আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ মধুমতি প্রকল্পের ভূমি আগের অবস্থায় ফেরানোর নির্দেশ

মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্পের ভূমি ছয় মাসের মধ্যে পূর্বের অবস্থায় (জলাশয়) ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এই সময়ের মধ্যে ভূমি নিবন্ধনের খরচসহ ক্রেতাদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থের দ্বিগুণ ফেরত দিতে বলা হয়েছে।
সাভারের আমিনবাজারে বিলামালিয়া ও বলিয়ারপুর মৌজার মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্প অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগ গত বছরের ৭ আগস্ট রায় দিয়েছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসব নির্দেশ রয়েছে।
রায়ে বলা হয়, রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে মেট্রো মেকার্স অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেডকে ওই দুটি মৌজার ভূমিগুলো পূর্বের অবস্থায় (জলাভূমি) ফিরিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যর্থ হলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের উদ্যোগ নিতে এবং এর খরচ মেট্রো মেকার্সের কাছ থেকে আদায় করতে বলা হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ের পর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিসহ (বেলা) পক্ষগুলোর পৃথক পাঁচটি আপিল ও আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত বছরের ৭ আগস্ট প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে রায়টি প্রকাশ পায়।
বেঞ্চের অপর পাঁচ বিচারপতি হলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মো. ইমান আলী ও বিচারপতি মো. শামসুল হুদা।
রায়ে বলা হয়, বিবাদী (মেট্রো মেকার্স) আপিলের সারসংক্ষেপে বলেছে, ৫৫০ একর ভূমি তারা ক্রয় করেছে। রাষ্ট্রপতির আদেশ, ৯৮ অনুসারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ১০০ বিঘার বেশি জমি রাখতে পারবে না। আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বরাবরে ১০০ বিঘার বেশি জমি রাখা যাবে না। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ অনুসারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে রায়ের অনুলিপি ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা মেট্রো মেকার্স অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেডের করা এ-সংক্রান্ত দুটি এবং প্লট গ্রহীতাদের একটি আপিল খারিজ হয়। বেলার আপিল মঞ্জুর ও রাজউকের আবেদনটি নিষ্পত্তি করে দেন আদালত।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়ন্ত্রিত আবাসন শিল্পকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আদালতের এই রায় মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। আবাসনের নামে ভূমিদস্যুতা রোধে এবং অনিয়ন্ত্রিত আবাসন শিল্পকে নিয়ন্ত্রণে আনতে এই রায় জলাশয় ভরাটকারীর বিরুদ্ধে প্রথম শাস্তি। তিনি আশা করেন, এই রায়কে ভিত্তি করে সরকার এ ধরনের অন্যান্য আবাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
যোগাযোগ করা হলে মেট্রো মেকার্সের আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, ‘আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে শুনেছি। রায় দেখার পর মক্কেলের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
রায়ে বলা হয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই আবাসন কোম্পানি মেট্রো মেকার্স অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেড মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্প নামে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে, যা অবৈধ। এর কারণে ওই এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ ক্ষুণ্ন হয়েছে। বন্যাপ্রবাহ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে এ ধরনের নিম্নাঞ্চল রক্ষা করা অপরিহার্য।
রাজউকের অনুমোদন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই মেট্রো মেকার্স ডেভেলপারস লিমিটেড বন্যা প্রবাহিত এলাকায় মধুমতি মডেল টাউন হাউজিং প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৪ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে বেলা। এতে ভূমি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়, রাজউক ও মেট্রো মেকার্সকে বিবাদী করা হয়। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল জারির পাশাপাশি প্রকল্পের কাজে স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট। আর রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৫ সালের ২৭ জুলাই হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্প অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। একই সঙ্গে প্লট গ্রহীতাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এ ছাড়া ওই প্রকল্পে মাটি ভরাট বন্ধ করার বিষয়ে রাজউকের মেট্রো মেকার্সকে দেওয়া নোটিশ চ্যালেঞ্জ করে অপর রিট আবেদনটি করে মেট্রো মেকার্স। এই আবেদনও খারিজ হয়।
আদালত সূত্র জানায়, এসব রায়ের অংশবিশেষের বিরুদ্ধে পক্ষগুলো পৃথক চারটি আপিল ও রাজউক একটি আবেদন করে। এর মধ্যে বেলার রিটে ওই প্রকল্প অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে মেট্রো মেকার্স একটি এবং মাটি ভরাট বিষয়ে রিট খারিজের বিরুদ্ধে অপর আপিলটি করে। আর প্লট গ্রহীতাদের স্বার্থ সংরক্ষণের নির্দেশনার বিরুদ্ধে বেলা আপিল করে। রাজউকও এ বিষয়ে একটি আবেদন করে। আর প্রকল্প অবৈধ ঘোষণার অংশবিশেষের বিরুদ্ধে প্লট গ্রহীতারাও তাঁদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি আপিল করেন। এসব আপিল ও আবেদনের ওপর গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষ হয়। পরে আদালত বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। ৭ আগস্ট আদালত রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে বেলার পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মাহমুদুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও ইকবাল কবির। আর মেট্রো মেকার্সের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি এবং এ বি এম ছিদ্দিকুর রহমান খান। প্লট ক্রেতাদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী রফিক-উল হক ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ। রাজউকের পক্ষে শুনানি করেন এ এফ এম মেজবাহ উদ্দিন।

No comments

Powered by Blogger.