পদ্মা সেতু প্রকল্প- দুদক ১০ জনকে দায়ী করতে পারে?

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রায় নিশ্চিত হয়েছে যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে আর্থিক লেনদেন নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে অর্থের লেনদেন হয়নি। এর আগেই আটকে যায় পদ্মা সেতুর কাজ।
দুদক এ জন্য ৮ থেকে ১০ জনকে দায়ী করতে পারে। এর মধ্যে এসএনসি-লাভালিনের তিনজন সাবেক কর্মকর্তাও রয়েছেন। এই তিনজন কানাডার নাগরিক। আর বাকি সাতজনের মধ্যে সাবেক মন্ত্রীসহ পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত চারজন সরকারি কর্মকর্তার নাম রয়েছে বলে জানা গেছে। অন্য দুজন সড়ক ভবনের কর্মকর্তা।
সরকারের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে কজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে, তা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আজ মঙ্গলবার বা কাল বুধবার এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, দুদকের তদন্তে প্রায় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দুদকের তদন্তে এসএনসি-লাভালিনের যে তিনজন সাবেক কর্মকর্তার নাম এসেছে, তাঁরা হলেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও একই বিভাগের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল। এর মধ্যে রমেশ শাহ ও মোহাম্মদ ইসমাইলের বিরুদ্ধে কানাডার পুলিশও পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ পেতে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগে মামলা করেছে। তাঁরা বর্তমানে জামিনে আছেন। রমেশ শাহর ডায়েরিতে সর্বপ্রথম কাজ পেতে ঘুষ লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
গতকাল সোমবার দুদক পদ্মা সেতু নিয়ে করা তদন্ত কার্যক্রম শেষ করেছে। গতকাল দুদক তদন্ত শেষ করেছে দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে। তাঁরা হলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। সৈয়দ আবুল হোসেন এরই মধ্যে দুদককে লিখিতভাবে জানিয়েছেন যে তাঁর কাছে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের নিয়ে এসেছিলেন আবুল হাসান চৌধুরী। এ ছাড়া দুদকের তদন্তে সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া এবং সাবেক প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামের নামও এসেছে বলে জানা গেছে। সাবেক সেতুসচিব বর্তমানে বাধ্যতামূলক ছুটিতে আছেন এবং সাবেক প্রকল্প পরিচালকের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা দুদক পায়নি বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, পদ্মা সেতু নিয়ে করা তদন্তের ফলাফল নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে কাল বুধবার বৈঠক করবে দুদক। আজ মঙ্গলবার এই বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও হরতালের কারণে তা এক দিন পিছিয়ে গেছে। গত রোববার বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলটি দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় আসে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান আইনজীবী লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে গঠিত এই দল গত সোমবার দুদকের সঙ্গে এক দফা বৈঠক করেছে। দলের অন্য দুই সদস্য হলেন হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং ও যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান। সোমবারের বৈঠকে তাঁরা দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। দুদক সূত্রে জানা গেছে, তদন্তে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করাটাই রীতি। বিশ্বব্যাংক ঠিক সেটাই চাইছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক গত ১৩ নভেম্বর পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ দুদককে দিয়েছে। এর আগে আরও দুই দফা দুর্নীতির তথ্য দেয় বিশ্বব্যাংক। সেই তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই কাজ করছে দুদক। তবে দুদকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের দেওয়া প্রমাণ ছাড়াও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের আরও কিছু তথ্য পেয়েছেন দুদকের তদন্তকারীরা। এরই ভিত্তিতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আট থেকে ১০ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন তাঁরা।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, তদন্তে নাম এলেও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি দুদক। তবে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে রক্ষার চেষ্টা করা হলে বিশ্বব্যাংক তা মানবে না বলেও দুদক জানে। এর আগেও সরকার তাঁকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। তাতে বরং পদ্মা সেতুর কাজ পিছিয়ে গেছে। এবারও একই চেষ্টা হলে পদ্মা সেতু আবারও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে সরকারি সূত্রগুলো বলছে।
জানা গেছে, বুধবারের বৈঠকের পর বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলটি ফিরে গিয়ে তাদের প্রতিবেদন দেবে। দুদকের তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গৃহীত আইনি পদক্ষেপে সন্তুষ্ট হয়ে ইতিবাচক প্রতিবেদন দিলে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে অর্থ-সহায়তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দ্রুততার সঙ্গে নেবে। আর না হলে আবারও সংকটে পড়বে পদ্মা সেতু প্রকল্প।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, সঠিকভাবে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত এবং আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হলে এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও বাড়বে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা যেমন বিশ্ব জানবে, তেমনি দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ হিসেবে দুদকের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে। এর ফলে ভবিষ্যতে ঋণ পাওয়াও বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে। অন্যদিকে, পদ্মা সেতুর কাজও দ্রুত শুরু করা যাবে। ফলে সব দিক থেকেই বাংলাদেশ লাভবান হবে। এতে রাজনৈতিকভাবেও আওয়ামী লীগ সরকার লাভবান হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
আবার, দুদকের তদন্তে কানাডার নাগরিকদের নাম এলে সেটিও বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক বার্তা দেবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা। এর মধ্যে কানাডা পুলিশের তদন্তে এসএনসি-লাভালিনের সাবেক কর্মকর্তা কেভিন ওয়ালেসের নাম আসেনি। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে তাঁকে অভিযুক্ত করা হলে সেটিও কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে একটি আলোচিত বিষয় হবে।
দুদকের তদন্ত ও মামলা করা নিয়ে গোলাম রহমান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধান দলের প্রতিবেদনের ওপর পর্যালোচনা করে কমিশন মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি এ সময় আরও বলেন, ‘আমরা একেবারে নিরপেক্ষভাবে বিষয়টিকে দেখছি। এখানে কোনো ব্যক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। প্রতিবেদনে যাঁদের নাম আসবে, তাঁদের বিষয়ে কমিশন সভায় পর্যালোচনা করা হবে। আমরা জোর করে কাউকে আসামি করব না, আবার প্রমাণ পেলে কাউকে ছাড়বও না।’
দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ: তদন্তের শেষ দিনে দুদক গতকাল পৃথকভাবে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। দুদকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক ও অনুসন্ধান দলের প্রধান আবদুল্লাহ আল জাহিদের নেতৃত্বে চার সদস্যের অনুসন্ধান দল তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দেড় ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আবুল হাসান চৌধুরীকে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিনি কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজ করেননি বলে জানান। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকারের বড় অর্জন মিডিয়াকে স্বাধীনতা দেওয়া। আর এটা বিজয়ের মাস। কাজেই যা লিখবেন, বস্তুনিষ্ঠ লিখবেন।’
দুপুরে টানা আড়াই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় সৈয়দ আবুল হোসেনকে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি স্বচ্ছতার সঙ্গে সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছি, এখন তদন্ত কর্মকর্তারা যদি বুঝতে না পারেন, আমার কিছু করার নেই।’ তিনি কোনো ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন দাবি করে দুদকের অনুসন্ধান দলের কাছে জমা দেওয়া লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের বিতরণ করেন।
লিখিত বক্তব্যে সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, ‘এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে আবুল হাসান চৌধুরী আমার কাছে এসেছিলেন। আমাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, এসএনসি-লাভালিনের দরপ্রস্তাব যেন সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয়।’

No comments

Powered by Blogger.