সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-কী শিক্ষা নেবে আওয়ামী লীগ? by হারুন হাবীব

গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড, উত্তেজনা স্বাভাবিক ঘটনা। এতে সমাজ প্রভাবিত হয়। কিন্তু রাজনীতির এসব উত্তেজনা শান্ত মাথায় দেখা ভালো। এতে সাধারণ জনজীবন রাজনীতির তাপে মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণাবিদ্ধ হয় না।
দুর্ভাগের বিষয় যে, আমাদের দেশে সে সংস্কৃতি স্থায়িত্ব পায়নি। ফলে ন্যায্য-অন্যায্য রাজনীতির উত্তাপ প্রতিনিয়তই সমাজকে দগ্ধ করে। আরও দুর্ভাগ্যজনক যে, দলীয় রাজনীতির নামে মানুষকে ক্রমশই বিভক্ত করা হচ্ছে, আদর্শিক প্রতিপক্ষ হওয়ার চেয়ে এক মানুষ অন্য মানুষের শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। এ সংস্কৃতি মঙ্গলজনকও নয়।
সম্প্রতি দেশে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। অনেক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছিল এসব নির্বাচন নিয়ে। কী হয় শেষ পর্যন্ত? সরকার কি ভোট চুরি করে, বিরোধী দল কি নির্বাচন বর্জন করে, নাকি ব্যাপক সহিংসতা ঘটে? কিন্তু ভোটপর্ব এবং পরবর্তী পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থেকেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্যভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে বিপুল ভোটে সরকারি জোটের প্রার্থীরা বিরোধী দলের প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়েছেন। অর্থাৎ শহরকেন্দ্রিক যে ভোটাররা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটকে বিপুলভাবে বিজয়ী করেছিল, তারাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তবে এসব নির্বাচনের একটি ভালো দিক হলো, সব জায়গাতেই বিজয়ীরা পরাজিতদের সঙ্গে দেখা করেছেন, কুশল বিনিময় করেছেন। পরাজিতরাও হাসিমুখে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন নবনির্বাচিতদের। গণতান্ত্রিক সভ্যতায় এ সংস্কৃতিই কাম্য। কারণ, রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ শত্রু বিবেচিত হয় না, হয় কেবলই প্রতিদ্বন্দ্বী।
রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটের পর রাজধানী উপকণ্ঠে দেশের বৃহত্তম গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে মানুষ সীমাহীন উৎসুকে ছিলেন। চারটিতে হারার পর এবার কি ক্ষমতাসীনরা জিতবে? উত্তেজনা ছিল প্রচুর। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো মূলত স্থানীয় ইস্যু অর্থাৎ এলাকার নাগরিক সুখ-সুবিধার ওপর হওয়ার কথা। কিন্তু দু'পক্ষই সিটি নির্বাচনগুলোকে অতিমাত্রায় রাজনীতিবিদ্ধ করেছে। সঙ্গত কারণেই গাজীপুরের নির্বাচনে দেশের বেশিরভাগ মানুষ আগামী জাতীয় নির্বাচনের ছায়া দেখার চেষ্টা করেছে। স্থানীয় সরকারের ভোট জাতীয় নির্বাচনে ছায়া ফেলতে পারে কি-না, পারলেও কতটা পারে, এ বিতর্ক থাকলেও একেবারে যে পারে না এমনটাও ভাবা ঠিক নয়। কাজেই সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়াবাড়ি কিছু নয়।
মাত্র আগের মাসে হয়ে গেছে চারটি বড় সিটি নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা এসব ভোটে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছেন। এ প্রেক্ষাপটে গাজীপুর হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। অন্তত একটিতে জিতে মান বাঁচানো যায় কি-না সে চেষ্টাই করেছিল দলটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মান বাঁচানো যায়নি। সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে জনসমর্থনে যথেষ্টই যে ভাটা পড়েছে, তা আর তর্ক করে বোঝাবার দরকার পড়ে না। এদিকে ফলাফলের পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক সহযোগীরা ব্যাপকভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। মিত্রদের নিয়ে তারা সামনে সরকার গঠন করবে, এমনটাই মনে করছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে দল বা জোটকে ভোট দেবে তারাই সরকার গঠন করবে। এই গণতান্ত্রিক ধারার প্রতি শ্রদ্ধা না রাখার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনগুলো ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলেও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংকট কাটেনি। জাতীয় সংসদের ভোট হবে বছরের শেষে। অথচ নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে ধুয়াশা এখনও কাটেনি। প্রশ্ন রয়েই গেছে, আদৌ কি দু'পক্ষ সমঝোতায় পেঁৗছতে পারবে, নাকি সংঘাতের পথে হাঁটবে ? আরও প্রশ্ন, যদি সমঝোতা না হয় তাহলে কী হবে? কোন পথে এগোবে দেশ?
