কোটা, যুদ্ধাপরাধ বনাম শাহবাগ রাজনীতি by অনুপম দেব কানুনজ্ঞ

শাহবাগ। সারা বাংলাদেশ তো বটেই, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ বিভূঁইয়েও এখন এক সুপরিচিত নাম। রাজধানী ঢাকার অন্যসব মোড়ের মতো ‘তীব্র যানজটের এক মোড়’
-এই পরিচয় ছাপিয়ে শাহবাগ অনন্য রূপ ধারণ করে গত ৫ ফেব্রুয়ারি।

যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের রায় প্রত্যাখ্যান করে ওইদিন শ’খানেক তরুণ-তরুণী নেমে আসে রাস্তায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা পরিণত হয় শত শত মানুষের বিক্ষোভে। রাত পোহানোর পর হাজার, এবং দুই দিন পরেই তা পরিণত হয় সহস্রাব্দের অন্যতম বড় সমাবেশে।

‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’, ছোট্ট অথচ ভয়ংকর শক্তিশালী এই শ্লোগান বুকে নিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশে নানা বয়স-শ্রেণি-পেশার এতো মানুষ জড়ো হয় যে, এর অর্ধেক মানুষ এলেও যে কোন রাজনৈতিক দল নিজেদের ধন্য মনে করতো।

যে তরুণরা জ্ঞান হওয়ার পর থেকে রাজনীতিকে অন্তর থেকে ঘৃণা করতে শিখেছে, তারাও দলে দলে যোগ দেয় শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে। কানে দুল, আর হাতে চুড়ি-ব্রেসলেট পড়া, সারাদিন রক আর হেভি মেটাল শোনা তরুণরাও প্রমাণ দিলো, দেশের প্রশ্নে আপোস করবে না তারাও।

প্রথম কয়েকদিন রাজনৈতিক প্রভাব না থাকলেও খুব দ্রুতই পালটে যায় এই দৃশ্যপট। যখনই নেতারা বুঝতে পারেন, এই তরুণদের দখলে আনতে পারলে বিরাট শক্তি পকেটে পোরা যাবে, তখন থেকেই শুরু হয় সমর্থনের খেলা। যে সরকারের আপোসকামিতা সন্দেহ করে তরুণেরা শ্লোগান দিয়েছিলো প্রথম দিন, সেই আওয়ামী লীগই হয়ে উঠলো গণজাগরণের সবচেয়ে বড় সমর্থক।

কিন্তু তাতে পোষাচ্ছিলো না ছাত্রলীগের। যখন দেখা গেলো ‘আন্দোলন সংগঠিত করার চেয়ে মাইকের দখল নেওয়ায় বেশি ব্যস্ত’ বিভিন্ন বাম দলের ছাত্র নেতারা মাইকের দখল ছাড়ছেই না, তখন থেকে মরিয়া হয়ে ওঠেন এই সংগঠনের দুই শীর্ষ নেতা। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের পাশে না থাকলে যেনো তাদের উপস্থিতি ম্লান হয়ে যাচ্ছিলো।

গণজাগরণ মঞ্চের এমন ধীরগতির রাজনীতিকরণ মেনে নিতে পারেনি অনেক তরুণই। পাশাপাশি মুখপাত্র হয়ে ওঠা ইমরান এইচ সরকারের আওয়ামী ব্যাকগ্রাউন্ডও স্বভাবতই প্রশ্ন জাগায় সবার মনে। আর এই সুযোগটাই লুফে নেয় বিএনপি-জামায়াত যুগলবন্দি। রাস্তায় নামে হেফাজত। সফলভাবে ভুল বোঝায় গ্রাম-গঞ্জের লাখো মানুষকে- যারা, গণজাগরণ আর প্রজন্মের মতো শব্দের অর্থই ঠিকঠাক জানে না।

