নীল ম্যাগপাই আর দুরন্ত চিতার রিকশা-বিহার by দিলওয়ার হাসান

ফেব্রুয়ারির এক ঝকঝকে বিকেলে রিকশায় শাহবাগের আজিজ মার্কেটে যাওয়ার পথে এক প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলকে দেখেছিল রউফুল কাদের। ওরা ছিল পাশের রিকশায়। বসে বসে বোরড হওয়ার বদলে পুরোনো দিনের একটা গান গাইছিল হাঁটুকে তবলা ভেবে টোকা দিতে দিতে: ‘মাঝে নদী বহে রে ওপারে তুমি রাধে, এপারে আমি।’ ডুয়েট গান। মিডসিক্সটিজে তপন সিনহার অতিথি ছবির জন্য উৎপলা সেন-সতীনাথ দম্পতি গেয়েছিলেন। কাদেরের সঙ্গে উৎপলার মতো কেউ না থাকায় তাকেই দুজনের গান গাইতে হচ্ছে। যৌবনে গানটা প্রিয় ছিল তার। শোনা হতো আকাশবাণী কলকাতার অনুরোধের আসর কিংবা ৭৮ আরপিএমএর গ্রামোফোন রেকর্ডে। প্রেমিক-প্রেমিকার রিকশাটা চালাচ্ছিলেন বুড়ো একজন মানুষ। তাঁর গায়ের জামাটা ঘন নীল রঙের। চোখে লাগে। ছোটবেলায় একবার নৌকায় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় এ রকম ঘন নীলের পাল দেখার কথা মনে আছে কাদেরের। নৌকার পাল সাধারণত হয় সাদা। ওই নৌকার পাল নীল কেন, কাদের জিজ্ঞেস করেছিল তার মাকে। তিনিও এর কারণ জানতেন না। বলেছিলেন, ‘মাঝিকে জিজ্ঞেস কর না।’ ছোটবেলায় কাদের ছিল খুব লাজুক প্রকৃতির। ফলে, মাঝিকে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। বুড়ো রিকশাওয়ালার নীল রঙের জামাটা দেখে খুব মজা পাচ্ছিল সে। প্রেমিক-প্রেমিকার রিকশা ছিল ওর বাঁ পাশে। হুড ওঠানো ছিল বলে তাদের চেহারা দেখা যাচ্ছিল না, দেখা যাচ্ছিল শুধু পা। অনুমান করেছিল, ওরা দুজনেই মাঝারি গড়নের মানুষ হবে। ছেলেটা পরেছিল নীল জিনসের প্যান্ট আর মেয়েটার পরনে ছিল টাইট সাদা ট্রাউজার। হঠাৎ মেয়েটার ডান পা ছেলেটার বাঁ পায়ের ওপর উঠে এল আর তাদের ডান ও বাঁ হাত জড়িয়ে নিল একে অপরকে।
তাদের চুম্বন দৃশ্য দেখা না গেলেও চুম্বনজনিত শব্দাবলি কাদেরের কানে ভেসে আসছিল। রিকশাটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল একটু পর পর। যানজটে আটকে পড়া রিকশার মুখগুলো সামনের দিকে থাকায় তাদের চুম্বন দৃশ্য কারও নজরে পড়ছিল না। কাদেরের ‘মাঝে নদী বহে রে’র গুনগুনানি নিমেষেই বন্ধ হয়ে গেল। সে দেখল, মেয়েটার পায়ের রং কালো, আঙুলগুলো লম্বা লম্বা, নখ কাটা হয়নি, ধুলোবালি জমে একসা। ছেলেটার জিনসের প্যান্ট পায়ের কাছে ছিঁড়ে গেছে, ঝুলে পড়েছে একটুখানি। প্যান্টের ওই দারিদ্র্য তাকে স্পর্শ করল; কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, আজকাল তো এসব ফ্যাশন। তবে তাদের পায়ের হাল কাদেরকে একটুখানি ডিপ্রেসড করল। কোথা থেকে আসছে এরা? কোনো জঙ্গল থেকে নয় তো? ধুলোবালি কিংবা কর্দমাক্ত দীর্ঘ কোনো পথ কি পাড়ি দিতে হয়েছে এদের? ততক্ষণে চুম্বনের ঝড় থেমেছে। মেয়েটা কোলে রাখা ব্যাগ থেকে একটা কোকের বোতল বের করে ঢকঢক করে খেল। বোতলটা এগিয়ে দিল ছেলেটার দিকে। ছেলেটাও খেল ঢকঢক করে। চুম্বনে ঠোঁট আর জিব শুকিয়ে যায়। ছেলেটা কোক খাওয়া শেষ করে বোতলটা মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিল। ও সেটা আবার ব্যাগের ভেতর চালান করে দিল। ব্যাগের ছোট্ট পকেট থেকে সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করে মেয়েটা একটা সিগারেট ধরাল ফস করে। আকছার মেয়েদের সিগারেট খেতে দেখা যায় না এ শহরে। ফলে, দৃশ্যটা কাদেরের চোখে লাগল একটুখানি। তবে মেয়েদের সিগারেট খেতে দেখলে কেন যেন ভালো লাগে তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এক আর্কিটেক্ট মেয়েকে সিগারেট খেতে দেখত। সাইকেল চালিয়ে আর্ট কলেজে আসত আড্ডা দিতে। ক্যারাতে জানত। প্রথম প্রথম ছেলেরা টিটকারি মারত। একটা ছেলে একদিন বাজি ধরে রগড় করতে গিয়েছিল ওর সঙ্গে।
