বোরহেস ও আক্ষরিক অনুবাদের সৌন্দর্য \ দ্বিতীয় পর্ব by মাসরুর আরেফিন

দুই সপ্তাহ আগে এ লেখার প্রথম পর্বে বিশদ করতে চেয়েছিলাম আক্ষরিক অনুবাদ প্রসঙ্গে বোরহেসের চিন্তাভাবনা। হোর্হে লুইস বোরহেস, বিশ শতকের বিশ্ব সাহিত্যের প্রধান তিন স্তম্ভের একটি [অন্য দু'জন ফ্রানৎস কাফকা ও জেমস জয়েস], সাহিত্যে অনুবাদের ক্ষেত্রে 'আক্ষরিক' অনুবাদকেই বেশি পছন্দ করতেন।
সৃজনশীল ভাবানুবাদ বা খানিক স্বাধীনতা নিয়ে করা সহজপাঠ্য অনুবাদ কিংবা মূলের চেয়ে বেশি অভিঘাত নিয়ে আসা শব্দচয়ন [diction]_ এসব ফেলে রেখে বোরহেস বরং মনে করতেন যে, আক্ষরিকতার সৌন্দর্যই অনুবাদের মূল সৌন্দর্য; যতখানি পারা যায় আক্ষরিক থেকেও কীভাবে অনুবাদকে সুন্দর-পাঠযোগ্য-নির্ভার করা যায়, তা-ই হওয়া উচিত অনুবাদকের মূল চ্যালেঞ্জের জায়গা।
তো, দু'সপ্তাহ আগে ছাপা হওয়া পর্বে বোরহেসের এই অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যে তিনটি উদাহরণ টেনে এনেছিলাম তারই প্রবন্ধWord-Music & Translation-এর বরাত দিয়ে [সূত্র বোরহেসের হার্ভার্ড লেকচার সংকলন গ্রন্থ‘This Craft of Verse ], তাতে জানি না পাঠক ধরতে পেরেছিলেন কি-না যে, তিন ক্ষেত্রেই বোরহেস আক্ষরিকতার বাইরের যে অনুবাদ, তারই প্রশংসা করে বসেছেন। অ্যাংলো-স্যাক্সন একটি কবিতার লাইন :The sun at morning time থকে লর্ড আলফ্রেড টেনিসন ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন এভাবে :Sun Star of morning tid । বোরহেসের তা ভালো লেগেছিল, কারণ তার মতে, টেনিসন সৃষ্টি করেছিলেন চমৎকার এক যুগ্ম শব্দSun star [সূর্য-তারকা], এবং tide ' লিখে টেনিসন এমন এক ইমেজ সৃষ্টি করেছিলেন যে, মনে হচ্ছে ভোরের আলো এক জোয়ারের মতো যেন আকাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে। এটা কোনোভাবেই আক্ষরিক অনুবাদ নয়_ সূর্যকে 'সূর্য-তারকা' বলা, কিংবা ভোরের সময়কে আলোর 'জোয়ার' হিসেবে ফুটিয়ে তোলা। কিন্তু বোরহেস তাতে মুগ্ধ! দ্বিতীয় উদাহরণটি ছিল হিস্পানি কবি হুয়ান দে লা ত্রুক্রস-এর একটি কবিতা থেকে নেওয়া, যার শেষ লাইনটি আক্ষরিক অর্থে ইংরেজি করলে দাঁড়ায় এমন :When my house was quiet ; এর বিপরীতে বোরহেসের পছন্দ হয়েছিল রয় ক্যাম্পবেলের অনূদিত লাইন :When all the house was hushed । মোটেই আক্ষরিক নন রয় ক্যাম্পবেল_ তিনি ্my house কে করলেনll the house’ । কিন্তু তাতে কী? বোরহেসের ভালো লাগল এই ্‘hush শব্দের ঝংকার, যার মধ্যে তিনি পেলেন 'বিরাটত্বের বোধ' ও একটি 'স্থানিক সৌন্দর্য' এবং শেষ শব্দ ্তুযঁংয্থ-এর যে হিসহিস ধ্বনিমাধুর্য, তাতে চমৎকৃত হলেন তিনি। তার তৃতীয় উদাহরণটি ছিল লাতিন এক বিখ্যাত প্রবচনের :‘Ars longa, vita