বেতার-বিটিভির স্বায়ত্তশাসন, নাকি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ? by সৌমিত্র শেখর

আমার গ্রামের বাড়ি থেকে এক বন্ধু আমাকে ফোন করে হেফাজতের সমাবেশ উপলক্ষ করে মতিঝিলের ঘটনাবলি সম্পর্কে সম্প্র্রতি সরকার প্রদত্ত সম্পূর্ণ প্রেসনোটটি জোগাড় করে দিতে বলে।
প্রেসনোটটি যে সহজলভ্য নয় এবং আমিও যে তার মতোই অসহায়, সে কথা বন্ধু বুঝতে চায় না। অবশেষে অনেক কষ্ট করে আমি সেই পূর্ণ প্রেসনোটটি জোগাড় করে তার কাছে পাঠাই আর অনুভব করি সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি দৈনিক থাকলে মফস্বল শহরে বসেই আগ্রহীরা প্রেসনোটটির পূর্ণপাঠ পেতে পারত।
এইচ এম এরশাদের শাসনামলে বিটিভি অভিধা পেয়েছিল 'সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স'। রেডিওর অবস্থাও ছিল একই রকম। সে সময়ই এরশাদের পতনের দাবির সঙ্গে 'রেডিও-টিভি'র স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপিত হয়। এরশাদের পতনের পর তৎকালীন সাতদলীয় জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও এ মাধ্যমের সামান্যতম চরিত্র বদল ঘটানো হয়নি। ফলে তখন একে অনেকেই বলেছেন 'বিবি ও গোলামের বাক্স'। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে 'রেডিও বাংলাদেশ'-এর নাম পরিবর্তন করে এর নাম 'বাংলাদেশ বেতার' পুনঃ করা হয়। কিন্তু 'সাহেব-বিবি-গোলাম' বা শুধু 'বিবি-গোলাম-এর বাক্সের চেয়ে বিটিভি এবং বেতারের অবস্থা চোখে পড়ার মতো উন্নতি হয়নি সে সময়। তবে সেইবার আওয়ামী লীগ সরকার 'বেতার-বিটিভি'র স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করে, যার অপমৃত্যুর সংবাদ অনুসন্ধানী সবারই জানা। নিকট ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, যেসব দল বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল, যেমন জাতীয় পার্টি (১৯৯১ পর্যন্ত), বিএনপি (১৯৯৬ পর্যন্ত), আওয়ামী লীগ (২০০১ পর্যন্ত), বিএনপি-জামায়াত-বিজেপি ইত্যাদি (২০০৭ পর্যন্ত), এরপর দুই বছর (২০০৯ পর্যন্ত) নানা তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং অবশেষে ১৪ দলের সমন্বয়ে মহাজোট সরকার অদ্যাবধি ক্ষমতায়- তারা সবাই ক্ষমতায় থাকাকালে (মুখে যাই বলুন) বেতার-বিটিভির স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে একই মনোভাব পোষণ করেছেন এবং তা হলো বেতার-বিটিভির প্রত্যক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন না দেওয়া।
বেতার-বিটিভির স্বায়ত্তশাসনের কথাটি আপাত সুন্দর শোনালেও বাস্তবে তা হচ্ছে না; এ যেন সোনার পাথরবাটি। দৈনিক বাংলা বন্ধ করা ঠিক হয়েছে বলে মনে করি না। সরকারের মুখপত্র হিসেবে একটি দৈনিক থাকা খুবই জরুরি। একটি টেলিভিশনও থাকা চাই। সেটির নাম বিটিভি হতে পারে, না-ও পারে। সে কারণে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, তারা বিটিভিকে সরকারি টেলিভিশন হিসেবে রাখবে নাকি অন্য কোনো টেলিভিশনের কথা ভাববে। ঢাকঢাক গুড়গুড় করে লাভ নেই। সংসদ টেলিভিশন চালু হয়েছে। বিটিভি ও সংসদ টেলিভিশন- একই সঙ্গে দুটো চ্যানেল চালু রাখা কোনো কাজের কথা নয়। সংসদ টেলিভিশনের কাজ বিটিভি দিয়েই চলতে পারে। বিবিসি বা সিএনএনের দোহাই দিয়ে স্থিতিশীল গণতন্ত্রের অন্য