ন করে গেছেন: জীবনকে মূল্যবান বলতে হলে জীবনের তো অর্থ থাকতে হবে। যদি মেনে নিলাম যে জীবনের কোনো অর্থ নেই, সুতরাং কোনো মূল্যও নেই, তাহলে কি আমাদের নিজেদের মেরে ফেলাই উচিত নয়? এখানেই লুকিয়ে আছে কাম্যুর ‘আত্মহত্যা’বিষয়ক বিখ্যাত দার্শনিক প্রশ্নগুলো। জীবনের অর্থহীনতা এড়ানোর জন্য কেউ চাইলেই জীবনকে শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু জীবনের যেমন অর্থ নেই, মৃত্যুরও তো তেমনই। জীবনকে অর্থ দিতে চান? কী লাভ তাতে? শেষে তো মৃত্যুই। আর মৃত্যুকে অর্থপূর্ণ করতে চান? জীবনই তো থাকবে না তখন। কাম্যুর উপসংহার: এসবের বদলে বরং অর্থহীনতা আর মৃত্যু, দুটোকেই উপভোগ করা ভালো।
কাম্যুর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস দি আউটসাইডার-এ আমরা দেখি এর চূড়ান্ত রূপ—কীভাবে এর নায়ক মেখসো প্রতি মুহূর্তে তার জীবনের অর্থহীনতার মধ্যে নির্বিবাদে গা ভাসিয়ে চলেছে, কীভাবে আপাতদৃষ্টিতে বিনা কারণেই সে খুন করে বসল এক আরব যুবককে, আর শেষে কীভাবে বিচারের অর্থহীন ধাপগুলো পেরিয়ে সে এখন খুশি মনে গিলোটিনে শিরশ্ছেদের প্রতীক্ষায়। শিরশ্ছেদের আগে আগে ফাঁসির সেলে কী চিৎকার করে যাজককে অপমান করল সে—জীবনের কোনো সামান্য মানেও হয় না, কারোই অধিকার নেই অন্যের বিষয়ে জাজমেন্ট দেওয়ার, কারণ এই আমি-তুমি-সে-ব্রহ্মাণ্ড- ঈশ্বর—এই পুরো চক্রটাই অর্থহীন। এর পরেই আলবের কাম্যুর সবচেয়ে বিখ্যাত লাইনগুলো যেখানে মেখসো বলছে: ‘যেনবা আমার সেই অন্ধ রাগ আমাকে ধুয়ে দিল, আমাকে আশামুক্ত করে দিল; প্রথমবারের মতো, ওই তারা আর সংকেতে ভরা রাতের বেলাটিতে, আমি আমাকে খুলে দিলাম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নম্রতামাখা উদাসীনতার কাছে।’
আউটসাইডার উপন্যাস এক লহমায় কাম্যুকে তুলে দিল বিশ শতকের সর্বসেরা লেখকদের তালিকায়। পঞ্চাশের দশকের কাছাকাছি এসে ব্যাপারটি এমন হয়ে গেল যে কাফকা ও কাম্যুর লেখা মানবজীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধ ও জীবনের চোরাস্রোতে ধাবমান নৈরাশ্যবাদের বাইরে গিয়ে সাহিত্যচর্চাই যেন অসম্ভব; বিশ্বসাহিত্যে একদিন এমনই বিশাল বিপুল ছিল আলব্যের কাম্যুর প্রভাব। আজও তার কিছু কমেছে কি?