brevis , যার আক্ষরিক ইংরেজিArt is long, life is short’। কিন্তু বোরহেসের ভালো লাগলো জিওফ্রে চসারের অনুবাদ :The life so short, the craft so long to learn । বোরহেস বলছেন, এখানে দুইবার 'ংড়' শব্দটি এনে চসার পুরো বিষয়টিকেই নিয়ে গেছেন অন্য মহিমায়_ তার মনে হলো জীবন যে ছোট আর বিপরীতে শিল্প যে বিশাল, এই দুটোর মধ্যকার দৈর্ঘ্যের অবিতর্কিত ফারাকটা যেন মাপা যাচ্ছে চসারের এই দুই 'ংড়' শব্দের ধ্বনির অভিঘাতে।
তাহলে দাঁড়ালটা কী? তিন উদাহরণেই তো বরং উল্টোটা দেখা যাচ্ছে_ বোরহেস তো আক্ষরিক নয়, এমন সব অনুবাদকেই ভালো বলতে লাগলেন এখানে! এ পর্যায়ে এসেই শুরু করছি এবারের পর্ব, সেই একই ্Word-Music & Translation প্রবন্ধ থেকে বোরহেসের কথাগুলো ধার করে।
বোরহেস বলছেন, আমরা যখন কোনো ভালো অনুবাদ পড়ি, তখন কতই না ভালো হতো যদি আমরা না জানতাম যে কোনটা মূল আর কোনটা অনুবাদ। তখন দেখা যেত অনেক সময়েই আমাদের যেটা বেশি ভালো লাগছে সেটা মূল নয়, বরং মূলের ভাষান্তর। কোনটা বেশি ভালো কাজ, সে বিচারটা তখন অনেক নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে করা যেত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে তা সম্ভব নয়_ অনুবাদকের কাজ সব সময়ই মূলের নিচে; মূলকে ছাপিয়ে অনুবাদ যদি বেশি ভালো হয়ে যায় তাহলে তা আর 'অনুবাদ'ই থাকে না, হয়ে যায় সৃজনশীল নতুন সাহিত্য। তো, বিচারের বিষয় যখন অনুবাদ, তখন এমন অনুবাদ নিয়ে বলার আর কীই বা থাকে, যা কি-না মূলের চেয়েও সুন্দর, অর্থাৎ অন্য অর্থে, যা কি-না আর অনুবাদই থাকছে না?
এমন এক ঘোর-লাগা মহা সত্যি কথার অবতারণা করে এবার বোরহেস খাতা খুলে বসলেন আক্ষরিক অনুবাদের সমস্যার The problem of literal transtation]। 'আক্ষরিক' শব্দটা এখানে নিজেই একটি মেটাফর [রূপকালংকার], আর বিস্তৃত সেই মেটাফরের পরিধি কারণ, বোরহেস বলছেন, কোনো অনুবাদ যদি তার মূলের এক একটা করে শব্দের অনুবাদে সৎ না হয়, তাহলে অক্ষরে অক্ষরে সৎ হওয়ার তো প্রশ্নই আস না। অর্থাৎ সে বিচারে, আমরা 'আক্ষরিক' শব্দটিকে এখানে সততার মেটাফর হিসেবেই দেখি।
যা হোক, ঊনবিংশ শতাব্দীতে গ্রিক শাস্ত্রে পণ্ডিত ফ্রান্সিস উইলিয়াম নিউম্যান [১৮০৫-১৮৯৭] হোমারের 'ইলিয়াড' মহাকাব্যের আক্ষরিক অনুবাদ করার প্রয়াস নিলেন। সম্ভবত তিনি চাইছিলেন আলেকজান্ডার পোপের বিখ্যাত 'ইলিয়াড'-এর একটা উচিত জবাব দিতে। পাঠক সম্ভবত জানেন, পোপ তার 'ইলিয়াড'-এ এত অপরিসীম স্বাধীনতা নিয়ে একে এত সুন্দর এক ইংরেজি মহাকাব্য বানিয়ে ছেড়েছেন যে, তার মধ্যে আর কোনো হোমারই থাকেনি শেষমেশ। অনাক্ষরিক অনুবাদের এই শীর্ষবিন্দু পোপের উল্টো দিকে নিউম্যান চাইলেন অন্যদিকটার, অর্থাৎ আক্ষরিক