অতি উন্নত দেশের উদাহরণেরও প্রয়োজন নেই। সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। সরকার বিটিভিকে সম্পূর্ণ এবং স্থায়ীভাবেই আয়ত্তে রাখুক, তবে এর পরিসর আরো সীমিত করা প্রয়োজন। দরকার একটি সরকারি ছোট দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করা। কারণ জনগণ কোনো ব্যাপারে সরকারের মত বিস্তারিত জানতে বা শুনতে সরকারি দৈনিক সংবাদপত্র বা রেডিও-টিভির ওপর নির্ভর করতে পারবে। সরকার এগুলো ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে করবে না, করবে প্রচার ও নিজেকে সম্পূর্ণ উল্লেখের প্রয়োজনে। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে সরকার 'বাংলাদেশ বেতার' বা 'বাংলাদেশ টেলিভিশন'কে যতই স্বায়ত্তশাসন দিক না কেন, সেগুলো কোনোভাবেই ব্যক্তিমালিকানাধীন বা বেসরকারি চ্যানেলগুলোর বিকল্প তো হবেই না, প্রতিদ্বন্দ্বীও হতে পারবে না। তাই সরকারি মিডিয়া দিয়ে জনসেবা বা জনকল্যাণ হবে আবার ব্যবসাও আসবে, এটা আকাশকুসুম কল্পনামাত্র।
যাঁরা বিটিভির মনোপলির প্রসঙ্গ তোলেন তাঁরা এটা কেন বলেন না যে বাংলাদেশ সরকারকে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলতে হবে। সরকার এই অনুচ্ছেদ আক্ষরিকভাবে মেনে চললেই কথিত মনোপলির স্থান আর থাকে না। এই অনুচ্ছেদের ২(খ) ধারায় 'সংবাদক্ষেত্রের' (সংবিধানের ইংরেজি ভাষ্যে আছে Press; সেটা Media হওয়া বাঞ্ছনীয়) 'স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান' করার কথা আছে, সেটা মেনে চলতে হবে। আর 'তথ্য অধিকার আইন' (২০০৯) যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। বিটিভির স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে আবার রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সেনাপ্রধান যখন ভাষণ দেন, তখন বেতার-বিটিভিসহ দেশের সব টিভি চ্যানেল ও রেডিওতে সেগুলো প্রচারে প্রায় বাধ্য করা হবে- এটা কোন ধরনের 'স্বাধীনতা'? নিকট অতীতে দেখা গেছে, সরকারপ্রধান বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান অথবা সেনাপ্রধান যখন বক্তব্য দিয়েছেন, সে সময় দেশি সব টিভি চ্যানেলে ওই বক্তব্য একযোগে প্রচারিত হয়েছে। ফলে বিটিভির স্বায়ত্তশাসন সমস্যার সমাধান নয়। সর্বক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ যদি বর্তমান থাকে তাহলে বিটিভির স্বায়ত্তশাসন দিয়েও সমস্যার সমাধান হবে না।
তাহলে সবিনয়ে কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করা যায় : ১. দেশের মিডিয়ার পরিপূর্ণ স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ সরকারকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলে কোনো সংবাদক্ষেত্রে অযাচিত হস্তক্ষেপ না করা; ২. তথ্যমুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে 'তথ্য অধিকার আইন' (২০০৯) যথাযথভাবে অনুসরণ করা; ৩. সংসদ টেলিভিশন বন্ধ এবং বেতার-বিটিভির আয়তন সীমিত করে এ দুটিকে সম্পূর্ণভাবে সরকারি আওতায় নিয়ে আসা; ৪. সরকারের মালিকানায় একটি (ছোট আকারের) দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করা।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
scpcdu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.