কথা সামান্যই-পুঁজিবাদ প্রচারে সমাজতন্ত্রের ভাষা by ফজলুল আলম

একটা সময় ছিল যখন শ্রেণী, শ্রেণী বিভাজন, শ্রেণীসংগ্রাম, পুঁজি, শ্রমিক, শ্রম, শ্রমিক-মজুরদের ক্ষমতায়ন (এমপাওয়ারমেন্ট), শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করলে লেখককে কমিউনিস্ট অ্যাখ্যা দিয়ে বিতাড়িত করা হতো, তার লেখা কোনো অভিজাত পত্রিকায় ছাপা হতো না।
শুধু লেখককে নয়, এসব শব্দের আমদানিকারক মার্কসকেও বিতাড়িত করা হতো। কারণ এসব মার্কসীয় তত্ত্বউদ্ভূত শব্দ। কিন্তু কোনো ভাবনাকে বিতাড়িত করতে চাইলেই তো আর তাকে বিতাড়িত করা যায় না, যদি জনগণ, বিশেষত শিক্ষিত একটি সম্প্রদায়ের কাছে এবং যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করতে পারলে সাধারণ জনগণের কাছেও সেসব গ্রহণযোগ্য হয়।
সাধারণ জনগণ বৈষম্য, নিপীড়ন, দারিদ্র্য, জাতভেদ প্রথায় অসহায়তা ও বৃহত্তর সমাজের অবহেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। তাদের বোঝানো হয়েছে যে তাদের কিছু আর্থিক সংগতি হলেই এসব সমস্যা কেটে যাবে। অর্থনীতিবিদরা এই বিষয়টা নিয়ে কখনোই কম ভাবেননি। মার্কসের ক্যাপিটাল প্রকাশের আগেই পুঁজির উদ্বৃত্ত মূল্য নিয়ে লেখা হয়ে গিয়েছিল এই মর্মে যে একজন উৎপাদক সব কিছু খরচ করে যখন একটা কিছু উৎপাদন করে সেখানে তাকে লাভ করতে হলে একমাত্র উপায় শ্রমিককে তার প্রাপ্যের চেয়ে কম মূল্য দেওয়া এবং শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য পকেটস্থ করা।
কিন্তু শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারে শিগগিরই প্রথমে ইউরোপে ও কিছুদিনের মধ্যে উত্তর আমেরিকায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে। এতে পুঁজিবাদের প্রসার হতে থাকে। পুঁজির এই আগ্রাসনের সঙ্গে শ্রমিকের সম্পর্ক যেমন নিচুতে চলে যেতে শুরু করে তেমনি চাষবাস বাদ দিয়ে গ্রাম থেকে চাষিরাও বেশি রোজগারের আশায় শহরে চলে আসতে শুরু করে। তাদের অল্প মজুরি দিয়ে পুঁজি বিনিয়োগের উদ্বৃত্ত মূল্য নিতে নিতে একদল শিল্প উৎপাদক উচ্চ শ্রেণীতে পরিণত হয়। এই দল থেকে আরো একটি শ্রেণীর উদ্ভব হয়, তারা মূল পুঁজিপতিদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত এবং উচ্চ শ্রেণীর ধনসম্পদ রক্ষা করা তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু সেই সঙ্গে নিজেদের সুবিধা ভোগ করার ব্যবস্থাতেও তারা পিছিয়ে থাকে না। এরা পুঁজিপতি হতে না পারলেও বুর্জোয়া সম্প্রদায় নামে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে শুরু করে। পুঁজিপতি আর বুর্জোয়াদের মধ্যকার যে পার্থক্য, সেটা মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নানাভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে, মনে করা হয় 'জাতীয় বুর্জোয়া দল'ই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রথমে সংগ্রামে নামবে।
মার্কসের এই সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণে না গিয়ে এখানে এইটুকু বলা যায় যে এই ধারণাগুলো সবই মার্কস-এঙ্গেলসের চিন্তাপ্রসূত এবং সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো যে পুঁজিবাদকে আক্রমণ করার সব বক্তব্য তাঁরা যথাযথভাবে উত্থাপন করেছেন। শ্রেণী বিভাজনের সমাপ্তি না হলে বিশ্বের সমস্যার সমাধান বিশেষ করে দারিদ্র্যের সমাধান ঘুচবে না। আবার দারিদ্র্য যদি না থাকে তবে পুঁজির মালিক শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য নিয়ে লাভ করতে পারবে না, পুঁজিবাদনির্ভর সাম্রাজ্যবাদও ধ্বংসের মুখে পতিত হবে।