অনুবাদের, শীর্ষবিন্দু ছুঁতে; তিনি ইংরেজিতে লিখলেন :wet waves, কিংবাwine-dark sea। আমি নিজেই যেহেতু এখন বাংলায় 'ইলিয়াড' অনুবাদ করছি, তাই আমি আপনাদের নিশ্চিত করেই বলতে পারি যে, গ্রিকে হোমার এমনটাই লিখেছিলেন_ 'ভেজা ঢেউ'; এবং 'মদ-কালো সাগর।' এটাই আক্ষরিক হোমার। কিন্তু ম্যাথু আরনল্ড নিতে পারলেন না সেটা, অর্থাৎ ইংরেজি ডিকশনেwet waves’ বা ্wine-dark sea আরনল্ডের কাছে মনে হলো অমার্জিত, জবরজং ও বেখাপ্পা। নিউম্যানের সঙ্গে তার মহা তর্ক-বিতর্ক হয়ে গেল। ম্যাথু আরনল্ডেরOn translating Homer [১৮৬১]-এ বিশদ বিবরণ আছে দু'জনের মধ্যকার এই চিঠিগুলোর। নিউম্যান বললেন, হোমারের মূল গ্রিক এ-মহাকাব্য মনে হয় কোনো দূর দেশের ভিন্ন ভাষায় লেখা এক জিনিস, এমনই 'প্রাচীন' ও 'অদ্ভুত' তা। এই যে হোমারের অদ্ভুতত্ব তা কেবল কানে খটকা-লাগে- মতো 'অদ্ভুত' ও 'প্রাচীন' ধাঁচের ইংরেজিতে অনুবাদ করার মাধ্যমেই আনা সম্ভব। নিউম্যানের এই স্ট্র্যাটেজির কড়া সমালোচনা করে ম্যাথু আরনল্ড লিখলেন, হোমার 'প্রাচীন' বা 'অদ্ভুত'- কোনোটাই নয়, হোমার স্বচ্ছ, মহৎ, সরল ইত্যাদি [আরনল্ডের এই মন্ত্রই হোমার অনুবাদে দেশে দেশে অনুসরণ করা হচ্ছে আজ বহু যুগ]। তিনি বললেন, হোমারের এই গুণগুলোই যেন কোনো হোমার-অনুবাদক ফুটিয়ে তোলেন, অন্তত সেই গুণগুলোর ছাপ; যদি অনুবাদেরtext -এ তার পূর্ণাঙ্গ ছোঁয়া নাও থাকে, তবু পড়ার পরে মনে যেন সেই ছাপ আসে। সোজা কথায়, ম্যাথু আরনল্ড জানালেন, আক্ষরিক অনুবাদ মানেই বেখাপ্পা ও অভব্য কিছু। বোরহেস এ পর্যায়ে এসে উদাহরণ দিলেন যে, ইংরেজিতে বলা হয়‘Good morning আর হিস্পানিতেBuenos dias’ [Good days ]। এখনgood morning-এর হিস্পানি অনুবাদ করতে গিয়ে কেউ যদি লেখে Buena manana , তাহলে অনুবাদ হয়তো আক্ষরিক হবে, কিন্তু অভিব্যক্তিটি স্পেনের মানুষদের কাছে সত্য হবে না।
বোরহেস বলে চললেন, ম্যাথু আরনল্ডের মতে আক্ষরিক অনুবাদ মিথ্যা জোরের বা গুরুত্বের ক্ষেত্র তৈরি করে বসে। এ প্রসঙ্গে বোরহেসের কথা, 'আমি জানি না তিনি [ম্যাথু আরনল্ড] ক্যাপ্টেন বার্টনের অনুবাদে 'আরব্য রজনী' পড়েছেন কি-না। বার্টন আরবি 'কিতাব আলিফ লাইলা ওয়া লাইলা'কে ইংরেজিতে লিখেছেনBook of the Thousand Night and a Night; তিনি লেখেননিBook of the Thousand and One Night [যেমনটি ইংরেজি ভাষার রীতির সঙ্গে যায়]। বার্টনের অনুবাদ আরবির সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মূলানুুগ। কিন্তু আরবিতে ওভাবে বলার চল থাকলেও ইংরেজিতেThousand Night and a Night খানিকটা বিস্ময়ের ধাক্কা দেয়। পাঠকের মনে এই ধাক্কা লাগুক এটা নিঃসন্দেহে মূল আরবির উদ্দেশ্য ছিল না।'