লাথি মেরে বাঁ পা’টা ভেঙে দিয়েছিল। সেই থেকে ওকে আর কেউ ঘাঁটাত না। আড়ালে-আবডালে বলত—ওই আগুনমুখী আসছে। কাদেরের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বান্ধবীও নিয়মিত সিগারেট খেত। ওর নাম ছিল নীলিমা। শাড়ি পরত, কপালে টিপ দিত। চোখে থাকত কালো ফ্রেমের চশমা। খাঁটি বাঙালি টাইপের চেহারা; কিন্তু সিগারেট খেত একেবারে পুরুষালি ধাঁচে। ভুসুক ভুসুক টান দিত আর নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করত। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর ধূমপানের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করত সে। একদিন ওর আধখাওয়া একটা সিগারেট চেয়েছিল কাদের। অবাক হয়ে গিয়েছিল নীলিমা। বলেছিল, ‘আধখাওয়া কেন, আস্ত একটা নাও।’ কিন্তু সে আধ খাওয়াটাই নিয়েছিল—সিগারেটের মাধ্যমে ওর ঠোঁটের ছোঁয়া নিতে। নীলিমা একটু দ্বিধা করে সিগারেটটা ওর হাতে দিয়েছিল আর অস্বস্তি নিয়ে হেসেছিল একটু। নীলিমার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় না দীর্ঘদিন। কোথায় আছে তা-ও জানে না কাদের। মেয়েটা আধখাওয়া সিগারেটটা ছেলেটার দিকে এগিয়ে দেয়, আর সে ওটা নিয়ে ভুস ভুস করে টানতে থাকে। গলগলে ধোঁয়ার একটা রিং সে ছুড়ে দিলে তা রিকশাওয়ালার চোখ-মুখ-নাক ভাসিয়ে দেয়। ছেলেটার দিকে বোকা বোকা চোখে তাকায় সে। ‘কী চাচা মিয়া, খাইবেন নাকি একটা?’ এই কথা বলে একটা সিগারেট বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দেয়। একটু লজ্জা পায় সে, তারপর হাতটা ছেলেটার দিকে প্রসারিত করে। একটু পরে সে-ও ধোঁয়ার রিং বানায়। গলায় তীব্র একটা ব্যথা নিয়ে বছর দশেক আগে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল কাদের। ডাক্তার পরীক্ষাটরীক্ষা করে ওষুধ লিখে দিয়েছিল। আসার সময় বলেছিল—সিগারেট কিন্তু একদম বারণ।
সেই থেকে আর সিগারেট খায় না, গন্ধ শুঁকলেও তার গা গুলায়। কাদের জ্যামে আটকা পড়ে আছে বিশ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে যুবক-যুবতীকে একটা কথাও বলতে শোনেনি। পাশাপাশি বসে থেকে এতক্ষণ কথা না বলে কি পারে ওরা? কেবল বুড়োদের পক্ষেই সম্ভব তা। কেননা, সারা জীবন এত কথা তারা বলে যে শেষ বয়সে এসে কথা ফুরিয়ে যায়। তরুণেরা বয়সের কারণেই অধৈর্য, তারা নীরব থাকতে পারে না; যদিও নৈঃশব্দ্য খাঁটি ও পবিত্র। শব্দহীনতা নাকি মানুষকে আরও কাছে টানে। যারা একে অপরের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত, তারাই কেবল কথা না বলে থাকতে পারে—এ এক মহা কূটাভাস কিংবা প্রহেলিকা। আচ্ছা, ওই যুবক কি ভালোবাসে যুবতীকে? আর যুবতী যুবককে? নাকি কিছুদিন পরে ছেড়ে যাবে একে অপরকে। যুবক অন্য এক যুবতীর প্রেমে পড়বে, যুবতী অন্য এক যুবকের! অতঃপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেবে, রিকশায় বা পার্কে বসে চুমু খাবে, মোবাইল