এরপর থেকে আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে আন্দোলন- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া, মানুষের কাছে সঠিক  জিনিস তুলে ধরা থেকে সরে গিয়ে যেন নিজেদের ধার্মিক প্রমাণেই বেশি ব্যস্ত হয়েছে। অন্যদিকে ‘এবার হয়তো কিছু হবে’- ভেবে, নিজেদের খোলস ভেঙে রাস্তায় নেমে শ্লোগান দেওয়া হাজার হাজার রাজনীতিবিমুখ তরুণ-তরুণী দিলে নিদারুণ চোট পেয়ে আরো কঠিন খোলসে আবদ্ধ করেছে নিজেদের।

ভোটের রাজনীতি করা দলগুলো, প্রতি নির্বাচনে যে ৩০%-৪০% ভোট না দেওয়া থেকে যায়, আপনারা হিসেব করেই নিতে পারেন, এই চোট পাওয়া তরুণরাও সেই অংকে নিজেদের যোগ করলো।

কিন্তু এতো কিছুর পরও কিছু ছেলে-মেয়ে এখনও হাল ছাড়েনি। মাঝে-মাঝেই দেখা যায় ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে শাহবাগে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদী আয়োজন করছে বিভিন্ন গ্রুপ। নানা হতাশার মধ্যেও আশার আলো জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করছে একেবারেই হাতে গোণা কিছু মানুষ।

এতোদিন পর শাহবাগের গণজাগরণ নিয়ে লেখার একটা অন্য উদ্দেশ্য আছে। আর তা হলো হঠা‍ৎ শুনে চমকে ওঠা একটা নাম—‘মেধাবী চত্বর’। কোন একটা টেলিভিশনে শুনলাম, শাহবাগে বিসিএস-এ কোটা পদ্ধতি বাতিল চেয়ে আন্দোলনরতরা শাহবাগ-এর নাম দিয়েছে ‘মেধাবী চত্বর’। ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ কোটার বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও শ্লোগান উঠেছে।

বিসিএস-এ কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের কি অন্য উদ্দেশ্য আছে? তারা কি কোন বিশেষ পক্ষের হয়ে মাঠে নেমেছে? আমার মোটেও তা মনে হয় না। কিন্তু শাহবাগে একবার ঘটে যাওয়া রাজনীতি কি বিসিএস পরীক্ষায় কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করা নিরীহ ছাত্রদের জানা আছে? স্পষ্টতঃই নেই। কেন যেনো মনে হচ্ছে, এখানেই যুদ্ধাপরাধের দাবিতে আন্দোলনের রাজনীতিকরণের প্রক্রিয়ারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে, তবে এবার একেবারেই অন্য হাতে।

প্রথমেই একটা চিন্তা এলো। প্রজন্ম কি মেধাবী নয়? শাহবাগ যেখানে প্রজন্ম নাম নিয়ে ধনী-গরীব, ছাত্র-শিক্ষক, নারী-পুরুষ সবাইকে আপন করে নিয়েছিলো, সেখানে মেধাবী চত্বর নামে একে সংকীর্ণ করছে কারা? কি উদ্দেশ্যে? গণজাগরণ কাদের মুখে কালিমালেপন করেছে? প্রজন্ম চত্বর নাম মুছে দিতে পারলে কারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়? মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবি তোলার মাধ্যমে মেধাবী তরুণদের মনে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে বিষ বপণ করতে পারলে কার গোলায় ধান ওঠে?

উত্তরটা সবারই জানা। কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে সার্বিক না হলেও আংশিক সমর্থন আমারও আছে। তবে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ, যেমন আদিবাসী নারী, গরীব মেধাবীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোটা ব্যবস্থা বলবত রাখার পক্ষেই আমার মত।

কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে, এই ন্যায্য ক্ষোভ, রাগ কাজে লাগিয়ে কোন মহল যেন নিজেদের অন্যায্য ফায়দা হাসিল করতে না পারে। এই আন্দোলনকারীদেরই কেউ কেউ হয়তো একদিন ম্যাজিস্ট্রেট হবেন, পুলিশ অফিসার হবেন। তাই দেশের ভাগ্য অনেকটাই আন্দোলনকারী তরুণদের ওপরও নির্ভরশীল। তাই ভবিষ্যতের কথা মনে করেই বলতে চাই……সাধু সাবধান!!!

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ: ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, anupamdkan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.