এরপর বোরহেস এলেন বাইবেলের প্রসঙ্গে, এবং এই প্রথম তিনি সরাসরি ভাষায় শুরু করলেন আক্ষরিক অনুবাদের প্রতি তার পক্ষপাতিত্বের প্রকাশ। বোরহেস : 'ম্যাথু আরনল্ড হোমার অনুবাদককে উপদেশ দিয়েছেন [হোমার অনুবাদের সময়] বাইবেল বগলে রাখতে। তার মতে, ইংরেজি বাইবেল হতে পারে ইংরেজিতে হোমার অনুবাদকের আদর্শ। কিন্তু ম্যাথু আরনল্ড যদি ইংরেজি বাইবেলের দিকে একটু ভালো করে তাকাতেন তাহলে দেখতে পেতেন যে, ইংরেজি বাইবেল আক্ষরিক অনুবাদেরই এক অনন্য নমুনা এবং ইংরেজি বাইবেলের মহান সৌন্দর্যের অন্যতম কারণই তাতে এই আক্ষরিক অনুবাদের উপস্থিতি।'
ইংরেজি বাইবেলে আছে,a tower of strength। আরও আছে,song of songs । কেন? কারণ হিব্রু ভাষায় কোনো সর্বোচ্চের প্রতি ইঙ্গিতসূচক শব্দ ছিল না; হিব্রুতে বলা যেত নাthe highest song বাthe best song। তাই হিব্রুর আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদ করা হলো।the song of songs । এখানে দু'ক্ষেত্রেই অর্থের দিক থেকে, ডিকশনের দিক থেকে, হঠাৎ খটকা লাগতে পারে বটে, খানিক ধাক্কা লাগতে পারে।Tower of strength 'নিঃসন্দেহে কেমন অস্বাভাবিক শোনায়, 'mighty stronghold হলেই বরং স্বাভাবিক লাগত; একই কথা প্রযোজ্যsong of songs -এর বেলায় যেখানেthe best song হলেই বরং স্বাভাবিক শোনাত। কিন্তু বোরহেস বলছেন, 'এই দুই আক্ষরিক অনুবাদে কী এক সৌন্দর্য রয়েছে।' অর্থাৎ তিনি খুশি যে বাইবেলের এ রকম আক্ষরিক অনুবাদ হয়েছিল।
এরপরই বোরহেসের পরিষ্কার কথা [আর তা হুবহু তুলে ধরছি আমি] :'আক্ষরিক অনুবাদ শুধু, যেমনটা ম্যাথু আরনল্ড বলেছেন, অভ্যবতা ও অস্বাভাবিকতাই নিয়ে আসে না, সঙ্গে আরও আনে অচেনা অনুভূতি ও সৌন্দর্য। আমার ধারণা, এ জাতীয় অনুভূতি আমাদের সবারই হয়ে থাকে কারণ আমরা যদি কোনো ভিনদেশি কবিতার আক্ষরিক অনূদিত রূপের দিকে তাকাই, আমরা মনে মনে অচেনা অদ্ভুত কিছুরই তো আশা করি। আর তা যদি সেখানে আমরা না খুঁজে পাই, তাহলে বরং এ রকম হতাশই লাগে।'
এবার বোরহেস এলেন ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত ইংরেজি অনুবাদক এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড [১৮০৯-১৮৮৩] প্রসঙ্গে। ওমর খৈয়ামের প্রায় সাড়ে সাতশ' বছর পরে ফিটজেরাল্ড প্রকাশ করলেন [১৮৫৯ সালে] তার ভুবনবিখ্যাত ইংরেজি 'রুবাইয়াত'। ফিটজেরাল্ডের প্রথম স্তবক :Awake! for morning in the bowl of night/Has flung the stone that puts the stars to flight;/And, lo! the hunter of the East has caught/the Sultan’s turret in a noose of light. । ফিটজেরাল্ডের এই বইয়ের প্রথম সন্ধান পান বিখ্যাত দুই কবি সুইনবার্ন ও রোসেটি এক বইয়ের দোকানে। তারা অভিভূত হয়ে যান এর সৌন্দর্যে। ফিটজেরাল্ড কে তা তারা জানতেন না। কিন্তু সুইনবার্ন ও রোসেটি এই অনুবাদের রূপে যারপরনাই মুগ্ধ হলেন। আজ তো তার ইংরেজি 'রুবাইয়াত' বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা ক্লাসিক সৃষ্টি।
