দিলি্লর এবার লক্ষ্মী-সাধনা by প্রেমাংশু চৌধুরী

তিস্তা চুক্তি অথৈ জলে। ছিটমহল হস্তান্তরেও বিরোধিতার কাঁটা। বাংলাদেশের হাত ধরে এগিয়ে যেতে এখন তাই লক্ষ্মীই ভরসা ভারতের। দু'দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক পোক্ত করতে একজোট হচ্ছেন সীমান্তের দু'পারের শিল্পপতি-বিনিয়োগকারীরা, যাকে তারা বলছেন 'অর্থনৈতিক কূটনীতি'।
শুনলে সোনার পাথর বাটি মনে হলেও, ঢাকা শহরে সেটাই ঘোর বাস্তব। কয়েক দিন পরেই 'বিজয় দিবস'। '৭১-এর যুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পণের বর্ষপূর্তি। তার ঢের আগেই সেজেগুজে তৈরি ঢাকা। সোমবার থেকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শুরু হচ্ছে 'ইন্ডিয়া ট্রেড শো'। বণিকসভা ফিকি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ভারতের ৫০ জন শিল্পপতি-বিনিয়োগকারী ইতিমধ্যেই ঢাকায় এসেছেন। দু'দেশের মন্ত্রী-আমলারাও রয়েছেন। লক্ষ্য হলো, দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানো। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ ও দু'দেশের মধ্যে যৌথ উদ্যোগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা।
'কেউ কথা রাখে না' এমনটা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে বলা যাবে না। মনমোহন সিংকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ভারতীয় জঙ্গিদের বাংলাদেশের মাটিতে থাকতে দেওয়া হবে না। কথা রেখেছেন। মনমোহন কিন্তু তার কথা রাখতে পারেননি। তিস্তা চুক্তি সই করার সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁকে বসেছিলেন। এখন ছিটমহল হস্তান্তরে বাদ সাধছে বিজেপি।
অগত্যা বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়নে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন মনমোহন। তিনি নিজে ভারতে বিদেশি বিনিয়োগ টানতে চাইছেন। ভারতীয় শিল্পপতিদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহ দিয়ে তিনি হাসিনার ঝুলিও ভরে দিতে চাইছেন। সঙ্গে সোমবার থেকে ফের চালু হচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়ার দিলি্ল-ঢাকা বিমান পরিষেবাও।
খুঁত তবু থেকেই যাচ্ছে। শিল্পপতিদের সঙ্গে নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মারই আসার কথা ছিল। কিন্তু সংসদে খুচরো ব্যবসায় এফডিআই নিয়ে বিতর্কের জন্য শেষ মুহূর্তে তিনি দিলি্লতেই আটকে পড়লেন। খবর ছিল তার বদলে আসছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ডি পুরন্দেশ্বরী। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনিও আসছেন না। ভারত সরকারের প্রতিনিধিত্ব করবেন বাণিজ্য সচিব এস আর রাও। কিন্তু আনন্দ শর্মার অনুপস্থিতির দাগটা যেন কিছুতেই মুছছে না।
ঢাকার কুখ্যাত যানজটের মতোই দু'দেশের ব্যবসায়িক লেনদেন বহু বছর ধরে কর ও শুল্কের জটে আটকে ছিল। তিন বছর আগে মনমোহন সিং কার্যত সব বাধাই তুলে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে যে বিরাট লাভ হয়েছে, বলা যায় না। শুনে অবাক হলাম, বাংলাদেশের সঙ্গে যে দেশটির বাণিজ্য সব থেকে বেশি, তার নাম ভারত নয়, চীন। এ দেশে ভারত থেকে ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হলে চীন থেকে আসে ৬০০ কোটি ডলারের। অথচ ভারতের প্রথম স্থানে না থাকার কোনো কারণই নেই বলে মনে করেন 'ফিকি'র সভাপতি আর ভি কানোরিয়া। চীনের পলকা খেলনা বা খেলো বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতিতে ঢাকার বাজার ভরে থাকলেও, ভারত থেকে তুলা বা খাদ্যপণ্য না এলে বাংলাদেশের অর্থনীতি পথে বসবে।
সমস্যাটা কোথায়? ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ বোঝালেন, 'বাণিজ্যের মোট পরিমাণ বাড়াতে গেলে শুধু ভারত থেকে আমদানি বাড়লেই চলবে না। ভারতকে বাংলাদেশি পণ্যের রফতানিও বাড়াতে হবে।' অথচ সেটা দশ ভাগের এক ভাগ। কারণ বাংলাদেশে যা তৈরি হয়, তার প্রায় সবই ও দেশে পাওয়া যায়। শরণের ব্যাখ্যা, 'সে জন্যই আমরা বলছি, ভারতীয়রা এ দেশে বিনিয়োগ করুন। বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ গড়ে উঠুক। এখানে যে পণ্য তৈরি হবে, তা ভারতে তো বটেই, অন্য দেশেও রফতানি হতে পারে। তাতে দু'দেশেরই লাভ।' ডেপুটি হাইকমিশনার সন্দ্বীপ চক্রবর্তীর কথায়, ভারতের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব প্রায় পুরোটাই বেইজিংয়ের। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ কাজ দিলি্লকেই করতে হবে।
তিন দিন সেই চেষ্টা চলবে। মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতি, সর্বস্তরেই আলোচনা হবে। ভারত-বাংলাদেশ শিল্প-বণিকসভার সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদও মানছেন, 'এত বড় আয়োজন প্রথম। এর অর্থ দিলি্ল বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে।'

প্রেমাংশু চৌধুরী : কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.