পাকিস্তান- গণমাধ্যমের ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা by হামিদ মির
‘সাংবাদিক হওয়ার চেষ্টা কোরো না,
পাকিস্তানে সাংবাদিকতা খুবই বিপজ্জনক।’ কলেজছাত্র অবস্থায় আমার একটি লেখা
সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখে বাবা আমাকে এটা বলেছিলেন তিন দশক আগে। বাবা
ছিলেন পাঞ্জাবের লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক এবং বিখ্যাত
কলাম লেখক।
অথচ আমার জন্য বিষয়টি ছিল দারুণ আনন্দের। আমার
লেখা ছাপা হয়েছে দেখে কলেজের শিক্ষক ও সহপাঠীরাও খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু
বাবা আমাকে পাকিস্তানের সাংবাদিকদের বিপদ নিয়ে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা
দিলেন। সে সময়ের সামরিক স্বৈরাচার জিয়াউল হকের সমালোচনা করায় বাবা বেশ
বিপদে ছিলেন। পরিষ্কার ভাষায় তিনি আমাকে বললেন, ‘সরকার আমাকে দেখতে পারে
না, কিছু ধর্মীয় চরমপন্থী দিন-রাত আমাকে অনুসরণ করে; ওরা হয়তো আমাকে মেরে
ফেলবে। তুমি বরং লেখালেখি ছেড়ে ক্রিকেট নিয়ে থাকো।’
আমি হতাশ হলাম এবং কয়েক মাসের মধ্যেই বাবার আশঙ্কা সত্যি হলো। রহস্যময় পরিস্থিতিতে তাঁর মৃত্যু হলো। মানবাধিকারকর্মীরা ময়নাতদন্ত দাবি করলেও সরকারি নিষেধাজ্ঞায় সেটা হলো না। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কর্তৃপক্ষ তাঁকে কবরস্থ করল। সৌভাগ্যজনক অথবা দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি বাবার আদেশ মানলাম না। মায়ের ইচ্ছায় আমি সাংবাদিকই হলাম। মা ছিলেন সাহসী একজন নারী। তিনি এমনকি আমার ছোট ভাইকেও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে বললেন। মা বেঁচে থাকলে দেখতেন, এখনো পাকিস্তানে সাংবাদিকতা কী রকম বিপজ্জনক এক পেশা।
তিন দশক পরেও আমরা বিপদে আছি। এত বছরে সাংবাদিকতা ভালোই বিকশিত হয়েছে এ দেশে। তরুণেরা আরও বেশি হারে এই পেশায় আসছেন। তাঁদের বিশ্বাস, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যবহার করে তাঁরা পাকিস্তানে সামাজিক পরিবর্তন ঘটাবেন। কিন্তু স্বাধীনতা থাকার জন্য আমাদের দিতে হচ্ছে চরম মূল্য। ৯/১১-এর পাকিস্তানে ৯৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই অপহরণের শিকার হয়ে নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেক সময় আমরা তাঁদের হত্যাকারীদের চিনে ফেলি। কিন্তু তারা আইনের থেকেও শক্তিশালী। আমি কয়েক ডজন সাংবাদিকের কথা জানি, যাঁরা বাধ্য হয়ে পেশা বদল করেছেন। আমি এমন মানুষদেরও জানি, যাঁরা তাঁদের আপন শহর ছাড়তে না চাওয়ার পরিণতিতে খুন হয়েছেন। শারীরিক আক্রমণ এবং সহিংস হুমকিই আজ পাকিস্তানে চরম অঘোষিত সেন্সরশিপের কাজ করছে।
সম্প্রতি তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) কয়েকটি গণমাধ্যম সংস্থার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছে। বিশেষভাবে তাদের কাছে ঘৃণিত দুই সাংবাদিকের ছবি দিয়ে সেই রায় তারা প্রকাশও করেছে। একজন হলেন বিখ্যাত কলাম লেখক হাসান নিসার এবং অন্যজন হলাম আমি। এ ধরনের হুমকি এটাই প্রথম নয়। ২০১২ সালে মালালা ইউসুফজাইয়ের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ করলে তারা আমার বিরুদ্ধে প্রথম হুমকি দেয়। এর কয়েক দিন পরেই আমার গাড়িতে বোমা পাতা হয় এবং টিটিপি তার দায় স্বীকারও করে। আমি ছাড়াও অন্য সাংবাদিকেরাও টিটিপির হুমকির শিকার। আমরা আরও বেশি চিন্তিত নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর দ্বিমুখী চাল ও হুমকির জন্য। বেশ কয়েকবারই তারা সাংবাদিকদের অপহরণের পর হত্যা করে টিটিপির ওপর দায় চাপিয়েছে। পাকিস্তানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রধান দুই শত্রু হলো টিটিপি ও গোয়েন্দা সংস্থা। টিটিপি আমাদের ইসলামের শত্রু বলে চাপে ফেলে। আর নিরাপত্তা সংস্থাগুলো গণমাধ্যমকে বশ করতে তাদের দালালদের পত্রিকার মাধ্যমে আমাদের ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হিসেবে অভিহিত করে।
রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পিটিভিতে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র প্রথম আমাকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ তকমা দেয়। আমার অপরাধ ছিল কাশ্মীরের ভূমিকম্পদুর্গত এলাকা নীলাম উপত্যকায় গিয়েছিলাম এবং দেখে এসে জানিয়েছিলাম যে সেখানে কোনো সরকারি ত্রাণ পৌঁছায়নি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পারভেজ মোশাররফকে জানায়, আমি শত্রুদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ধ্বংস করছি। সেনা কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি অনুসন্ধান করে এবং দেখতে পায় আমি ঠিকই বলেছি। তখন মোশাররফ আমাকে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর বিপক্ষে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। আমাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, আমি যদি তাঁর বিরুদ্ধে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান করি, তাহলে আমাকে ১৫০ মিলিয়ন রুপি দেওয়া হবে। আমি নারাজ হলে আরও পাঁচজন টিভি উপস্থাপকসহ আমাকে টেলিভিশনে নিষিদ্ধ করা হয়।
মোশাররফের বিদায়ের পর আমার অনুষ্ঠানে আমি নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়টা সামনে আনা শুরু করি। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারি, মোশাররফ বিদায় নিলেও তাঁর নীতি অটুট রয়ে গেছে। পাকিস্তানের শক্তিমান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা আমাকে বোঝাতে আসে যে জাতীয় স্বার্থে নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়টা আমার এড়িয়ে যাওয়া উচিত। আমি তাদের বোঝাতে চাইছিলাম যে আমি কেবল আমার পেশাগত দায়িত্ব পালন করছি। আমার জবাবকে তারা ঔদ্ধত্য হিসেবে নিল। এর পরিণতিতে আমার ছেলেমেয়েদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। এটা ছিল আমার সবচেয়ে নাজুক জায়গায় আঘাত; এ ঘটনায় আমার স্নায়ু বিকল হয়ে যায়।
কিন্তু সেটাই শেষ নয়। আইএসআই আমাকে একটা খুনের মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আদালতে তারা প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়। অথচ আমার অনেক সহকর্মী গণমাধ্যমে আমার বিচার শুরু করে একজন নৌ কর্মকর্তার চাপে। নৌবাহিনীর এই অফিসারকে আইএসআইয়ের মিডিয়া শাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে, আমার মোবাইলে কিছু হুমকিবার্তা আসে। আমি সবকিছু প্রকাশ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। পার্লামেন্টে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। জাতীয় পরিষদের সাবেক স্পিকার ফাহমিদা মির্জা বিষয়টি তদন্তে বিশেষ একটি কমিটি করে দেন। আমি তাঁদের সব ফোন নম্বর সরবরাহ করি। এর কয়েক দিন পর আইএসআইয়ের এক কর্মকর্তা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘সবই হয়েছে ভুল-বোঝাবুঝি থেকে। আমাদের প্রতিষ্ঠান নয়, কয়েকজন ব্যক্তি এর জন্য দায়ী।’ আমি বিষয়টি গণমাধ্যমে দিইনি, কারণ আমি কোনো ব্যক্তিগত রোষ থেকে এসব করিনি। বিশেষ কমিটি ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ একটি বিশদ প্রতিবেদন পার্লামেন্টে পেশ করে। কিন্তু সেখানে আমাকে দেওয়া হুমকি বিষয়ে তদন্তের কোনো কথাই ছিল না।
