দিল্লির বিদ্যুৎ বহুদূর by আরিফুজ্জামান তুহিন ও আরিফুর রহমান

এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন সময় ভারত থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল। তবে সরকারের সাড়ে চার বছর শেষেও দিল্লির বিদ্যুতের দেখা মেলেনি।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনার অবকাঠামো নির্মাণ ধীরগতিতে চলায় কবে নাগাদ বিদ্যুৎ আসবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেনি। আর ত্রিপুরার পালাটানা থেকে ১০০ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যে বাংলাদেশে আসছে না সেটা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে দুই দেশের বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে এক বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বিদ্যুৎসচিব মনোয়ার ইসলাম।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ৭০০ মেগাওয়াট তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পালাটানা থেকে যে ১০০ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসার কথা ছিল, তা আসছে না। কারণ হিসেবে ভারত বলছে, পালাটানার ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের পুরোটাই সেখানে প্রয়োজন। আগরতলা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে ওই প্রকল্প থেকে অন্তত ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে ত্রিপুরা সরকার দিতে চেয়েছিল।
অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির সর্বশেষ তারিখ ছিল চলতি জুলাই মাসে। তবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ না হওয়ায় এ বিদ্যুৎ চলতি সরকারের মেয়াদে আদৌ আসবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় বর্তমান সরকার। এ লক্ষ্যে ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে ভারত সরকার এবং কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বাংলাদেশ সরকার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। গত বছরের ডিসেম্বর নাগাদ এ বিদ্যুৎ আমদানি করার কথা ছিল। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও সঞ্চালন লাইন নির্মাণের মাত্র ৬১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সময়মতো কাজ শেষ না হলেও এ প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এ কারণে সরকারকে বাড়তি গুনতে হবে ৫০০ কোটি টাকা।
গত ১০ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির প্রকল্প নিয়ে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধিকে কমিশন অযৌক্তিক ও অকল্পনীয় বলেছে। প্রকল্পে গত দুই বছরে ব্যয় বেড়েছে ৫০১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড অব কম্পানি (পিজিসিবি) ডলারের মূল্য বৃদ্ধিকেই ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে বলছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, 'ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ' শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১০ সালের ১৭ আগস্ট একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। তখন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণের ৭০০ কোটি টাকা, সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২৭৭ কোটি টাকা এবং পিজিসিবির তহবিল থেকে ১০১ কোটি টাকায় ব্যয় নির্বাহের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১২ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় মেয়াদ সংশোধন করে প্রকল্পের বাকি কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কাজ যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে চলতি বছরে কাজ শেষ হওয়া সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, প্রকল্পের ৬১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ এ সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয়।
পিজিসিবি সূত্র জানায়, নতুন করে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অতিরিক্ত ৫০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। তবে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে পিজিসিবি আরো যে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে তা অযৌক্তিক। কমিশন সূত্র জানায়, ১১৩ একর নিচু জমি উঁচু করার জন্য প্রতি ঘন মিটারে ২২২ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এতে ভূমি উন্নয়ন বাবদ মূল পরিকল্পনায় বরাদ্দ করা ৫০ কোটি টাকার চেয়ে এক কোটি টাকা বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে। কমিশন বলছে, এ দর অযৌক্তিক। গড়াই নদী পুনঃ খননে প্রতি ঘন মিটারে খরচ হয়েছে ১৩২ টাকা। এ প্রকল্পে প্রতি ঘন মিটারে বড়জোর ১৫০ টাকা খরচ হতে পারে। কিন্তু পিজিসিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অনেক দূর থেকে মাটি সরবরাহ করার কারণে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন এ প্রকল্পে যেসব খাতে ব্যয় বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক ও অকল্পনীয় বলছে এসবের মধ্যে রয়েছে, নিরাপত্তা দেয়াল নির্মাণে মূল পরিকল্পনায় বরাদ্দ এক কোটি ৩১ লাখ টাকা বেড়ে বর্তমানে পাঁচ কোটি টাকা হওয়া। ভবন নির্মাণে মূল পরিকল্পনায় ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ কোটি টাকা। তা বেড়ে বর্তমানে হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। কাস্টম ডিউটি, ভ্যাট ও অন্যান্য খরচ বাবদ ধরা হয়েছিল ১০৯ কোটি টাকা, সংশোধিত প্রস্তাবে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৬ কোটি টাকা। মূল প্রকল্পে সঞ্চালন লাইন এবং সাবস্টেশন নির্মাণের জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহের খাতে বরাদ্দ ছিল ৪৭৮ কোটি টাকা। সংশোধিত প্রস্তাবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪৯ কোটি টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির এ প্রস্তাবে যৌক্তিক কারণ দেখাতে পিজিসিবিকে নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও অগ্রগতির বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিংয়ের জন্য সাত সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি করা হয়েছিল। পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কমিটির অন্যতম সদস্য। তবে এ কমিটি আজ পর্যন্ত কোনো বৈঠক করেনি। পরিকল্পনা কমিশনের মতে, স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক হলে যেকোনো সমস্যা ও অসংগতি দূর করা সম্ভব হতো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিজিসিবির এমডি জামাল উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যখন চুক্তি করা হয়েছিল তখন ডলারের দাম কম ছিল। পরে ডলারের দাম বেড়ে যায়। এ কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে।' 'স্টিয়ারিং কমিটির একটিও কেন বৈঠক করেননি'- এ প্রশ্নের জবাবে জামাল উল্লাহ বলেন, 'স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক করার কোনো দরকার নেই। এ কারণে বৈঠক করিনি।'
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির লক্ষ্যে ভারত সরকার নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কম্পানি (এনটিপিসি) ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মধ্যে চুক্তি হয় ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষরিত এ চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ ২৫০ মেগাওয়াট কিনবে এনটিপিসি থেকে আর বাকি ২৫০ মেগাওয়াট কিনবে ভারতের পাওয়ার পুল (বিদ্যুৎ বাজার) থেকে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ২ দশমিক ৮০ রুপি। এর সঙ্গে প্রতি ইউনিটের জন্য রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হিসেবে আরো ২০ পয়সা যোগ করা হবে। এতে গড়ে প্রতি ইউনিট দাম পড়বে প্রায় চার টাকা ৮০ পয়সা। মূল্য পরিশোধ করতে হবে মার্কিন ডলারে।

No comments

Powered by Blogger.