আমার বিশ্বাস, নির্বাচন কমিশন ভোটারদের অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছে পাঁচ সিটি করপোরেশনের সুষ্ঠু ভোটপর্ব সম্পন্ন করে। এটা নির্বাচন কমিশনের একটি বড় কৃতিত্ব, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় এক ধাপ অগ্রগতি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির এই সাফল্য জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারেও দেশবাসীকে আস্থাশীল করবে, এই আশাই করি।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গাজীপুরের নির্বাচনকে সরকার ও বিরোধী দলের জনসমর্থনের 'ব্যারোমিটার' হিসেবে দেখেছেন দেশের বেশিরভাগ মানুষ। এর একটিই কারণ। জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শিবিরের দুই বড় দলই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এ নির্বাচনে। জাতীয় নির্বাচনে যা ঘটে তেমনটাই ঘটেছে গাজীপুরে। নির্বাচনে ধর্মকেন্দ্রিক প্রচারণা ব্যাপকভাবে হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম যৌথভাবে এ প্রচারণায় অংশ নিয়েছে। পাকিস্তানের মতো দেশে যেখানে ধর্ম নিয়ে নির্বাচনী প্রচার বন্ধ করা হয়েছে, বাংলাদেশ তা পারেনি! সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ধর্মের এই রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে রাজনীতিবিদদের অবশ্যই ভাবতে হবে।
সরকারি দলের পরাজয়ের নানা কারণ খুঁজে দেখছেন পত্রপত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদক, রাজনৈতিক বিশেষক এবং পরাজিত দল। কেউ কেউ বলছেন, এ হার ছিল 'অভাবনীয়'। আমি ঠিক সেভাবে দেখতে চাইনি। জয়ী হওয়ার স্বপ্ন থাকে সবারই। কিন্তু সঙ্গত প্রস্তুতি ছাড়া জয়ী হওয়া যে অলীক কল্পনামাত্র, তা আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলের নিশ্চয়ই জানা থাকার কথা। এরপরও বলি, সিটি করপোরেশনের ধারাবাহিক পরাজয়ের কারণগুলো আওয়ামী লীগ ও তার রাজনৈতিক মিত্রদের জরুরি ভিত্তিতে অনুসন্ধান করা উচিত হবে। দল ও জোটকে যদি 'সেলভেজ' করা সম্ভব হয় তো ভালো, না হলে অন্তত কিছুটা 'ডেমেজ কন্ট্রোল' করা যায় কি-না সেটাই ভাবা উচিত। আর তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে আগামী পার্লামেন্টে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই বিরোধী দলের চেয়ারে বসতে হবে।
কথাগুলো বলি হয়তো সঙ্গত কারণেই। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী প্রবীণতম এবং প্রধান রাজনৈতিক দল। অনেক গৌরবের ঐতিহ্য আছে এর। আছে অনেক সংকট, সীমাবদ্ধতাও। সবার মন রক্ষা করে চলাও সম্ভব হয় না। এরপরও এই দলটি আজও একাত্তরের জাতীয় চেতনার মশাল বহনকারী মূল রাজনৈতিক শক্তি। সত্যিটি কেউই হয়তো অস্বীকার করবেন না। কাজেই এমন একটি দলের নির্বাচনী পরাজয়ে তাবৎ মুক্তিযুদ্ধপন্থি মহলে হতাশা আসবেই। বহু লোকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তারা সরকার পরিচালনার নানা ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর। কিন্তু বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের বিজয়ে উল্লসিত হননি, বরং তারা শঙ্কিত হয়েছেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়েছেন। নানা ব্যর্থতা ও আশাহতের পরও আওয়ামী লীগের মতো দলের কাছে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনেক প্রত্যাশা । এই মানুষগুলো ব্যক্তিগতভাবে কিছুই চায় না, শুধু চায় তাদের রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চলুক, সুশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হোক। হয়তো সে কারণেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হারলে গোটা মুক্তিযুদ্ধপন্থি শক্তি হেরে যায়, হতাশায় ডোবে। আবার এ অভিযোগটিও পুরোটা অস্বীকার করা যাবে না যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে দল বা দলের একটি অংশই কেবল ক্ষমতাসীন হয়; অবহেলিত, উপেক্ষিত হয় ত্যাগী মানুষরা, শুরু হয় আরেক হতাশা।