বোরহেস বলছেন, ধরা যাক সুইনবার্ন ও রোসেটি ফিটজেরাল্ডের বইটাকে পেলেন কোনো মূল সাহিত্যকর্ম হিসেবে, অনুবাদ হিসেবে নয়; তাহলে কি তারা একই রকম মুগ্ধ হতেন? মূল ইংরেজি কবিতা হলে কি ফিটজেরাল্ড এমন অদ্ভুত কথা লিখতে পারতেন যে,Awake! for morning in the bowl of night/has flung the stone that puts the stars to flight’? আক্ষরিক বাংলায় এটা দাঁড়ায় : 'জাগো! কারণ রাতের পাত্রে সকাল/ছুড়ে মেরেছে পাথর, তাতে তারাগুলো পালিয়ে গেছে।' বাংলায় এ কথা যেমন বেখাপ্পা, ইংরেজিতেও তা-ই। কিন্তু মূল ফারসিতে তা বেখাপ্পা নয়, কারণ পারস্যের ওই দেশে পাত্রে বা বোলে পাথর ছুড়ে মারা মানে রাতের শেষে কাফেলার যাত্রা শুরু করার ঘোষণা। এই যে অদ্ভুত, অচেনা এক ব্যাপার, ভাগ্য ভালো যে ফিটজেরাল্ড ইংরেজিতে তা আক্ষরিকই রেখেছিলেন। না হলে আমরা পারস্য দেশের অভিব্যক্তির ও প্রথার এই অপার সৌন্দর্য ইংরেজিতে জানতাম কি করে?
এরপর বোরহেস তুলে ধরলেন ফিটজেরাল্ডের 'রুবাইয়াত' এর আরেক অনন্য সুন্দর চরণ :্Dreaming when dawn’s left hand was in the sky . বাংলায় :'স্বপ্ন দেখছিল সে যখন ভোরের বাম হাত ছিল আকাশের গায়ে।' এখানে লক্ষণীয় মূল শব্দ এই ্তুষবভঃ্থ বা 'বাম'। যদি 'বাম' ছাড়া হাতের জন্য অন্য কোনো বিশেষণ এখানে ব্যবহৃত হতো, তাহলে সবকিছু হয়ে যেত অর্থহীন। 'বাম হাত' বলার মাধ্যমে এক অচেনা অদ্ভুত বিষয়ের কথা বলা হলো, এক ভয় জাগানো কিছুর কথা। আমরা জানি, 'ডান হাত' মানে 'শুভ' কিছু, 'ন্যায়নিষ্ঠ' বা 'সরাসরি' কিছু; অন্যদিকে 'বাম' মানেই 'অশুভ', 'ঘোরানো-প্যাঁচালো' কিছু। ফিটজেরাল্ডের চরণটি পড়লেই আমাদের মনে ভয় জাগে যে কোনো একটা অশুভ ব্যাপার আছে 'ভোরের বাম হাত'-এর মধ্যে; মানে কোনো একটা অমঙ্গলজনক কিছু ঘটবে আজ। পারস্যের ওই লোক যে স্বপ্ন দেখছে আকাশের গায়ে ভোর তার বাম হাতে রেখেছে, তার সে স্বপ্ন, আমাদের তখন মনে হয়, যে কোনো সময়ে যেন দুঃস্বপ্নে রূপ নেবে। এই যে ইংরেজিতে অস্বাভাবিক কিন্তু পারস্যের প্রথার দিক থেকে যৌক্তিক 'বাম' শব্দটির উপস্থিতি_ এটাই ফারাক ঘটিয়ে দিচ্ছে সবকিছুর, নতুন দিনের ভোরকে করে দিচ্ছে আঁধারঘেরা, স্বপ্নকে রূপ দিচ্ছে দুঃস্বপ্নে। একটা মাত্র শব্দ, কিন্তু কত কাব্যিক শক্তি তার_ আর কবিতাকলার বিষয়টিই যুগে যুগে এ জাতীয় কারণেই রহস্যময় ও সূক্ষ্ম-বোধ জাগানো এক বিস্ময় থেকে গেছে। তারপরও, বোরহেস বলছেন, আমরা ইংরেজিতে ফিটজেরাল্ডের এই অভব্যতা মেনে নিলাম কারণ আমরা বইয়ের প্রচ্ছদে তাকিয়েই বুঝে