বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-উচ্চশিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ by তারেক শামসুর রেহমান

সংবাদটি এভাবেই ছাপা হয়েছে দৈনিক সমকালের শেষের পাতায় গত ২০ নভেম্বর। বর্তমান সরকারের আমলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দেওয়া হলো ১৬টি। সব মিলিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭১। দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে প্রায় ৩৬টি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নানা কাহিনী আছে। এই 'কাহিনী' জানেন শিক্ষামন্ত্রী। জানেন শিক্ষা সচিব। জানেন শিক্ষা উপদেষ্টাও। প্রধানমন্ত্রী যে জানেন না_ তাই-বা বলি কীভাবে? তবুও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর সবই দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। সর্বশেষ যে ৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হলো_ সরকারি দলের নেতা, ছাত্রলীগের সাবেক ছাত্রনেতা ও মহাজোট সরকারের শীর্ষ নেতা এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত। যেখানে খোদ শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্টিফিকেট বাণিজ্য' হয়, সেখানে নতুন করে আরও ৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়ার কী যুক্তি থাকতে পারে, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। এতে পুরো উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে যে একটি অরাজকতার দিকে ঠেলে দেওয়া হলো, তাতে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। সেই সঙ্গে উচ্চশিক্ষাকে যে 'পণ্য' বানানো হলো, সেটাও-বা অস্বীকার করি কীভাবে?
নতুন করে ৭টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়ার পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক সরকারের কাজ কি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দিয়ে সরকার সমর্থকদের 'ব্যবসার পথ' প্রশস্ত করে দেওয়া? এটাই কি সরকারের কাজ? আগামীতে যদি নতুন কোনো সরকার আসে, তাহলে তারাও তো একই কাজ করবে। সারাদেশই তো এখন দু'ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মাঝে রয়েছে শিক্ষক সমাজ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও সাংবাদিক সমাজ। একই সঙ্গে বিএনপিরও রয়েছে একই ধরনের সংগঠন। এখন সরকার সমর্থক রাজনৈতিক নেতারা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'মালিক-মোক্তার' হয়ে যান, তাহলে তো ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় 'আওয়ামী বিশ্ববিদ্যালয়' হিসেবে পরিচিতি পাবে! তারপর রাজনৈতিক বিবেচনায় সার্টিফিকেটও দেওয়া হবে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বিএনপি একই 'কর্ম' করবে। জামায়াতের তো আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় আছেই! এরশাদ সাহেব ব্যাংক নিয়েছেন। এখন হয়তো রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই চেয়ে বসবেন!
আমরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে রীতিমতো 'জুয়া' খেলছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর যে নজরদারি বাড়ানো দরকার, সেটা মঞ্জুরি কমিশন করছে না। ইউজিসির নাম পরিবর্তন হচ্ছে। জনবলও বাড়বে। সদস্য সংখ্যাও বাড়বে। তাতে কি উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানো যাবে? এতে সরকারের খরচ বাড়ল। আমি অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভাল করার জন্য আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান দরকার। উচ্চশিক্ষা কমিশন দিয়েও হতে পারে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা একটি স্বাধীন শাখা থাকবে। এখানে নূ্যনতম ৩ থেকে ৪ জন সদস্য থাকবেন। আলাদা প্রশাসন থাকবে। না হলে মাত্র একজন সদস্যকে দিয়ে (যা এতদিন হয়ে আসছে) ৭১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে যুগের চাহিদা_ এটা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। এখানে মালিকপক্ষের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। এটাকে 'ব্যবসায়িক কেন্দ্র' করা যাবে না। মালিকরা পুঁজি বিনিয়োগ করবেন বটে, কিন্তু ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে তা তারা করবেন না। করবেন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে। কিন্তু কী হচ্ছে এই সেক্টরে? দারুল ইহসানের অবৈধ ক্যাম্পাস ৯৮টি। তারা বিজ্ঞাপন দিয়ে বলছে, সরকার তাদের অনুমতি দিয়েছে! অথচ ইউজিসির চেয়ারম্যান স্বয়ং বলছেন, 'আউটার ক্যাম্পাস' অবৈধ। তাহলে কোন সাহসে এবং কাদের পরামর্শে এরা ছাত্র ভর্তি করছে? উচ্চ আদালতের নজরে কি আসছে না বিষয়টি? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি পারে না উদ্যোগী হয়ে চিরস্থায়ীভাবে আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ করে দিতে? 'শর্ষের মধ্যে যদি ভূত' থাকে, তাহলে ভূত তাড়াব কীভাবে? প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় দুটি। দু'জন ভিসি। তারা দাবি করছেন, তারা অনুমোদিত। উত্তরার এশিয়ান ইউনিভার্সিটির অবস্থা ভয়াবহ। শুধু সার্টিফিকেট বাণিজ্যই নয়, মালিকানা দাবি করেছেন দুই ভাই। আরও ভয়াবহ_ শিক্ষকরা 'নোট' বিক্রি করেন এবং ছাত্রদের তা কিনতে বাধ্য করেন। জন্মের পর থেকেই সাদেক সাহেব ভিসি। এখন তৈরি হচ্ছে তার ছেলে। সেও ভিসি হওয়ার পথে। ওখানে পড়ায় কারা? কী তাদের ডিগ্রি? অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষকদের দিয়ে চলছে 'বিশ্ববিদ্যালয়'। এটা যেন একটা পারিবারিক ব্যবসাকেন্দ্র। ইবাইস নিয়েও একই সমস্যা। মালিকপক্ষ একাধিক। মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক-মোক্তার। যিনি মার্কিন দূতাবাসে চাকরি করতেন, তিনিও এখন ভিসি।
সমকালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৩ শতাংশ শিক্ষকের (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষা সনদ জাল। আমার মনে হয়, এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। ভুয়া পিএইচডি নিয়ে চাকরি নিয়েছেন অনেকে। আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমনি এক ভুয়া পিএইচডির খবর আমি নিজে কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। কিন্তু তাতে পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পিএইচডি ডিগ্রিও জাল। আমি অন্তত ১০ ভিসির নাম বলতে পারব, যারা কোনোদিন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা না করেই 'অধ্যাপক' পদবি ব্যবহার করছেন! কী দুর্ভাগ্য এ জাতির! দেখার কেউ নেই। অভিভাবকরা অসহায়। তারা এক রকম বাধ্য হয়েই তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।
উচ্চশিক্ষা নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করে কিছু লোকের চাকরির সংস্থান হবে বটে (তাও আবার রাজনৈতিক বিবেচনায়), কিন্তু উচ্চশিক্ষার তাতে মানোন্নয়ন ঘটবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও উচ্চশিক্ষায় ধস নেমেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় অনিয়মের খবর উপাচার্য মহোদয় অবহিত হয়েও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার 'স্বার্থে' তিনি নিশ্চুপ। এখানেও তিনি 'কম্প্রোমাইজ' করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ১৩ লাখ লোকের ইন্টারভিউ নিয়ে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ রচনার কাহিনী সবার মুখে। কিন্তু বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক এখনও 'দ্বিগুণ উৎসাহে' আরও পিএইচডি ছাত্র নিচ্ছেন। রাজশাহী ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'পিএইচডি কাহিনী' আর একদিন বলা যাবে। এই মুহূর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। যা করা খুব জরুরি তা হচ্ছে, অবিলম্বে একটি 'অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল' গঠন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নির্ধারণ করে দেওয়া, যাতে অভিভাবকরা 'মান' দেখে তার সন্তানকে 'ভালো' একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারেন। সেই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের 'ডাটাবেজ' তৈরি করা জরুরি, যাতে ভুয়া পিএইচডিধারীদের চিহ্নিত করা যায়। আমি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশে একটি শাখা স্থাপনেরও পক্ষপাতী। এতে আমাদের লাভ দুটি_ এক. আমাদের সন্তানরা পড়াশোনার একটা অংশ বিদেশে গিয়ে পড়তে পারবে; দুই. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেবে এবং তাদের শিক্ষার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নেবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকপক্ষ আবার এর বিরুদ্ধে। তারা 'ব্যবসা হারানোর' আশঙ্কা করছেন। তারা পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। এখন পুঁজি বাড়াতে চান। তাদের অনুরোধ করি, আপনারা গার্মেন্ট, আলু, পটোল ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করুন; বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়।
শিক্ষকতার একটি 'পরিণত বয়সে' এসে মনে হয়েছে, এই সেক্টরটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শুধু আমাদের নেতৃত্বের অভাবে। আমাদের কোনো 'ভিশন' নেই। আমরা ২০২১ সালে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই। কিন্তু আমরা সেই নেতৃত্ব কি প্রতিষ্ঠা করতে পারছি, যারা আমাদের একুশ শতকে একটি মাধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার 'রূপকল্প' তৈরি করবে? আমরা লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী তৈরি করছি, যারা মেধাহীন। নেতৃত্ব দেওয়ার 'কোয়ালিটি' তাদের নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পারছে না রাজনৈতিকভাবে নিয়োগকৃত ভিসিদের কারণে। আমরা একটা সার্টিফিকেটসর্বস্ব জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি। ঘরে ঘরে এখন মাস্টার্স আর বিবিএ। একজন এসআইও এসেছিল পিএইচডি করতে! ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বেড়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদের সবাইকে ধারণ করতে পারে না বিধায়ই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু সার্টিফিকেট 'বিক্রির' প্রতিষ্ঠান খুলে আর যাই হোক, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন করা যায় না।

ড. তারেক শামসুর রেহমান :বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য
www.tsrahmanbd.blogopot.com

No comments

Powered by Blogger.