ব্যক্তিগত জীবনে কখনও কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী হওয়া সম্ভব হয়নি আমার। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, দলমত যাই থাক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক, অগ্রসর সমাজচিন্তার বোধ ধারণ করেই বাংলাদেশকে গড়ে উঠতে হবে। ধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রভাববলয় থেকে সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে, নারী জাগরণ ঘটাতে হবে, অন্ধকার থেকে আলোতে নিতে হবে দুর্ভাগা এই সমাজকে।
গত সাড়ে চার বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন সাধন করেছে। কিন্তু সেগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। এ ব্যর্থতার দায় তো নিতেই হবে। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর অপপ্রচারের যোগ্য জবাব দিতে পারেনি তারা। আত্মতুষ্টি এবং আত্মবিশ্বাস তাদের এমনভাবে পেয়ে বসেছিল, যা কখনও কখনও আত্মসংহারক হয়। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের ব্যর্থতার দিকগুলোই দাগ কেটেছে বেশি। তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন নাগরিক সমস্যার সমাধানে খুব একটা সফলতা দেখাতে পারেনি সরকার। পাশাপাশি পুঁজি বাজার ও পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ এবং এ আমলে ঘটা রেলওয়ে, হলমার্ক ইত্যাদি কেলেঙ্কারি সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। হয়তো এটিও সত্যি যে, এসব সমালোচনার বাইরেও গাজীপুর ও চার সিটি নির্বাচনে পরাজয়ের প্রধান কারণ দলের ভেতরের সমস্যা।
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সরকারে গেলেই দল গৌণ হয়ে পড়ে, থাকে কেবল সরকার। এতে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। কোন্দল বা বিভেদ সব বড় দলেই থাকে। কিন্তু গাজীপুর নির্বাচনে কোন্দল ও বিভেদ কাজ করেছে ছাইচাপা আগুনের মতো। অন্যদিকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজির বহুল প্রচারিত ঘটনাগুলোকে যেভাবেই ঢাকবার চেষ্টা হোক না কেন এতে সাধারণ মানুষের মন তুষ্ট হয়নি। হলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত।
অনেকেই বলেছেন, নির্বাচনগুলোতে হেফাজত ইস্যু, জামায়াত-শিবিরের টাকার জোয়ার ও মিথ্যা প্রচারণার বিষয়গুলো কাজ করেছে। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, অপপ্রচার হবে না সেটাই কি আওয়ামী লীগ ধরে নিয়েছিল? মোটকথা, অপপ্রচার ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ক্ষমতাসীনরা। আরও একটি বিষয় : আওয়ামী লীগকে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে সিভিল সোসাইটির একটি
বড় অংশ কেন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এসব কারণ অনুসন্ধান
জরুরি।
পরাজয়ের কারণ নিয়ে দলের ভেতরে বিশ্লেষণ চলছে শুনেছি। ভুল সংশোধন করা হবে বলেও বলা হচ্ছে। যদি হয় তাহলে আগামী নির্বাচনে নিশ্চয়ই তার প্রভাব পড়বে। তবে কাজটি সহজ নয় বলেই আপাত মনে হয়। পরাজয় থেকে শিক্ষা নিতে হয়, নতুন করে বিজয়ের জন্য। সে শিক্ষা কি নেবে আওয়ামী লীগ?



লেখক ও সাংবাদিক
hh1971@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.