গেলাম যে এটা ভিনদেশী এক ভাষার ইংরেজি অনুবাদ মাত্র, অর্থাৎ যত অচেনা-অদ্ভুত বিষয় বা অভিব্যক্তি এখানে আমরা পাবো না কেন, আমরা জানব যে, তাদের পেছনে আছে এক পারস্য অরিজিনাল। এই জানাটাই জন্ম দেয় বাকি সবকিছুর। অনুবাদে আমরা অচেনা ভিনদেশের অচেনা অনেক কিছু পাবো, তখন এ বিশ্বাসে তৈরি হয়ে যায় আমাদের মন। কিন্তু যখনই অনুবাদ আক্ষরিকতা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে, তখনই কমতে থাকে আমাদের সেসব অচেনা বিষয়ের অভিজ্ঞতা লাভের সম্ভাবনাগুলি; অর্থাৎ যখনই অনূদিত ভাষার কাজটি লাগবে সেই ভাষায় 'মূল' কিছুর মতো, তখনই চলে যাবে পাঠের অনেক আনন্দ, বিচিত্র পৃথিবীর নানা বিচিত্র বিষয় ও বিচিত্র প্রকাশ দেখে বিস্মিত ও বিমোহিত হওয়ার মজাগুলি।
বোরহেস বলছেন :'আমি যতদূর জানি, ওমর খৈয়াম ফিটজেরাল্ডকে সমর্থন দেননি [অর্থাৎ, ফিটজেরাল্ড তাঁর অনুবাদে সব সময় ওমর খৈয়াম ছিলেন না; অন্যকথায়, ফিটজেরাল্ড যখনই এ রকম অকাট্য আক্ষরিক ছিলেন, কেবল শুধু তখনই তিনি হয়ে উঠেছিলেন পারস্যের ওমর খৈয়াম]। এটাই আমাদের নিয়ে আসে এক ইন্টারেস্টিং সমস্যার দ্বারপ্রান্তে:আক্ষরিক অনুবাদ সৃষ্টি করে বসে এমন এক সৌন্দর্যের যা তার একান্ত নিজের।'
আজ এ পর্যন্তই। আমার ধারণা যারা আজকের এই পর্বটি এবং এক পক্ষ আগে ছাপা হওয়া এর প্রথম পর্বটি মন দিয়ে পড়ছেন বা পড়েছেন, তারা ধীরে ধীরে টের পাচ্ছেন বোরহেস চিন্তার দিক থেকে কত স্বচ্ছ, কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর ভাবনাগুলো কেমন সব আপাত গোলকধাঁধার সৃষ্টি করে। বোরহেসের অতুলনীয় বুদ্ধিবৃত্তিক [সম্পূর্ণ আবেগহীন, শুধু এক বুদ্ধিনির্ভর] জালের মধ্যে জড়িয়ে যেতে থেকে আমরা পরতে পরতে উপলব্ধি করতে থাকি তাঁর যুক্তির সরল [এবং কখনও কখনও স্ববিরোধী_ কারণ সাহিত্য বিজ্ঞান নয়, সাহিত্য আরও গূঢ় কোনো ব্যাপার] ও তীক্ষষ্ট বাঁকওয়ালা সৌন্দর্যকে। তাঁরই চূড়ান্ত প্রকাশ আমরা দেখবো [আশা করি আমি তা দেখাতে সক্ষম হবো] এই লেখার তৃতীয় ও শেষ পর্বে_ আগামী সপ্তাহে। এবং এখানে আগেই ঘোষণা দিয়ে রাখছি, অনুবাদ বিষয়ে বোরহেসের দর্শনসংক্রান্ত এই টানা তিন পর্বের শেষে আমি আসছি অসামান্য কিছু গ্রিক কবিতার তরতাজা বাংলা অনুবাদ নিয়ে_ 'আকাশে পাতিয়া কান'-এরই পাতায়। ফর আ চেঞ্জ! আমার কলমে বোরহেস বোরহেস পড়তে পড়তে যাদের খানিকটা একঘেয়েমি লাগতে শুরু করেছে, তাদের জন্য আশা করি এটা একটা সুসংবাদ_ আর্জেন্টিনার বোরহেস থেকে গ্রিসের নোবেলজয়ী অডিসিয়ুস এলাইটিসে এবং গদ্য থেকে সোজা পদ্যে চলে যাওয়ার এই ব্যাপারটা। তবে আগামী সপ্তাহে কিন্তু, একটু আগেই যেমন বললাম, সেই আবারও বোরহেস, আপাতত শেষবারের মতো। হ

No comments

Powered by Blogger.