পাকিস্তানের সাংবাদিকেরা শুধু টিটিপি বা আইএসআইয়ের কাছ থেকেই হুমকি পান না। মাঝেমধ্যে শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রদূতেরা আমাদের ওপর খেপে যান। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যান ডব্লিউ পিটারসন আমি ও আমার সহকর্মী কামরান খানের বিরুদ্ধে একটা ক্রুদ্ধ চিঠি পাঠান। সে সময় আমরা ইসলামাবাদের কুখ্যাত মার্কিন ভাড়াটে যুদ্ধ কোম্পানি ব্ল্যাকওয়াটার নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করছিলাম। সম্প্রতি আমার টেলিভিশন চ্যানেলের ম্যানেজমেন্ট আমাকে জানিয়েছে যে একটি গণতন্ত্রবিরোধী থিংক ট্যাংক আমাকে হত্যার জন্য খুনি ভাড়া করার চেষ্টা করছে। এই ধর্মোন্মাদ গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। কখনো কখনো তিনি আমাকে ‘সিআইএ’র এজেন্ট, কখনো ভারতীয় ‘র’-এর এজেন্ট বলে গালি দেন। কখনো কখনো তালেবান এজেন্টও বলেন। আমাদের ম্যানেজমেন্ট তথ্য-প্রমাণসমেত আদালতে অভিযোগ করে যে কতিপয় গণতন্ত্রবিরোধী ব্যক্তি গোয়েন্দা সংস্থার তহবিল নিয়ে স্বাধীন গণমাধ্যমকে জিম্মি করার জন্য ইসলাম ও দেশপ্রেমের নামে চক্রান্ত করছে। করাচির একটি আদালত অভিযুক্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু এখনো লোকটি ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অনেকে মনে করেন, পাকিস্তানের গণমাধ্যম শক্তিশালী। তারা ভাবে, আমি খুবই প্রভাবশালী। কিন্তু ঘটনা হলো, এক বছর ধরে আমি এক জায়গায় নিয়মিত ঘুমাই না। সাংবাদিক হওয়ার দোষে আমি স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনও পাই না। যদি রাজধানী নিবাসী নামকরা সাংবাদিক হয়েও আমি এ রকম বিপন্ন জীবন কাটাই, তাহলে যারা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় কাজ করেন, তাঁদের কথা ভাবুন। তাঁরা আমার চেয়েও বিপন্ন। সরকার তাঁদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। আমরা তাহলে কী করব? পেশা ছেড়ে দেব? না! কারণ, আমাদের দর্শক-শ্রোতারাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। জনগণই আমাদের সেরা বিচারক। তারা জানে যে আমরা তাদের জানার অধিকারের জন্য লড়াই করছি। আমরা তাদের আশা। গণমাধ্যমের শত্রুরা আমাদের নিশ্চুপ করিয়ে দিতে পারবে না, কারণ আমরা বেঁচে আছি জনগণের হূদয়ে। একটি জিনিস পরিষ্কার: আমরা সাংবাদিকেরা লড়াই চালিয়ে যাব। আমরা আত্মসমর্পণ করব না। আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আমাদের কিছু ঘটলে তার দায় অবশ্যই সরকারের।
পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম মাতৃভূমিতে এই অঘোষিত সেন্সরশিপ কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
এ বছর পাকিস্তান সরকার তাঁর পিটিশনের প্রতিক্রিয়ায় ২০টি সরকারি সংস্থার মাধ্যমে সাংবাদিকদের কিনে নেওয়ার জন্য ব্যবহূত গোপন তহবিল বাতিল করে এবং ভাতাপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের নাম প্রকাশ করে।
হামিদ মির: পাকিস্তানের জিয়ো টিভি ও জং গ্রুপে কর্মরত সাংবাদিক।
No comments