মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে by ড. শামসুল আলম

এখনো আমরা স্বল্পোন্নত দেশ। মাথাপিছু আয় দুই হাজার মার্কিন ডলারে উন্নীত হলে আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্ব সমাজে পরিগণিত হব। বাংলাদেশের প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০১০-২০২১) সে স্বপ্ন আঁকা হয়েছে, যা বাস্তবে রূপ নিতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ২০২১ সালের মধ্যে।
বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ৭৮০ মার্কিন ডলার, যা মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে ২ দশমিক ৫৬ গুণ বৃদ্ধি পেতে হবে আগামী ৯ বছরে। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার সে ক্ষেত্রে হতে হবে আট থেকে ১০ শতাংশ (ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা)। বিশ্বব্যাংক বলেছে, প্রয়োজন হবে সাড়ে সাত থেকে আট শতাংশ। আমাদের প্রবৃদ্ধির হার গত কয়েক বছরের বিনিয়োগ স্থবিরতার মধ্যেও গড়ে সাড়ে ছয় শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আঞ্চলিক ও বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বলা যায় বেশ সন্তোষজনক। তবে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে এ হার অবশ্যই যথেষ্ট নয়। প্রবৃদ্ধির হার আট শতাংশে উন্নীত হতে হলে বিনিয়োগ হতে হবে আমাদের দেশজ আয়ের ৩২ শতাংশ, যা এখন রয়েছে ২৬.৯ শতাংশে। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, এই বিনিয়োগ সরকারি বা বেসরকারি খাতে দ্রুত বৃদ্ধি পাবে- এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন প্রতিবছর সরকারি বিনিয়োগ মোট বিনিয়োগের মাত্র সাড়ে চার শতাংশ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ২০ শতাংশ কিংবা তার একটু বেশি। ব্যাপকভাবে ভর্তুকির অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় খাতে লোকসানি শিল্প কলকারখানা থাকায় উন্নয়ন ব্যয়ের বর্ধিত বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও সরকারি বিনিয়োগ খুব লক্ষণীয়ভাবে বাড়ানো যাবে এটা মনে হয় না। বেসরকারি খাত যথেষ্ট বিকশিত হলেও গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, প্রাথমিক উচ্ছ্বাস সত্ত্বেও ব্যাপক বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা কমে আসছে। এর কারণ এখন ভূমির অপ্রতুলতা তীব্রতর হচ্ছে, যথেষ্ট বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না বিধায় উন্নততর প্রযুক্তির প্রবেশ হচ্ছে না। প্রযুক্তির বিকাশ ও নতুন নতুন উদ্ভাবন ছাড়া অর্থনীতি কখনো স্থবিরতা কাটাতে পারে না। গণখাতের ব্যবস্থাপনায় মাঝারি ও উচ্চ প্রশাসনিক স্তরে প্রতিযোগিতার তেমন সুযোগ নেই। ফলে প্রতিভার প্রবেশ ও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ কম। নব্বই দশক থেকেই বাজার অর্থনীতিকেই আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ হিসেবে প্রায় সর্বজনীনভাবেই মেনে নিয়েছি। বিকল্প উন্নয়ন পথ কিংবা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতেও শিল্প বিপ্লবের পর কোথাও অন্য কোনো মডেল সফলতার মুখ দেখেনি। একচ্ছত্রভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত অনেক দেশও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাজার অর্থনীতির ধারণাকে ব্যবহার করছে। যেমন- চীন। তবে এই মিশ্র ব্যবস্থাও কত দিন টেকসই হবে সে এখনো দেখার বাকি। শাসন পরিচালনার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো উন্মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক না হলে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বজনীন ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হতে পারে না। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো উন্মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক না হলে শাসন ক্ষমতার অধিকারী রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। কর্তৃত্ববাদী শাসনে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হলেও এমনকি উচ্চ প্রবৃদ্ধি দীর্ঘকাল অর্জন করলেও সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা ভঙ্গুর কিংবা অস্থিতিশীল থেকেই যায়। উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেয় না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকতায় সবার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে প্রবৃদ্ধি অর্জন অপরিহার্য।
আমাদের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে এই পর্যায়ে অন্যতম বাধা, কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ বিনিয়োগ না হওয়া। দেশে কি পুঁজির অভাব রয়েছে? বাস্তব বিশ্লেষণে দেখা যাবে, এ সময় প্রায় প্রতিটি গ্রামেই কোটিপতি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আবির্ভাব হয়েছে। দেশে এখন হাজার হাজার কোটিপতি। প্রতিটি গ্রাম, হাটবাজারে অসংখ্য নতুন বিল্ডিং ও স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। এটা ওপেনসিক্রেট যে রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রবাসীদের দেশে সম্পত্তি বিক্রয় ও ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরেও দেশ থেকে প্রতিবছর অনেক অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