তো, আলবের কাম্যুর জন্মশতবার্ষিকীর ব্যানারের নিচে দাঁড়িয়ে, ঠিক তাঁরই মতো অবেলায় তারেক মাসুদেরও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অর্থহীনতাকে উপলব্ধি করতে করতে কিনে ফেললাম আলজেরিয়ান ক্রনিকলস। আগেই বলেছি, কাম্যুর জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ বই এটি, প্রকাশকাল ১৯৫৮, যা সম্পূর্ণ আকার নিয়ে প্রথমবারের মতো ইংরেজি ভাষায় আলোর মুখ দেখল এই ২০১৩ সালে এসে। সুখপাঠ্য এ বইটিতে কাম্যুর ট্রেডমার্ক অস্তিত্ববাদী বয়ানের ছিটেফোঁটাও নেই। এখানে বরং আমরা পাই তাঁর কিংবদন্তিতুল্য মানবাধিকারকর্মী চেহারাটির স্বচ্ছ এক পরিচয়। টিম স্পিরিট, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং কোনো জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা—কাম্যুর এই প্রবল ইতিবাচক বিশ্বাসগুলো একটা মূর্তিমান রূপ নিয়েছিল তার নিজেরই জীবনে, ফুটবল খেলার মাঠে। তিনি তাঁর জম্মভূমি আলজেরিয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল টিমের গোলকিপার ছিলেন ১৯২৮ থেকে ১৯৩০ সাল অবধি। কাম্যুর আলজেরিয়ান ক্রনিকলস-এ জড়ো করা সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ও বিবিধ রচনা তাঁর এই ফুটবল-উত্তর পর্বের নানা বোধ ও চেতনার এক পাঁচমিশালি। তবে এর সব কটা লেখার বিষয় একটিই: আলজেরিয়ার সঙ্গে তাঁর আত্মার সম্পর্ক।
১৯১৩ সালে আলজেরিয়াতেই জন্ম ফরাসি অভিবাসী আলবের কাম্যুর। ফ্রান্স থেকে আসা কাম্যুর মতো লোকদের ওখানে বলা হতো ‘কালো পা’ মানুষ, তাচ্ছিল্যভরে অবশ্যই। ১৯৪২ সালে কাম্যু আলজেরিয়া ছাড়লেন। এতগুলো বছর তাঁর কাটল এখানে, তাঁর সব প্রধান উপন্যাসের পটভূমি ওই আলজেরিয়াই, তার পরও কাম্যু তীব্র সমালোচিত হয়েছেন আলজেরিয়ার স্বাধীনতা বিষয়ে তাঁর দৃশ্যমান নীরবতার কারণে। এডওয়ার্ড সাইদ পরে কাম্যুকে এ কারণে তুলোধুনা করেছেন, আমরা জানি। সত্যি যে কাম্যু কখনো বিপ্লবী ছিলেন না, অন্য অস্তিত্ববাদী দার্শনিক বন্ধু জাঁ-পল সার্ত্রের তুলনায় তিনি ছিলেন মহা ‘শান্তিকামী’ এক লোক। কিন্তু সমালোচকেরা আলজেরিয়া প্রশ্নে কাম্যুকে এত দিন যা যা বলে এসেছেন, তার মোক্ষম জবাব হিসেবে এসেছে আলজেরিয়ান ক্রনিকলস-এ কাম্যুর রচনাগুলোতে। তখনকার ফরাসি উপনিবেশ আলজেরিয়ার ইতিহাসের দুই দশক এ বইতে উপস্থিত—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকে ১৯৫৮ সালে শার্ল দ্য-গলের ফিফথ রিপাবলিক প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত। কাম্যু আলজেরিয়ার কাবিলিয়াতে তখন মাত্র সাংবাদিকতার জীবন শুরু করেছেন। ওই সময় তিনি চাক্ষুষ করলেন প্রকৃতির অভিশাপ এক ভয়ংকর খরাকে। তিনি সংবাদপত্রে লিখলেন, ওই সর্বগ্রাসী খরার বিষয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে একজন সামান্য সাংবাদিক কত অসমর্থ। কাম্যুর ভাষায় : ‘সত্য হচ্ছে, আমরা প্রতিদিন এমন সব মানুষদের সঙ্গে বাস করছি, যাদের অবস্থা তিন শ বছর আগের ইউরোপিয়ান চাষাদের মতো; কিন্তু তার পরও আমরা, শুধু কেবল আমরাই, তাদের এই ভয়াবহ দশার ব্যাপারে কত উদাসীন।’ শাসক ফরাসিদের শাসিত আলজেরিয়ানদের প্রতি এই উদাসীনতার কথাটি এ বইয়ে উঠে এসেছে বারবারই। এরপর আলজেরিয়ানরা গড়ে তুলল স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এফএলএন) আর সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল ‘ফরাসি হটাও’ প্রতিরোধ আন্দোলনের। শুরু হলো আলজেরিয়ান ওয়ার, ফরাসি সেনাবাহিনী নামল বর্বরতার এক ভয়াল খেলায়। কাম্যু ভগ্নমন হলেন। তিনি, ফরাসি বামপন্থীদের অবাক করে দিয়ে, আলজেরিয়ার পূর্ণ স্বাধীনতায় কখনো বিশ্বাস রাখেননি, বরং ফরাসি সেনাদের নৃশংসতা তাকে আতঙ্কিত করে তুলল। তিনি লিখলেন, ‘ফরাসিদের অত্যাচারগুলো আমাদের অনেক বেশি ক্ষতি করছে, যতটা না করছে শত্রুপক্ষের শত খানেক গেরিলার কাজকারবার।’ একই সঙ্গে এনএফএলের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হলেন তিনি। ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতার নামে নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপরে চালানো ভায়োলেন্স ‘রক্তের এক কূটতার্কিক খেলামাত্র’, যাতে তাঁর বিন্দুমাত্র সমর্থন ছিল না।
১৯৫৫ সালে আলজেরিয়ান গেরিলাদের প্রতি এক খোলা চিঠিতে কাম্যু লিখলেন: ‘আমার অনুভূতি কী তা আপনাদের আমার জানানো দরকার। এই মুহূর্তে আমার ব্যথার কারণ আলজেরিয়া, যেমন কিনা অন্যেরা ধরুন ব্যথা বোধ করে তাদের ফুসফুসে।’ এক প্রচণ্ড শক্তিশালী তুলনা এটি, কারণ মনে রাখতে হবে, ফুসফুসের যক্ষ্মা রোগে কাম্যু তখন ভুগছেন, এমনকি একসময় মারাও যেতে বসেছিলেন। আলজেরিয়া ছিল কাম্যুর অক্সিজেন—একদিকে ঔপনিবেশিক শক্তির অনাচার ও অন্যদিকে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী ভায়োলেন্স—এই দুয়ের মধ্যে পড়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল তাঁর।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরের বছরেই, ১৯৫৮ সালে, ফ্রান্সে যখন বের হলো কাম্যুর এই শেষ বইটি, স্বাভাবিক তখন ফরাসি ইন্টেলেকচুয়াল মহলের কাছ থেকে তাঁর ভাগ্যে জুটল নীরবতা ও উপেক্ষা। ওই বছরেরই মে মাসে ফরাসি সেনাবাহিনীর ডানঘেঁষা অংশটি আলজিয়ার্সে এক ক্যু করার প্রয়াস নিল; শুরু হলো এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির, যার উপসংহারে গিয়ে ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে দ্য গল প্রেসিডেন্ট হলেন। এর চার বছর পরে আলজেরিয়া স্বাধীন হলো, কিন্তু কাম্যু ততদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। লোকে বলে, রাশিয়ান বামপন্থীদের এক সাজানো মৃত্যুফাঁদ ছিল তাঁর ওই সড়ক দুর্ঘটনা।
বইটি বিরতি না দিয়ে যদি এক নিঃশ্বাসে শেষ করেন, তো আপনার পরিচয় ঘটবে দি আউটসাইডার বা দ্য প্লেগ-এর সঙ্গে সম্পূর্ণ সাযুজ্যহীন এক নতুন ‘শান্তিকামী’ কাম্যুর সঙ্গে, যিনি চরমপন্থা ও ভায়োলেন্সের প্রচণ্ড বিরোধী। ইংরেজিতে বোধ হয় এর চেয়ে আর উপযুক্ত কোনো সময়ে বাজারে আসতে পারত না এই বই। একদিকে ‘আরব বসন্তের’ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সন্ত্রাসবাদ এখনো প্রায়ই সংবাদপত্রের প্রথম পাতার প্রধান সংবাদ আর অন্যদিকে এই মহান লেখকের এখন জন্মশতবর্ষও বটে—সবমিলিয়ে তাঁর আলজেরিয়ান ক্রনিকলস কোনো ইতিহাসের বই নয়, কঠিন এক পৃথিবীতে প্রশ্নযোগ্য ‘ন্যায়’-এর আরও প্রশ্নযোগ্য ‘পক্ষে থাকার’ গাইড যেন এটি।
No comments