ফোনে কথা বলবে দীর্ঘক্ষণ? ওই পড়ন্ত বিকেলে, ওইখানে, রাস্তার ওপর স্বল্পকালীন যে নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছিল, ভেঙে গেল তা—ফায়ার ব্রিগেডের একটা গাড়ি সাইরেনের তীব্র শব্দ তুলে পাশের রাস্তা দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। কোথাও কি আগুন লেগেছে? কারা পুড়ে মরছে? নাকি দুর্ঘটনা ঘটেছে, বাসে-ট্রেনে সংঘর্ষ, নাকি বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা? পকেটে মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। আজিজ মার্কেট থেকে বন্ধু জানতে চাইছে, সে এখন কোথায়, আসতে কতক্ষণ লাগবে। সে যেন কাঁটাবনের দিক দিয়ে ঢোকে, অন্যদিকে প্রচণ্ড ভিড়; স্রোতের মতো মানুষ শাহবাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে...। কাদের আকাশের দিকে তাকায়। বিকেলে আকাশ নীল থাকে। চাঁদ উঠলে আকাশের রং কালচে হয়ে যায়। গুমোট থাকলে ওই রং হয় ধূসর।
সূর্য উঠলে আকাশ কমলা রং ধারণ করে। রংধনু উঠলে আকাশের গায়ে সাত রং পাওয়া যায়। তবে আকাশের রং কেন নীল হয়, খুব কম লোকই জানে। কাদেরও জানে না। যুবক-যুবতীর পায়ের দিকে আবার তার চোখ যায়। মেয়েটার পা দেখে মনে হয়, দেখতে সে ভালো হবে না। যুবকের চেহারাও যদি হয় খারাপ, তাহলে ভালো লাগবে না কাদেরের। ওই মুহূর্তে আপাদমস্তক ওদের দুজনকে দেখতে ইচ্ছে হয় তার। তা কি সম্ভব? জট ছাড়লে ওদের রিকশা দ্রুত এগিয়ে যাবে—ধীরে ধীরে চলে যাবে দৃষ্টির বাইরে। আর দেখা হবে না ওদের। পেছনের রিকশার চাকা ওরটার গায়ে এসে ঠেকে। তারপর সব রিকশাই এগোতে থাকে—ধীরে ধীরে। সামনে একটা ট্রাফিক সিগন্যাল। লাল বাতি জ্বলছে। রিকশা থামে। শীত চলে যাচ্ছে—যাওয়ার আগে একটুখানি কাঁপন লাগিয়ে দিচ্ছে। ওদের রিকশা থেকে যুবতী চেঁচিয়ে ওঠে, হুড নামিয়ে দাও, কী চমৎকার বাতাস! এলোমেলো ধূসর চোখের লম্বা কৃশ একটা মেয়ে। স্ট্রেট চুল। বাতাসে উড়ছে—গায়ের রং ফরসা। কিন্তু পাগুলো কালো কেন? ধুলো-কাদার জন্য বোধ হয়। যুবকটি বেশ লম্বা। সুন্দর করে ছাঁটা চুল। বড় জুলফি।
শ্যামলা। বেশ পুরুষালি চেহারা। গায়ের টি-শার্ট আকাশি রঙের। হাসি হাসি মুখ। যুবতীর হাতের ওপর হাত দিয়ে রেখেছে। লেখক ডোনাল্ড বারথিলমির নারী প্রোটাগনিস্ট ফিসফিস করে কাদেরের কানে কানে বলছে: ডিয়ার রুপের্ট, আই লাভ ইউ এভরি ডে, আই অ্যাডোর ইউ, আই অ্যাম ক্রেজি অ্যাবাউট ইউ...। ঠান্ডা বাতাসে কাদেরের চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে। স্বপ্নের ভেতর কে যেন বলে, ওই যে মেয়েটাকে দেখছ, ওর নাম রুচিরা। ও ছিল একটা নীল ম্যাগপাই। ওর লেজটা ছিল খুব লম্বা। বনের গাছগাছালির ফল খেত। অন্য পাখিদের বাসা থেকে চুরি করে খেত ডিম। সারা দিন বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াত। আর ওই যে তরতাজা যুবক, ওর নাম নঈম। ও ছিল একটা দুরন্ত চিতা। মনের সুখে ঘুরে বেড়াত বনে, নিরীহ প্রাণীদের তাড়া করত। ছোট ছোট হরিণ ধরে খেয়ে ফেলত। নীল ম্যাগপাই ওপর থেকে চিতাকে দেখে মুগ্ধ। নিচ থেকে চিতাও ম্যাগপাইকে দেখে গলে গেল। একে অপরের প্রেমে পড়ল তারা—ভালোবাসা হচ্ছে একটা ইমপসিবল মিটিং—অসম্ভব সাক্ষাৎ।... ঘুম ছুটে গেলে কাদের দেখল, ওদের রিকশাটা চলে গেছে—ওরটাও দ্রুত বেগে ছুটে চলেছে।

No comments

Powered by Blogger.