অবকাঠামো ও পুঁজি বিনিয়োগের জন্য এখন বড় বাধা নয়। বলা হয়ে থাকে, আমাদের বড় বাধা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতিযোগিতাহীনতা, যা উন্মুক্ত অন্তর্ভুক্তির (inclusiveness) অন্তরায়। সবই বিজয়ী দলের জন্য। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত হয়ে বিরোধী সব রাজনৈতিক দল এমনিতেই সংক্ষুব্ধ থাকে, প্রচার-অপপ্রচার চালাতে থাকে। সঙ্গে যুক্ত হয় দলের সুবিধাবঞ্চিত অংশ। আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতারও বড় কারণ তৈরি হয়ে যাওয়া এই এক্সট্রাকটিভ (extractive) রাজনৈতিক কাঠামো। এই রাজনৈতিক কাঠামোর কারণে বাজার কাঠামো সবার জন্য উন্মুক্ত ও বহু ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারেনি। বাজারের জন্য উৎপাদক ও মধ্যবিত্ত এবং ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা, এক্সট্রাকটিভ রাজনৈতিক কাঠামোর সুবিধা নিতে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। পণ্য বাজারজাতকরণে যে পরিশ্রম বা প্রতিযোগিতা মোকাবিলার জন্য যে শ্রম ও অর্থ প্রয়োজন, তার চেয়ে যে দলেই হোক ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের অনুগ্রহভাজন হলে সিন্ডিকেট, কার্টেল করা যায়, কর ফাঁকিতে ধরা পড়তে হয় না, ঋণ মওকুফের জন্য প্রভাবিত করা যায়, অবৈধ ব্যবসা চালানো যায়। সরকারি বা পতিত জমি দখল করা যায়। এক কথায় এক্সট্রাকটিভ রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বাজার ব্যবস্থাকেও এক্সট্রাকটিভ বা নিষ্কর্ষী করে তোলে। তখন না রাজনীতিতে না অর্থনীতিতে প্রতিভা অনুযায়ী সবার অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হয়ে ওঠে, যা ইনক্লুসিভ গ্রোথের (inclusive growth) পরিপন্থী ব্যবস্থা। এক্সট্রাকটিভ বাজার ব্যবস্থায়, পণ্যবাজারগুলোয় প্রতিযোগিতা নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। বাজার ব্যর্থতার এই সুযোগে ক্রেতাকে বেশি দাম দিতে হয় ও উৎপাদক ভোক্তার দামের ন্যায্য অংশ পায় না। এক্সট্রাকটিভ বাজার ব্যবস্থায় কুচক্র এক্সট্রাকটিভ রাজনৈতিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে চায়। ফ্রি মিডিয়া বা বাকস্বাধীনতা তুলনামূলক ফ্রি বা মুক্ত থাকলে তা ইনক্লুসিভ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ইনক্লুসিভ (প্রতিযোগিতামূলক) বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার সহায়ক। কুচক্র বা কায়েমি চক্র অবশ্য ফ্রি মিডিয়ার বিরোধী। ফ্রি মিডিয়া সমাজে ভার্চুয়াস সার্কেল (Virtuous circle) তৈরির সহায়ক। ভার্চ্যুয়াস সার্কেল বাংলায় কিছুটা সুশীল সমাজের সমার্থক, যদিও সুশীল সমাজের অনেকেই এক্সট্রাকটিভ রাজনৈতিক ব্যবস্থারও সুফলভোগী। এ কারণেই সুশীল সমাজেও থাকে অনৈক্য এবং প্রকৃত সুশীল সমাজের আন্দোলন গতি পায় না। যদিও ব্যাপকভিত্তিক সুশীল সমাজের (Virtuous circle) জোরালো আন্দোলন ছাড়া দীর্ঘদিনের এক্সট্রাকটিভ ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। যা আছে সেই ভাবে চললে সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় শতাংশ 'এই বাঙালি প্রবৃদ্ধির হার' হয়তো অব্যাহত থাকবে; তবে মধ্যম আয়ের উন্নত দেশ হওয়া যাবে না। সে জন্য চাই বাজারব্যবস্থার আমূল সংস্কার। যাকে বলেছি সবার অন্তর্ভুক্তিমূলক পূর্ণ প্রতিযোগিতার বাজার। তার জন্যই সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কার। যাকে এক কথায় বলি সুশাসন। পূর্ণ প্রতিযোগিতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক কাঠামো।
আমার প্রতিপাদ্য হচ্ছে, বেসরকারি বিনিয়োগ আমাদের দেশজ আয়ের ২৫ থেকে ২৮ শতাংশে সহজেই যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ আমাদের জিডিপির ৩২ শতাংশে উন্নীতকরণও কোনো সমস্যা নয়। সেভাবে বার্ষিক গড়ে আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন মোটেই কঠিন নয় এবং সে জন্যই ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশ (২০১৭ থেকে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার) মধ্যম আয়ের দেশেও উন্নীত হতে পারে। কেবল প্রয়োজন বাজারগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া। পূর্ণ প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো, যেখানে সুযোগ দেওয়ার প্রশ্ন, তা হতে হবে দলীয় ভিত্তিতে নয়, সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে হলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে ইনক্লুসিভ (inclusive) এবং তখন দেশপ্রেমিক ভার্চ্যুয়াস সার্কেল বা সুশীল গোষ্ঠী তৈরি হওয়া সহজ হয়ে যায়। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইনক্লুসিভ হতে পারে না। সর্বস্তরে নির্বাচনও হতে হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। গত চার বছরে সর্বস্তরে নির্বাচনগুলো হয়েছে হস্তক্ষেপহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। জাতীয় নির্বাচনেও এটুকু নিশ্চিত করা গেলে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত থাকার সুযোগ থাকবে না। প্রতিযোগিতামূলকভাবে সব কিছু হওয়ায় সব কিছু মেনে নেওয়ার মূল্যবোধ তৈরি হবে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতামূলকভাবে পরিচালিত হলে বাজারব্যবস্থা হবে চূড়ান্তভাবে প্রতিযোগিতামূলক। হবে সব কুশীলবের জন্য সমতল মাঠ। সে রাজনীতিই হোক আর অর্থনীতিই হোক এমন পরিবেশেই দেশে মেধার সর্বোচ্চ বিকাশ ও ব্যবহার সম্ভব। উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনীতি হয়ে উঠবে গতিময় ও টেকসই। বিনিযোগের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠবে উদ্যোক্তারা।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সভাপতি
বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতি সমিতি

No comments

Powered by Blogger.