এই বিপদ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো জনগণকে মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের মতবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এই কাজে প্রথমে সরাসরি সমাজতন্ত্রকে আক্রমণ করে কোনো ফল হয়নি। পরে তারা তাদের স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করে এবং সমাজতন্ত্রের অভিযোগ শব্দ ও বিশ্লেষণ ব্যবহার করেই সমাজতন্ত্রকে আক্রমণ করে। এই কাজে তারা অনেকাংশে সফল হয়েছে। শ্রেণী বিশ্লেষণে তারা পুঁজিবাদকে দোষারোপ করেনি; বরং পুঁজিবাদ যে নিম্নে পড়ে থাকা শ্রেণীর জন্য জানপেহচান করে দিচ্ছে, সেটা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে কথা বলছে। অতীতে নিৎসে থেকে শুরু, বর্তমান সময়ে এই কাজে প্রায় সব বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন, পৃথিবীর সর্বত্র এবং তাঁরা পুরস্কৃতও হচ্ছেন।
পাঠক, আমি এখানে কয়েকজন সর্বপরিচিত নাম উল্লেখ করে শেষ করছি, অনেকের মধ্যে অমর্ত্য সেন, স্টিগলিজ, ড. ইউনূস (তাঁরা সবাই নোবেল প্রাপক)- তাঁদের কথা বলা যায়। অমর্ত্য সেনকে একসময় মার্কসিস্ট মনে করা হয়েছিল, কিন্তু পরে তিনি নিজেই সেটা অস্বীকার করেছেন। তাঁর মূল বক্তব্য শ্রেণীকে এড়িয়ে চলে তৈরি করা, তাঁর দুর্ভিক্ষের কারণ 'খাদ্যদ্রব্যে যাদের অ্যাক্সেসে ছিল না তারাই দুর্ভিক্ষে কবলিত হয়েছিল।' তাঁর মতে, অ্যাঙ্সে না থাকার কারণ ভুলভাবে খাদ্যদ্রব্য বণ্টন ব্যবস্থা, দারিদ্র্য বা শ্রেণী বিভাজন নয়। স্টিগলিজ তো আরো এক কাঠি ওপরে; তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙা থেকে শুরু করে নতুন রাশিয়ার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফের ভ্রান্ত প্রেসক্রিপশনকে। তাঁর কাছে আমেরিকা ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ক্রমাগত কমিউনিজমের মতো একটা সুষম সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন না এনে ভেঙে ফেলা ঠিক হচ্ছে না। এর জন্য তিনি গ্লোবালাইজেশন করে পৃথিবীর সব 'সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণী'কে উঠিয়ে নিয়ে আসবেন। ড. ইউনূস শুরু থেকে দরিদ্রদের পক্ষে; তাদের এমপাওয়ারমেন্ট বা ক্ষমতায়ন (অর্থনৈতিক) তাঁর মূল লক্ষ্য এবং এই কাজে তাদের ব্যবসা করার ক্যাপিটাল বা 'মূলধন' জোগান দেওয়া তাঁর কাজ। এই কাজে তিনি 'বঞ্চিত শ্রেণী' যাতে সুবিধাভোগী শ্রেণীর মতো ব্যাংকিংয়ের সুবিধা পায়, তার ব্যবস্থাও করেছেন। এর সবই কিন্তু সমাজতন্ত্রের ভাষা- পার্থক্য শুধু এসব সমাজতন্ত্রবিহীন কার্যকলাপ।
তাঁদের সবাই পুঁজিবাদনির্ভর সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে, কিন্তু এখন তাঁদের কলমে সমাজতন্ত্রের শব্দগুলো ছাড়া আর কিছু আসছে না। এ থেকে মনে হতে পারে সমাজতন্ত্রীরা এত দিন সাধারণ মানুষকে যে শব্দগুলো শেখাতে পারেননি, সেগুলো এই সমাজতন্ত্রবিরোধীরাই বলেন, বা না বলে তাদের মুখে জোগান দিচ্ছেন। কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে, তাতেই সমাজে একটা নবচেতনার উদ্ভব হতে পারে না কি? মানুষ কি এ ধরনের পুঁজিবাদী বই পড়ে ভাবতে শুরু করতে পারে না যে সমাজতন্ত্রের পক্ষেই তারা যাবে!

লেখক : কথাশিল্পী ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক

No comments

Powered by Blogger.