সংশোধিত গঠনতন্ত্র ইসিতে-ইসলাম ছেড়ে গণতন্ত্রের লেবাসে জামায়াত by কাজী হাফিজ

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তাদের গঠনতন্ত্রে দলের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা.) প্রদর্শিত দ্বীন (ইসলামী জীবনবিধান) কায়েমের প্রচেষ্টার কথা বাদ দিয়েছে।
'আল্লাহ ব্যতীত কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁহার দেওয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয়, এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে'- এ নীতিও বাদ। সমাজের সর্বস্তরে খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টার বদলে এখন চরিত্রবান নেতৃত্বের কথা বলছে দলটি। এ ছাড়া ইসলামী শাসন কায়েমের বদলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে সংশোধিত গঠনতন্ত্রে। এভাবে ধর্মীয় উদ্দেশ্যপূর্ণ এবং সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) পরিপন্থী মোট আটটি ধারা পরিবর্তন বা বিলুপ্ত করে জামায়াতে ইসলামী তাদের সংশোধিত গঠনতন্ত্র গত রবিবার বিকেলে নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশন গত ৪ নভেম্বর দলটির সেক্রেটারি জেনারেল বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশোধন করতে তাগিদ দিয়েছিল। নির্বাচন কমিশনে ২০০৮ সালে নিবন্ধিত হওয়ার পর জামায়াতকে এর আগেও এ বিষয়ে তিনবার তাগিদ দেওয়া হয়।
কমিশন সূত্র জানায়, রবিবার বিকেলে দলটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট জসীম উদ্দিন সরকার জামায়াতের সর্বশেষ সংশোধিত ও মুদ্রিত গঠনতন্ত্র জমা দেন। এ সংশোধিত গঠনতন্ত্রটি ২০১২ সালের নভেম্বরে ৪৯তম মুদ্রণ এবং এর প্রকাশক জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বলে উল্লেখ করা হয়। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া গঠনতন্ত্রের প্রতিটি পাতায় অ্যাডভোকেট জসীম উদ্দিন সরকারের সিল ও স্বাক্ষর রয়েছে।
এই সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমা দেওয়ার জন্য জামায়াত নির্বাচন কমিশনের কাছে তাদের জন্য প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশের কথা উল্লেখ করে আরো দুই মাসের সময় চেয়েছিল। তাদের সে সময় দেওয়া হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই দলটি গঠনতন্ত্র সংশোধন করে কমিশনে জমা দিল। তবে এ সংশোধন যথাযথ হয়েছে কি না, তা পরীক্ষার জন্য কমিশন তাদের আইন শাখাকে নির্দেশ দিতে পারে। তার আগে কমিশন বৈঠকে বিষয়টি তোলা হবে বলে জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশন জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ২ ধারার ৫ উপধারা, ধারা ৩, ৫ ধারার ৩ উপধারা, ৬ ধারার ৪ উপধারা, ৭ ধারার ১ থেকে ৪ উপধারা, ১১ ধারার ২ উপধারা ও ১৮ ধারার ৪(চ) উপধারা সংশোধনের তাগিদ দেয়। দলটির নিবন্ধনের সময়ও এসব ধারা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সে সময় জামায়াত নেতা অ্যাডভোকেট জসীম উদ্দিন সরকার গঠনতন্ত্র থেকে কয়েকটি ধারা লাল কালি দিয়ে কেটে সেগুলো গঠনতন্ত্রের অংশ নয় মর্মে স্বাক্ষর করেন। তবে সংশোধিত গঠনতন্ত্রে সেগুলো স্থান পায়নি।
দলটির গঠনতন্ত্রের ২ ধারার ৫ উপধারার একাংশে বলা ছিল, '...(আল্লাহ ব্যতীত) কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁহার দেওয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয়, এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে।' সংশোধিত গঠনতন্ত্রে এ অংশটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
৩ ধারায় দলের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভূমিকাসহ চারটি উপধারায় আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা.) প্রদর্শিত দ্বীন (ইসলামী জীবনবিধান) কায়েমের প্রচেষ্টার কথা বলা ছিল। সেগুলো বাদ দিয়ে 'বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন' বাক্যটি সংযোজন করা হয়েছে।
৫ ধারার ৩ উপধারায় বলা ছিল, 'সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম করিয়া সমাজ হইতে সকল প্রকার জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচারের অবসান ঘটাইবার আহ্বান জানাইবে।' এ অংশ থেকে 'ইসলামের' শব্দটি বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে 'গণতান্ত্রিক পদ্ধতি' কথাটি সংযোজন করা হয়েছে।
৬ ধারার ৪ উপধারায় 'ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠাকল্পে গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বাঞ্ছিত সংশোধন আনয়নের উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা'- এই বাক্য থেকে 'খোদাভীরু' বাদ দিয়ে 'চরিত্রবান' শব্দটি যোগ করা হয়েছে।
৭ ধারার ১ থেকে ৪ উপধারায় জামায়াতের সদস্য হতে হলে ইসলামে বিশ্বাস ও শরিয়তের নির্ধারিত ফরজ ও ওয়াজিব আদায়ের শর্ত দেওয়া ছিল। এগুলো এখন বিলুপ্ত করা হয়েছে।
১১ ধারার ২ উপধারায় যেকোনো অমুসলিম নাগরিক কয়েকটি শর্ত পূরণের মাধ্যমে জামায়াতের সদস্য হতে পারবে বলা ছিল। এ উপধারাটি দলের গঠনতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও স্ববিরোধী বলে জানায় নির্বাচন কমিশন। জামায়াত এই উপধারা বিলুপ্ত করেছে।
১৮ ধারার ৪(চ) উপধারায় বলা ছিল, 'আমীরে জামায়াত কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সহিত পরামর্শ করিয়া প্রয়োজনীয়সংখ্যক সদস্যকে (রুকনকে) কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য মনোনীত করিতে পারিবেন।' এটি আরপিও পরিপন্থী বলে উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশন। এ উপধারাও বিলুপ্ত করা হয়েছে।
জামায়াতকে গঠনতন্ত্রের ৬৪ পৃষ্ঠার বিশেষ নোটের দফা ৩-এ সংশোধনী আনারও তাগিদ দিয়েছিল ইসি। দলের গঠনতন্ত্রে সব কমিটিতে আরপিও অনুসারে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ মহিলা সদস্যের স্থলে বেশির ভাগ কমিটিতে ২৫ শতাংশ মহিলা সম্পৃক্ত করা হবে বলে জানানো হয়েছিল। সংশোধিত গঠনতন্ত্রে মহিলা সদস্য ৩৩ শতাংশ করেই ৬৯ ধারায় তা সনি্নবেশ করা হয়েছে।
ইসি সূত্র জানায়, কোনো দলের গঠনতন্ত্র দেশের সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সে দলের নিবন্ধন বাতিল হতে পারে। আরপিওর ৯০-এর সি-ধারায় বলা হয়েছে, একটি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের অযোগ্য হবে, যদি ওই দলের (ক) গঠনতন্ত্রের উদ্দেশ্যসমূহ সংবিধান পরিপন্থী হয়, (খ) গঠনতন্ত্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও লিঙ্গভেদে কোনো বৈষম্য প্রতীয়মান হয়, (গ) নাম, পতাকা, চিহ্ন বা অন্য কোনো কর্মকাণ্ড দ্বারা সাম্প্রদায়িক ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার কিংবা দেশকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আর সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে এই মর্মে বলা হয়েছে, নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনিষ্ট করার উদ্দেশে এবং ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টির জন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন বা ওই ধরনের কোনো সমিতি বা সংঘের সদস্য হওয়ার অধিকার কোনো নাগরিকের থাকবে না।
নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ জামায়াতের গঠনতন্ত্র বিষয়ে গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দলটি তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে কমিশন সচিবালয়ে জমা দিয়েছে বলে জেনেছি। এটি কমিশন বৈঠকে উপস্থাপন করার পর যথাযথভাবে সংশোধন করা হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখব।'

No comments

Powered by Blogger.